রাজশাহীতে আমচাষের রেকর্ড লক্ষ্যমাত্রা এবার: গাছে গাছে মুকুলের সমারোহ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহীর দুর্গাপুরের দাওকান্দি গ্রাম। গ্রামটির চারিদিকে যেন আমগাছে ভরা। ফলে চারিদিকে তাকালে যেন নজরে আসবে গাছভর্তি মুকুল আর মুকুল। আমগাছগুলোতে এবার এতোটা মুকুল এসেছে যে মুকুলের ভারেই যেন ডাল ভেঙে পড়ার অবস্থা হয়ে আছে। ছোট-মাঝারি এবং বড় সব ধরনের গাছে গাছেই মুকুলের সমারোহ। আর মুকুলের এমন দৃশ্য দেখে যেন চোখ জুড়ে যায়। কোনো কোনো গাছে মুকুল ফুটছে, তো কোনো কাছে মুকুলে ফুটে ঝরে যাচ্ছে। ঝরে যাওয়া মাকুল থেকে আমের ছোট ছোট গুটি আসতেও দেখা গেছে গাছগুলোতে।

এই অবস্থা শুধু দাওকান্দি গ্রামেই নয়, গোটা রাজশাহীতেই বিরাজ করছে। জেলা চারঘাট-বাঘা, পুঠিয়া, দুর্গাপুর, পবা, মোহনপুর, তানোর ও গোদাগাড়ীর গাছগুলোতে থোকায় থোকায় ধরে আছে মুকুল আর মুকুল। চারিদিকে যেন মুকুলের হালকা গন্ধও ছড়িয়ে পড়েছে।

রাজশাহীর ফল গবেষণা কার্যালয় সূত্র মতে, আমের রাজধানী রাজশাহীতে বেড়েই চলেছে আমের চাষ। গত কয়েক বছর ধরে রাজশাহীতে অব্যাহতভাবে বেড়েছে আমচাষ। এক হিসেব মতে, গত ছয় বছরে রাজশাহীতে আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে দ্বিগুন। সেইসঙ্গে উৎপদানও বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। পাশাপাশি বাড়ছে অর্থনীতির গতিও। এবারও রেকর্ড পরিমাণ আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা বেড়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে এ বছর।

চলতি বছর রাজশাহীতে আমের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে। যা এর আগে এতো পরিমাণ জমিতে আমচাষ কখনোই হয়নি। এ বছর ওই পরিমাণ জমি থেকে আম উৎপদানের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৬৬৪ মেট্রিক টন। এটিও স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি লক্ষ্যমাত্রা। আমগাছে যে পরিমাণ মুকুল এসেছে-তাতে এ বছর লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গিয়ে রেকর্ড পরিমাণ আম উৎপাদন হবে বলেও আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা।


রাজশাহীতে আমকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর মৌসুমজুড়ে আম কেনা-বেচা, গাছ থেকে পাড়া, পরিচর্যা, পরিবহণসহ নানাকাজে যুক্ত থেকে কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। চলতি বছরেও শুরু হয়েছে আমচাষ নিয়ে নানা কর্মযজ্ঞ। সেইসঙ্গে এবারও আম নিয়ে আশায় বুক বেধে আছেন হাজার হাজার চাষি। এরই মধ্যে আমগাছে আসা মুকুল ফুটেছে আবার মুকুল ঝরে ছোট আকারের গুটি আসতে শুরু করেছে। মুকুল আসার আগেই গাছগুলোতে কয়েক দফা পরিচর্যার পর্ব সেরে রেখেছেন চাষিরা। এখনো চলছে গাছের গড়ায় পানি দেওয়াসহ নানা পরিচর্যা। মুকুল ঝরে কয়দিন পরেই গুটিগুলো বড় হতে শুরু করেব। এরপর সেগুলো কুড়িতে (স্থানীয় ভাষায় কোড়ালি) পরিণত হবে। তারপর হবে পরিপক্ক আম। বৈশাখের শুরুর দিকেই সেই আম উঠবে বাজারে। তখন থেকেই চাষিদের পকেটে ঢুকতে থাকবে টাকা।

রাজশাহী ফল গবেষণাগার থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর রাজশাহীতে ১৬ হাজার ৯৬১ হেক্টর জমিতে আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। সেখানে চাষ হয় ১৭ হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে। যা গত বছর ছিল রাজশাহীতে সর্বোচ্চ আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা। এর আগের বছর ২০১৬ সালে রাজশাহীতে ১৬ হাজার ৫৮৩ হেক্টর জমিতে আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। সেখান থেকে আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২ লাখ ১৫ হাজার ৫৭৯ মেট্রিক টন। সেখানে উৎপাদন হয় এক লাখ ৮১ হাজার ১০৭ মেট্রিক টন। গত বারের উৎপাদনই এবারের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এবার গতবারের চেয়ে আম বেশি উৎপাদন হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। কারণ গতবারের চেয়ে এবার বেড়েছে লক্ষ্যমাত্রা।

ওই সূত্রটি আরো জানায়, ২০১৫ সালে রাজশাহীতে আমচাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৫১৯ হেক্টর জমিতে। সেখানে চাষ হয়েছিল ১৬ হাজার ৫৮৩ হেক্টর জমিতে। এর আগের বছর ২০১৪ সালে রাজশাহীতে আমচাষের জন্য ১৪ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০১৩ সালে রাজশাহীতে আমের লক্ষমাত্রা ছিল ৮ হাজার ৯৮৬ হেক্টর জমিতে। তবে সেখানে হয়েছিল ১৪ হাজার ৫ হেক্টর জমিতে।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল আলীম জানান, হেক্টর প্রতি গড়ে ১৫ দশমিক ৫৮ মেট্রিক টন হারে আম উৎপাদন হবে বলেও এবারও আশা করা হচ্ছে। সেই হিসেবে এবার আমের উৎপাদন গতবারের চেয়ে অনেক বাড়বে। যা হবে সবচেয়ে বেশি আমের উৎপাদন। এবার গাছগুলোতে ব্যাপক পরিমাণ মুকুল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা না দিলে এবারও রাজশাহীতে সর্বোচ্চ আম উৎপাদন হবে।

আমচাষিরা জানান, আমের রাজধানী রাজশাহীর গাছগুলো শুরুতেই যেন বাধভাঙা জোয়ারের মতো করে আসে মুকুল। গাছে গাছে মুকুলের সমারোহ দেখা দেয়। এবার আবহাও রয়েছে অনুকূলে। বছরের শেষ শীতের দিকেও এবার তেমন কুয়াশা দেখা যায়নি। ফলে এবার মুকুলের এখন পর্যন্ত তেমন ক্ষতি হয়নি।

রাজশাহীর দুর্গাপুরের আমচাষি আলতাফ হোসেন বলেন, ‘রাজশাহীর সুস্বাদু আম সারাদেশজুড়েই ব্যাপক চাহিদা থাকে। ফলে এই আম ঘিরে রাজশাহীর চাষি ও আমবাগান মালিকরাও আশা-নিরাশার দোলাচলে ভোগেন। যেবার গাছে আম বেশি থাকে, দাম বেশি পাওয়া যায়, সেইবার আমচাষি ও ব্যবসায়ীদের মুখে হাসি থাকে। আবার যেবার গাছে আম কম থাকে, সেইবার চাষিদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীরাও কিছুটা হতাশ হয়ে ওঠেন। তবে এবার আমের মুকুল এসেছে ব্যাপক হারে। আমগাছগুলোর পরিচর্যাও নেওয়া হচ্ছে। আশা করি এবার আমের ভালো ফলনই হবে।’

বাঘার হাবাসপুর গ্রামের আম ব্যবসায়ী ও চাষি আশরাফুল ইমলাম বলেন, ‘এবার আমগাছ যে পরিমাণে মুকুল এসেছে, তাতে মনে হচ্ছে বাম্পার ফলন হবে। এখন বাকি সময়টুকুতে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না দেখা দিলেই হলো।’

তিনি আরও বলেন, ‘এবার প্রতিটি ৮-১০ বছর বয়সের ছোট আকারের একটি আম গাছেও অন্তত ২-৩ মণ আম আসবে। যা বিক্রি করে ভালো জাতের একটি আম গাছ থেকেই কমপক্ষে চার হাজার টাকার আম বিক্রি করা যাবে। আর বড় গাছগুলোতে কমপক্ষে ৮ মণ করে আম আসবে। যা বিক্রি করে চাষিরা কমপক্ষে ১৬ হাজার টাকা আয় করতে পারবেন।’

অন্যদিকে আমচাষের পরিচর্যা সম্পর্কে কৃষকদের উদ্দেশ্যে রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘আমের গুটি টিকিয়ে রাখতে সাইপারমেটথ্রিন জাতীয় কীটনাশক এক মিলিমিটার এবং ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক দুই গ্রাম এক লিটার পানির সঙ্গে মিশিয়ে গাছে ¯েপ্র করতে হবে। এছাড়াও খরা দেখা দিলে প্রতি ১৫-২০ দিনের মাথায় ২-৩ বার আম বাগানে সেচ দিয়ে পরিচর্যা নিতে হবে। তা না হলে খরায় আমের গুটি ঝরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’

তিনি বলেন, ‘আম একটি যতœশীল ফল। এটিকে যত্নসহকারেই উৎপাদন করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে যেন সেটি কখনোই বাড়তি যতœ না হয়। তাহলে ভালো ফলনের চেয়ে আরও খারাপ হতে পারে। কাজেই আমের গাছে কোনো ধরনের সমস্য দেখা দিলেই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী গাছের পরিচর্যা নিতে হবে।’