রাজনীতি গেছে অস্তাচলে

কয়েক দিন আগে টিভি সংবাদে দেখলাম, বিএনপির মহাসচিব বাজেট নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। টিভি ক্যামেরার সামনে বিএনপির কয়েকজন সাংসদ–নেতা বাজেটের কপি ছিঁড়ে টুকরা টুকরা করেছেন। অন্য দলগুলোর তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বাজেটকে ঘিরে প্রতিবছরই রাজনীতির মাঠ একটু গরম হয়। এখানে রাজনীতিটাই মুখ্য। বাজেট উপলক্ষ মাত্র। এবার অবশ্য মাঠ গরম করা যায়নি। করোনাকালে রাজনীতি একেবারেই মিইয়ে গেছে।

বাজেট-রাজনীতি আমাদের দেশে খুব পুরোনো। আমি দেখেছি, কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সব বাজেটই এক রকম। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে চাহিদা দেওয়া থাকে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাজ হলো সংকলন ও সম্পাদনা। এটা একটা টেকনিক্যাল দলিল। শুরু ও শেষের দিকে কিছু প্রস্তুতিগাথা থাকে। এটাকে বলা যায় বাজেট সাহিত্য। দলের সাহিত্যই বাজেটে তুলে ধরা হয়। ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতাচ্যুত হওয়া দলের বাজেট প্রতিক্রিয়া আসলে বাজেট নিয়ে নয়, বাজেট সাহিত্য নিয়ে। বাজেট তাঁরা কেউ পড়ে দেখেন বলে মনে হয় না।

বাজেট ঘোষণার আগেই পাড়ার ছাপাখানায় ব্যানার তৈরির অর্ডার যায়, ‘এ বাজেট স্মরণকালের শ্রেষ্ঠ বাজেট’ অথবা ‘এ হলো গরিব মারার বাজেট’। সংসদে বাজেট বক্তৃতা শেষ হওয়ার ১০-১৫ সেকেন্ড আগেই ব্যানার নিয়ে পথে বেরোয় মিছিল। এবার করোনাকালে মিছিল বন্ধ। নেতারা নিজ নিজ দলের কথা উগরে দিচ্ছেন সংবাদকর্মীদের কাছে। এর ফলে আমজনতা জানতে পারছে, কিছু একটা এসেছে। বাঙালির দুবেলা ভাত না হলে চলে না, তেমনি রাজনীতি ছাড়াও যেন জীবন অচল। আমাদের সমাজের প্রত্যেক সদস্য একেকজন পাকা রাজনীতিবিদ, অন্য অনেক দেশে নির্বাচন-টির্বাচন হলে কিছু মানুষ হইচই করেন। নির্বাচনের আগে দু-এক সপ্তাহ এ নিয়ে তাঁদের আড্ডা, কথাবার্তা হয়। নির্বাচন শেষ হয়ে গেলে সবাই যে যার কাজে লেগে পড়েন। ওটা নিতান্তই মৌসুমি ব্যাপার।

বাঙালি তো অনন্য। কবে কলকাতায় কংগ্রেসের কোনো একটা সম্মেলনে অতিথি গোপালকৃষ্ণ গোখলে বলেছিলেন, আজ বাংলা যা ভাবে, সারা ভারত সেটা ভাবে কাল। গেরস্তের বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে অতিথি কখনোই বলবেন না যে রান্না খারাপ হয়েছে। খাবার স্বাদ না হলেও তার তারিফ করবেন। এটাই সাধারণ ভদ্রতা। এটা ভেবে গেরস্ত যদি মনে করেন, তাঁর বাড়ির রান্না জগদ্বিখ্যাত, তাহলে একটু বেশি হয়ে যায় না? গোখলের কথা ধরেই বসে আছে নাক-উঁচু বাঙালি—আমরাই সেরা!

সেই বাঙালির রাজনীতির চর্চায় হঠাৎ করেই ছেদ পড়েছে। কোথাকার কোন কোভিড-১৯ এসে সব মিসমার করে দিয়েছে। এখন কেউ রাজনীতির আলাপ করতে চাইলে শ্রোতা পাওয়া কঠিন। কথা শুনতে হবে বিলক্ষণ, ‘আরে, রাহেন ভাই আপনার পলিটিকস, আগে তো জান বাঁচান?’

করোনাভাইরাস চীনের উহান থেকে ঢাকায় আসতে সময় নিয়েছে প্রায় তিন মাস। কে জানে, হয়তো আগেই এসেছে। কিন্তু আমাদের টনক নড়েছে ফেব্রুয়ারি পার করে। ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে প্রায় ১২৫ দিন। যেদিন প্রথম রোগী শনাক্ত হলো, তখন এটা ছিল একটা বড় সংবাদ। এখন প্রতিদিনই এটি সংবাদ। সংবাদপত্রের পাতা খুললে কিংবা টিভির নব ঘোরালে সবকিছুই করোনাময়। আগে সংবাদজুড়ে থাকত রাজনীতির হালচাল, এখন রাজনীতি গেছে অস্তাচলে।

করোনার জন্য অন্য কিছু বসে নেই। রুটিনমাফিক হানা দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান। এর আগে সিডর আর আইলা এসে কিছু এলাকা লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। আম্পান গেছে কলকাতার ওপর দিয়ে। কিন্তু তার ঝাপটায় সাতক্ষীরা-খুলনার বাঁধ ভেঙে অনেকের জন্য দুর্দশা তৈরি করেছে। ছোট এলাকা ঘিরে এই দুর্যোগ নিয়ে পুরো দেশে মাতম হয়নি। উত্তরের জনপদগুলো বন্যার জলে ভাসছে। এটা এখনো স্থানীয় বা আঞ্চলিক পর্যায়ে আছে। ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যদের মধ্যে তেমন বিকার নেই। কিন্তু করোনাভাইরাস সব এলোমেলো করে দিয়েছে। এটা কোনো স্থানীয় বা আঞ্চলিক সমস্যা নয়। সারা দুনিয়া এর কাছে কুপোকাত।

স্কুল-কলেজ বন্ধ, মিল-ফ্যাক্টরির চাকা ঘুরছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় লাটে উঠেছে, প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হচ্ছে। যাঁরা সরকারি বা করপোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তাঁরা ছাড়া সবাই আছেন আর্থিক ঝুঁকিতে। অর্থনীতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। এ সময় রাজনীতির কথা কানে মধু বর্ষণ করবে না, এটাই স্বাভাবিক।

তারপরও আড়ালে-আবডালে একটা প্রসঙ্গ ওঠে, এ দেশে রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী? আমাদের দেশে সব জায়গায় একধরনের দ্বৈরথ আছে। সত্যি সত্যি না থাকলেও মানুষ তা তৈরি করে দেয়। ঝগড়া ছাড়া বাঙালির পেটের ভাত হজম হয় না। রাজনীতিতে যাঁরা ন্যাটা, অর্থাৎ বাম, তাঁদের আছে নিজস্ব শব্দাবলি; তাঁরা ঝগড়া বলেন না, বলেন দ্বন্দ্ব। আর যাঁরা ডান হাতি, ধর্ম-কর্ম নাড়াচাড়া করেন, তাঁরা বলেন ফিতনা। তো এই ঝগড়া-দ্বন্দ্ব-ফিতনা অনেক বছর ধরেই চলে আসছে আওয়ামী লীগ আর বিএনপিকে ঘিরে। এখন রাজনীতির বাজার মন্দা। সবাই আতঙ্কে। শিগগিরই করোনার সমস্যা কাটবে, এমন পূর্বাভাস কেউ দিচ্ছে না।

এ দেশে দলীয় রাজনীতির আকাল শুরু হয়েছে অনেক আগে থেকেই। একটা কাট-অফ পয়েন্ট খুঁজে বের করলে বলা যায়, ২০০৭ সালে শুরু হয় দলীয় রাজনীতির অগস্ত্যযাত্রা। এক-এগারোর সময় দলগুলোর ভেতরকার কদাকার চেহারাটি জনসমক্ষে চলে এসেছিল। এরপর লাইনচ্যুত গাড়ি আর ট্র্যাকে উঠতে পারেনি। ২০০৯ সাল থেকে একটা দলীয় সরকার আছে বটে, তবে দলের রাজনীতি আর নেই। সরকার দল চালাচ্ছে বলেই চলছে। বিরোধী দল আছে বটে, তবে তাদের রাজনীতিটা কী, তা বোঝা যাচ্ছে না। লক্ষ্য একটা আছে, আবারও সরকারে যাওয়া। তাতে অবস্থার হেরফের হবে না। তখনো সরকার দল চালাবে।

এখন যাঁরা সরকারে আছেন, তাঁদের কথা শুনলে মনে হয় দেশ দুধের সরে ভাসছে। বিরোধীরা বলছে, নরক গুলজার। চালচিত্র একবার পাল্টে গেলে দেশটা মধুর নহরে ভাসবে না। ব্র্যান্ড বদলাবে। এই যেমন নাইকির বদলে রিবক, কিংবা পুঁইয়ের বদলে পালং। দ্রব্যগুণ তো একই। প্রশ্ন ছিল, রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী। এখন তো রাজনীতি ছাড়িয়ে মানুষ ভাবতে বসেছে, মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী?

গত কয়েক মাসে দেশীয় রাজনীতি নিয়ে কথাবার্তা না থাকলেও আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক মঞ্চের কুশীলবদের নিয়ে হইচই হয়েছে, হচ্ছে। এখন তো নরেন্দ্র মোদি-সি চিন পিং-লাদাখ নিয়ে আমাদের ফেসবুকাররা জেরবার। ওই দিকে ট্রাম্প তাঁর ড্রাম বাজিয়েই চলেছেন। এ নিয়ে কথাবার্তা হয়। কিন্তু ঘরের মাঠের খেলোয়াড়দের নিয়ে কারও তেমন আগ্রহ-উচ্ছ্বাস দেখি না। গত ১০-১২ বছরে এ দেশের রাজনীতিতে একটা গুণগত পরিবর্তন এসেছে। দলতন্ত্রের জায়গায় ঘাঁটি গেড়ে বসেছে রাষ্ট্রতন্ত্র। এখানে রাজনীতিবিদ-আমলা-বুদ্ধিজীবী-ব্যবসায়ী মিলে তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের এক রসায়ন। রাজনীতিশাস্ত্রে এর ব্যাখ্যা এখনো পুরোপুরি তৈরি হয়নি। তবে হয়ে যাবে। অনেক আগেই দুটি শব্দ আমাদের ভান্ডারে জমা পড়েছিল—মনোপলি আর অলিগার্কি। এটাই নবরূপে ফিরে এসেছে। সরকারের ব্র্যান্ড বদল হলেও রাষ্ট্রের এই চরিত্র বদলাবে না।

প্রশ্ন হলো, গতানুগতিক যে রাজনীতির সঙ্গে আমরা পরিচিত, এর ভবিষ্যৎ কী? সত্যি বলতে কি, আমি এর কোনো ভবিষ্যৎ দেখি না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৭২ সাল থেকেই এর বিবর্তন এবং বিসর্জনের পালা শুরু। এই অঞ্চলে রাজনীতির প্রসার ঘটেছিল ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের প্রশ্রয়ে কিংবা বিরোধিতায়, ১৯৪৭ সালে উপনিবেশবাদের ব্র্যান্ড বদল হয়েছিল। তাই রাজনীতিটা চালু ছিল। একাত্তরের পর চালচিত্র যে আমূল পাল্টে গেছে, তা আমরা অনেকেই বুঝতে পারিনি। রাজনীতি ছাপিয়ে রাষ্ট্র বেশি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। রাজনীতি জোয়ার তৈরি করে। তাতে আবেগ থাকে, প্রণোদনা থাকে, স্বপ্ন থাকে। কিন্তু জোয়ারের জলে আবর্জনাও থাকে অনেক। মানুষ চায় শান্তি, সমৃদ্ধি, কাজ। জিন্দাবাদ-মুর্দাবাদে তার পেট ভরে না। যাঁরা ভরপেটে আছেন, রাজনীতি তাঁদের হবি, প্যাশন। এটা বুঝতে তরুণদের অনেক সময় লেগেছে।

উনসত্তরের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে প্রজন্মটি তৈরি হয়েছিল, রাজনীতি ছিল তাদের ধ্যান-জ্ঞান। নতুন প্রজন্মের মনোজগৎ একেবারেই আলাদা, কিছুদিন আগে একটা জরিপে দেখানো হয়েছিল, তরুণদের পাঁচ ভাগের চার ভাগ রাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহী নন, এমনকি সুযোগ পেলে তাঁরা এ দেশে থাকবেন না। রাজনীতির চাহিদা না থাকলে জোগান একসময় বন্ধ হয়ে যাবে। যাঁদের চুলে-ভ্রুতে পাক ধরেছে, তাঁদের এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে।

করোনা এসে রাজনীতির চেনা জগৎটা ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। এটি আর আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। করোনা–উত্তর পৃথিবী কেমন হবে, এটিও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে রাষ্ট্র যে আরও শক্তিশালী হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

[email protected]

 

সুত্রঃ প্রথম আলো