রাজনৈতিক কারণে জঙ্গিবাদের বিপদ বাড়বে না: মনিরুল ইসলাম

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম পুলিশের ‘কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট’-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। হোলি আর্টিজান হামলার তৃতীয় বার্ষিকী সামনে রেখে গত বৃহস্পতিবার তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীদের তৎপরতার বর্তমান দশা, সামনের ঝুঁকি ও মোকাবিলার পথ নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া

**হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার তিন বছর হলো, দেশে জঙ্গি তৎপরতা দৃশ্যত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এই কৃতিত্ব কীভাবে দেখছেন?

মনিরুল ইসলাম: জঙ্গি তৎপরতা এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। এটা সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু এতে আমরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছি, তা নয়। এটা বৈশ্বিক সমস্যা এবং এই মতাদর্শের লোকজন আমাদের সমাজে ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় আছে। সুযোগ পেলে তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, তা আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। আমাদের দেশে সন্ত্রাসবাদ যে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে, এর কৃতিত্ব মূলত জনসাধারণের। কারণ, জনগণ এ ধরনের তৎপরতা ঘৃণা করে। এতে জঙ্গিদের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়েছে। আমরা জনগণের সহায়তা পেয়েছি। সর্বোপরি কৃতিত্ব হচ্ছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর। ২০০৯ সালে তিনি জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন এবং হোলি আর্টিজানের পর তা পুনর্ব্যক্ত করে আমাদের সে অনুযায়ী কাজ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন।

** জঙ্গি মোকাবিলার দুটি দিকের একটি প্রশাসনিক। আপনারা সেই দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যথাযথ নীতি–সমর্থন না পেলে তা বাস্তবায়ন করা কঠিন। এ ক্ষেত্রে কোনো ঘাটতি আছে? সরকারের তরফে আরও কিছু করার আছে কি?

মনিরুল ইসলাম: জঙ্গিবাদ দমনে আমাদের প্রতি সরকারের নির্দেশনায় সদিচ্ছার ঘাটতি নেই। আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সরকার প্রয়োজনীয় সহায়তা করে যাচ্ছে। তবে হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর সরকারি-বেসরকারি অংশীজন ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ শুরু হয়েছিল, তাতে ভাটা পড়েছে ও শিথিলতা এসেছে। জঙ্গিবাদ দমন একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। সব অংশীজনের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যেহেতু কিছু শিথিলতা এসেছে, তাই এখানে সক্রিয়তা জরুরি। এটা নিশ্চিত করা গেলে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার কাজ আরও সহজ হবে।

**আপনাদের কাজের ক্ষেত্রে কি কোনো শিথিলতা আসেনি? সম্প্রতি দুটি ছোট হামলার ঘটনা ঘটেছে এবং আইএস এর দায় স্বীকার করেছে। আমরা শুনলাম, এসবি অফিসের সামনের সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্ট। আর এই দুটি ঘটনার কোনো কূলকিনারাও হয়নি।

মনিরুল ইসলাম: আসলে আমাদের নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি আছে বা কাজে শিথিলতা এসেছে, এমনটি বলা যাবে না। আর আপনি যে সিসিটিভি ক্যামেরা নষ্টের কথা বললেন, সেটা সম্ভবত ফ্লাইওভারের কারণে সরাতে হয়েছিল। আর আমরা তো এখনো সব সড়ক সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনতে পারিনি। ভেতরের ক্যামেরা ঠিক ছিল। সেখান থেকে কিছু সূত্র পাওয়া গেছে। এই ঘটনা সম্পর্কে জনগণ বাইরে থেকে যা-ই বলুক না কেন, আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গেই বিষয়গুলো দেখছি। কোনো শিথিলতা নেই। পুরো ঘটনাটি উদ্‌ঘাটন করতে পারিনি, কিন্তু আমাদের সব চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।

**জঙ্গি দমনের পাশাপাশি জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া রোধ করাও তো জরুরি। অনেক জঙ্গি আটকের পর কারাগারে থাকছেন। তাঁরা সেখানে অন্য কয়েদিদের উদ্বুদ্ধ করছেন। কারাগার যে জঙ্গি উদ্বুদ্ধকরণের উর্বর ক্ষেত্র, তা প্রমাণিত। এ ব্যাপারে কি আপনাদের কিছু করার নেই?

মনিরুল ইসলাম: দেখুন, কারা কর্তৃপক্ষ পুলিশ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এমনকি পুলিশ সদস্যদের সাধারণভাবে কারাগারে ঢোকারও সুযোগ নেই। ফলে আইনগতভাবে কারাগারের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার সুযোগ নেই। তবে কারাগারগুলোর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এখন সন্ত্রাস দমন আইনে রুজু করা মামলায় আটকদের সঙ্গে সাধারণ কয়েদিদের মেলামেশার সুযোগ কমেছে।

** আপনারা কি এই বিপদের বিষয়টি সরকারের নজরে আনার চেষ্টা করেছেন বা কারা কর্তৃপক্ষকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন?

মনিরুল ইসলাম: কারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক—সব পর্যায়েই যোগাযোগ রয়েছে। এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমরা তাদের সচেতন করার চেষ্টা করি। সন্ত্রাস দমন নিয়ে কাজ করে, এমন অন্য সংস্থাগুলোও কারাগারে জঙ্গি উদ্বুদ্ধকরণের বিপদের বিষয়ে সজাগ রয়েছে এবং কারা কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে সচেতন করেছে। আমরা এখন এ ধরনের কয়েদিদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা রক্ষীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে তাঁদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছি। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিকভাবেও কারাগারকে জঙ্গি উদ্বুদ্ধ করার উপযুক্ত ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমরা সেই ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছি।

** জঙ্গিবাদ বা এ ধরনের কাজে জড়িতদের অনেকেই গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামিন পান বা সাজা ভোগের পর বের হয়ে আসেন। তাঁদের প্রতি আপনাদের কোনো নজর থাকে কি?

মনিরুল ইসলাম: জামিন পাওয়ার অধিকার সবারই আছে। জামিন দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়টি আদালতের এখতিয়ার। তবে ডির‌্যাডিক্যালাইজেশনের কাজটি আমরা এখনো সুসংগঠিতভাবে শুরু করতে পারিনি। একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি বা সন্ত্রাসী যখন আটক হন, তখন তাঁকে এই উগ্র পথ থেকে সরিয়ে আনার প্রক্রিয়া কারাগারেই শুরু হওয়া উচিত। যাতে সেখানেই তিনি সংশোধিত হতে পারেন। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও ধর্মীয় চিন্তাবিদদের সহায়তা নিয়ে তাঁদের সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া যায়। এ ধরনের কাজ আমরা শুরু করতে পারিনি। যাঁরা আটক হন, তাঁদের সবার অপরাধের মাত্রা সমান নয়। অভিযোগের মাত্রা গুরুতর, এমন কেউ যখন জামিন পান, তখন আমরা তাঁর ওপর নজরদারি অব্যাহত রাখি। জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িত হিসেবে শাস্তি পেয়েছেন এবং সাজার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, এমন কয়েকজনকে আমরা চিহ্নিত করেছি। তাঁদের আর্থিক সহায়তা ও সামাজিকভাবে পুনর্বাসনের উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। দ্রুতই সেই উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখা যাবে।

**পাকিস্তানের মতো দেশে ইসলামি জঙ্গিদের জন্য পৃথক ডির‌্যাডিক্যালাইজেশন কেন্দ্র আছে, যার মাধ্যমে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধদের সেই পথ থেকে ফিরিয়ে আনা ও সামাজিক-অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসনের কার্যক্রম চলে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে সরকারের কোনো উদ্যোগ বা আপনাদের কোনো পরামর্শ আছে কি?

মনিরুল ইসলাম: এ রকম কিছু কাজের অনুমোদন আমরা পেয়েছি। কিন্তু এর জন্য আইনগত বিধিবিধানের কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন রয়েছে। আমরা যদি জামিন পাওয়ার পর বা সাজা ভোগ কারার পর কাউকে আলাদা করে কোথাও রাখতে চাই, তাহলে এটা লাগবে। কারাগারের ভেতরে প্রয়োজন অনুযায়ী মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা ধর্মীয় চিন্তাবিদদের পাঠাতে হলেও কারাবিধির সংশোধনী লাগবে। এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে আমরা আলোচনা করছি। আশা করছি ভবিষ্যতে আমরা এ ব্যাপারে কার্যকর কিছু করতে পারব।

**শিক্ষার কারিকুলাম নিয়ে বিভিন্ন সময়ে কথা হয়েছে। পাঠ্যবইয়ে এমন অনেক বিষয় আছে, যা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়তে সহায়তা করে। সমাজে এ ধরনের পরিস্থিতি বজায় রেখে জঙ্গিবাদী ধ্যানধারণার বিস্তার রোধ করা কঠিন। এ ব্যাপারে আপনাদের ভূমিকা বা এ নিয়ে কোনো পরামর্শ আছে কি সরকারের কাছে?

মনিরুল ইসলাম: জঙ্গিবাদ মোকাবিলা একটি জটিল ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা এসব নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে কাজ করছি। অভিভাবক, শিক্ষক, যুবসমাজ, ইসলামি চিন্তাবিদ, আইনজীবী, সংস্কৃতিকর্মীসহ সমাজে যাদের ভূমিকা পালনের সুযোগ আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে ঘাটতি ও সমস্যার জায়গাগুলো চিহ্নিত করার উদ্যোগ চলছে। আমাদের পক্ষে সম্ভব কাজগুলো আমরা করব। আর যা আমাদের আওতায় নেই, সেগুলো করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেব। আমাদের গবেষণা সেল ‘প্রিভেন্টিং ভায়োলেন্ট এক্সট্রিমিজম’ নিয়ে কাজ করছে। তারা সবার সঙ্গে আলোচনা, পরামর্শ ও মতামত নিয়ে একটি গাইডলাইন তৈরি করছে। সেই সুপারিশমালা আমরা তুলে ধরব। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের মধ্যে যেন উগ্রবাদী চিন্তাচেতনা তৈরি না হয়, সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় শিক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা জাগিয়ে তোলা। একই সঙ্গে বাঙালি সংস্কৃতির ভিত্তিতে দেশপ্রেম, দায়বদ্ধতা, পরমতসহিষ্ণুতা—এসব বিষয়ে আগামী প্রজন্মকে সচেতন করে তোলা।

** আপনারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারি করেন। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন অনেক ওয়াজের ভিডিও ফুটেজ দেখা যায়, যা খুবই উসকানিমূলক। সমাজে অসহিষ্ণুতা ও ধর্মীয় বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে এসবের ভূমিকা থাকতে পারে। এসবের বিরুদ্ধে আপনাদের কোনো ভূমিকা নেই কেন?

মনিরুল ইসলাম: আসলে আইন দিয়ে সবকিছু মোকাবিলা করা যেমন উচিত নয়, তেমনি সম্ভবও নয়। ওয়াজের নামে খুবই বিদ্বেষমূলক ও অশ্লীল বক্তব্য দিয়েছেন, এমন অনেকের বক্তব্য আমরা এরই মধ্যে নামিয়ে ফেলেছি। কয়েকজনকে আমরা চিহ্নিত করেছি। তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার উদ্যোগ রয়েছে। অনেককে এ ধরনের বক্তব্য থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে জনমত তৈরির বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাঁরা এ ধরনের বক্তব্য দেন, তাঁদের কাউকে কাউকে ছয় মাস আগে বুকিং দিয়ে, বুকিং মানি দিয়ে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। যাঁরা নারীবিদ্বেষী কথা বলেন, ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ান বা অন্য ধর্মের প্রতি কটাক্ষমূলক মন্তব্য করেন, তাঁদের ব্যাপারে জনমত তৈরির কাজটি গুরুত্ব দিয়ে করতে হবে।

**আপনারা বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী তৎপরতায় জড়িতদের পুরোপুরি হোমগ্রোন হিসেবে বিবেচনা করছেন। জেএমবি সংগঠনটি একসময় সক্রিয় হয়েছিল। এখন আপনারা তাদের বলছেন নব্য জেএমবি। এই নামটি কি তারা নিজেরা ব্যবহার করে, না আপনারা দিয়েছেন? এদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠীর কোনো সম্পর্ক নেই, এমনটি বলে যাওয়া কি কোনো কৌশলের অংশ?

মনিরুল ইসলাম: দেখুন, জঙ্গিবাদ মোকাবিলার ক্ষেত্রে আল-কায়েদা, আইএস, হিযবুত তাহ্‌রীর, জেএমবি, নব্য জেএমবি বা অন্য কোনো গোষ্ঠীর মধ্যে আলাদা করে পার্থক্য করার কোনো সুযোগ নেই। কাজের ক্ষেত্রে আমাদের আন্তরিকতা বা সদিচ্ছা এবং সক্ষমতা আছে কি না, তা বিবেচনা করা উচিত। এই দুই ক্ষেত্রে আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। বিশ্বে ইসলামি উগ্রবাদের নামে এখন যে সংগঠনগুলো সক্রিয়, সেগুলোকে আমরা তিনটি ভাগে ভাগ করতে পারি। এর একটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক সংগঠন হিযবুত তাহ্‌রীর। বিশ্বের ৫০টি দেশে ১৯৫৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনের শাখা রয়েছে। এদের কৌশল সবখানেই এক। আন্তর্জাতিক হিযবুত তাহ্‌রীরের যে কৌশল, বাংলাদেশে হিযবুত তাহ্‌রীরের কৌশলও তা-ই। আল-কায়েদার আদর্শের ওপর ভিত্তি করে ১৯৯২ সালে হরকাতুল জিহাদ তৈরি হয়েছিল। ১৯৯৮ সালে যে জেএমবি গড়ে উঠেছিল, সেটিও আল-কায়েদার অনুসরণেই। একটা সুন্নি শ্রেষ্ঠত্ব ও শরিয়াভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তারা কাজ করেছে। কৌশল ভিন্ন হলেও আদর্শ এক। এরপর গড়ে ওঠা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আরও পরের সংগঠন আনসার আল ইসলামও একই আদর্শের অনুসারী। এই সংগঠন দুটি আল-কায়েদা বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে ‘আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্টে’ এর আদর্শ ধারণ করলেও তাদের সঙ্গে সরাসরি সাংগঠনিক যোগাযোগের কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি। ঠিক তেমনিভাবে যখন আইএস হলো, তখন এর আদর্শে বিশ্বাসী ব্যক্তি ও সংগঠনের অস্তিত্বও বাংলাদেশে মিলেছে। আইএসের পক্ষে যুদ্ধ করতে যাঁরা সিরিয়ায় গেছেন, তাঁরা কিন্তু বাংলাদেশের কোনো সংগঠনের মাধ্যমে যাননি। তাঁরা সরাসরি যুক্ত হয়েছেন। বাংলাদেশে যে হামলাগুলো হয়েছে, তা আইএসের সাংগঠনিক সিদ্ধান্তে হয়েছে, এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি।

**আইএসের হয়ে যুদ্ধ করার জন্য সিরিয়ায় যাওয়া বাংলাদেশিদের কেউ কেউ মারা গেছেন। আইএসের পতনের পর অনেকে আটক হয়েছেন। অনেকে সেখান থেকে পালানোর চেষ্টা করছেন। তাঁদের দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থান কী?

মনিরুল ইসলাম: বাংলাদেশের প্রচলিত আইন বা সংবিধান যা বলে, তার বাইরে আমাদের কিছু করার নেই। বাংলাদেশি নাগরিকদের কেউ যদি সেখানে গিয়ে থাকেন, তবে এক রকম, আর যদি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কিন্তু অন্য দেশের নাগরিক হন, সে ক্ষেত্রে অন্য রকম। ফলে প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা বিবেচনা কাজ করবে। আমরা নাগরিকত্বের বিষয়টি যাচাই-বাছাই করে দেখব, তারপর ব্যবস্থা।

** আমাদের আইন কী বলে? তেমন কেউ বাংলাদেশের নাগরিক হলে আমাদের করণীয় কী?

মনিরুল ইসলাম: বাংলাদেশের নাগরিকদের কেউ দেশের বাইরে গিয়ে যদি অপরাধ করেন এবং আমাদের আইনে যদি তা শাস্তিযোগ্য হয়, তবে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। কোনো দেশ যদি কাউকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে চায়, তবে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা হবে। তবে ফেরত পাঠাতে হলেও ভ্রমণ দলিল লাগবে। তারা যে বাংলাদেশের নাগরিক, তার প্রমাণ লাগবে।

** প্রধানমন্ত্রী গত বুধবার বলেছেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি। রোহিঙ্গারা দেশত্যাগে বাধ্য হওয়া একটি নির্যাতিত মুসলিম জনগোষ্ঠী। এ ধরনের জনগোষ্ঠীকে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা সবচেয়ে সহজ কাজ। রোহিঙ্গাদের ওপর আপনাদের নজরদারি কতটুকু? এ ধরনের বিপদ সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি ও সক্ষমতা আপনাদের রয়েছে কি?

মনিরুল ইসলাম: সন্ত্রাসে জড়ানো বা জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার জন্য যে ক্ল্যাসিক্যাল পরিস্থিতির প্রয়োজন, তার সবই রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে রয়েছে। তবে এই মুহূর্তে স্বস্তির বিষয়টি হচ্ছে শরণার্থীদের অধিকাংশই নারী, শিশু ও অপেক্ষাকৃত বয়সী লোকজন। এদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি কম। তবে আরও কয়েক বছর যদি তারা বাংলাদেশে থাকে, তবে আজ যে শিশুর বয়স ১০ বছর, তার বয়স তখন ১৫ হবে। ঝুঁকির মাত্রা সে সময় বেড়ে যাবে। সন্ত্রাসী বা জঙ্গি সংগঠনগুলোর রিক্রুটারদের জন্য এরা লোভনীয় টার্গেট। তবে বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক শক্তি এখন এতটাই দুর্বল যে তাদের পক্ষে রোহিঙ্গা শিবিরে কিছু করা কঠিন। তবে আমাদের সচেতন থাকতে হবে, যাতে কেউ ভবিষ্যতে এর সুযোগ নিতে না পারে।

** দেশের রাজনৈতিক বা গণতান্ত্রিক পরিসর এখন সংকুচিত। এমন পরিস্থিতি রাজনীতিতে চরমপন্থা বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করতে না পারলে ভিন্ন পথ ধরে। জামায়াতে ইসলামীর মতো দল নিষিদ্ধ না হলেও কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। এদের কর্মী-সমর্থকদের চরমপন্থার দিকে ঝুঁকে পড়ার কোনো বিপদ আছে কি?

মনিরুল ইসলাম: সন্ত্রাসবাদ দমন বিষয়ে পুরোনো লেখা পত্রে বলা হতো, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা পরিসর সংকুচিত হলে চরমপন্থার বিকাশ ঘটে। কিন্তু আইএসের উত্থানের পর বা আইএসের যুগে এটা বলার সুযোগ নেই। আর মতামত প্রকাশ কিন্তু আটকে নেই। সবাই মতামত প্রকাশ করছেন। সেটা হয় প্রচলিত মিডিয়ায় বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আমরা দেখেছি, ১৯৯৮ সালে জামাআতুল মুজাহিদীন যখন তৈরি হয়েছে, তখন জামায়াত থেকে কিছু লোক সেখানে যোগ দিয়েছিল। ফলে নতুন করে জামায়াতে ইসলামীর লোকজনের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার কিছু নেই। তারা আগে থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে আছে। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জঙ্গিবাদের বিপদ বাড়বে বলে আমি মনে করি না।

**জঙ্গি বা সন্ত্রাস দমনে শুধু আপনার সংস্থা নয়, আরও অনেক সংস্থা জড়িত। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও প্রতিযোগিতার একটি অভিযোগ আছে। অনেকে মনে করেন, এ পরিস্থিতি ক্ষতিকর। আপনার অভিমত কী?

মনিরুল ইসলাম: জঙ্গি বা সন্ত্রাস নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের মধ্যে এনএসআই, ডিজিএফআই, স্পেশাল ব্রাঞ্চ আছে। তারা গোয়েন্দা তথ্য জোগাড় করার কাজ করে, তদন্তের কাজ করে না। সেটা তাদের কাজের মধ্যে পড়ে না। অভিযান ও তদন্তের কাজটি মূলত পুলিশ করে। পুলিশের মধ্যে আমরা আছি, র‌্যাব আছে, সাধারণ পোশাকের পুলিশ আছে। আসলে চাঞ্চল্যকর কোনো মামলার ক্ষেত্রে পুলিশ চেষ্টা করে, র‌্যাব চেষ্টা করে, ডিবি চেষ্টা করে। গুরুত্ব থাকে বলেই সবাই চেষ্টা করে, একটা প্রতিযোগিতা তো থাকেই।

** কিন্তু সমন্বয়ের কোনো ব্যাপার থাকবে না?

মনিরুল ইসলাম: আসলে ঘটনার গুরুত্ব বিবেচনা করে অনেক সময় সবাই মিলে চেষ্টা করে। কেউ সফল হলে তারাই বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে যায়। সংস্থাগুলো পরস্পরকে সহায়তা করে। যেমন মনে করেন তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে কোনো ঘটনায় বা মামলায় আমরা হয়তো কয়েকজন আসামি ধরেছি, আবার র‍্যাবও কিছু ধরেছে। সে ক্ষেত্রে ধরার পর ব্রিফিং করে তারা আসামিদের আমাদের কাছে হস্তান্তর করে। এটা নিয়ে বড় ধরনের কোনো সমন্বয়ের অভাব আছে বলে মনে করি না। যা আছে, তাকে সুস্থ প্রতিযোগিতা বলা যায়।

** আপনাদের একটি গবেষণা সেল আছে। সাধারণত অপরাধী বা সন্ত্রাসীরা যে ধরনের ঘটনা ঘটায়, তার ওপর ভিত্তি করে আপনারা তাদের মোকাবিলার কৌশল বের করেন। কিন্তু এখন সন্ত্রাসী বা জঙ্গিরা হামলার ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নতুন ও অভিনব কৌশল গ্রহণ করে। জঙ্গিরা আমাদের প্রচলিত ধারণার বাইরে কোনো কায়দায় হামলা চালাতে পারে, এমন বিষয়গুলো নিয়ে আপনাদের সেল কাজ করে কি?

মনিরুল ইসলাম: আমাদের কাজের একটা ইন্টেলিজেন্স, আরেকটি অ্যাসেসমেন্ট। যেসব ঘটনা ঘটে, তার তথ্য সংগ্রহ ও সেগুলো জড়ো করে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা হচ্ছে ইন্টেলিজেন্স। আর এর ওপর ভিত্তি করে আমরা যা নির্ধারণ করি, তা হচ্ছে অ্যাসেসমেন্ট। এটা যে সব সময় ঠিক হবে, এমন নয়। এর বাইরে গিয়ে অনেক ঘটনা ঘটে। আমাদের ভাষায় যাকে বলে ল্যাক অব ইমাজিনেশন। জঙ্গি বা সন্ত্রাসীদের নতুন কৌশল গ্রহণের বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় থাকে এবং আমরা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে ভাবার চেষ্টা করি, সেই সক্ষমতা আমাদের রয়েছে।

** ধন্যবাদ।

মনিরুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।