রাকাবের ঋণ লাভের আশায় ভোগান্তির বেড়াজালে কৃষক ও উদ্যোক্তরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঋণ প্রদানের নামে কমিশন বাণিজ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ঋণ লাভের আশায় কৃষি ব্যাংকের সমস্ত শর্ত পূরণ করলেও মিলছে না ঋণ। ফলে দিনের পর দিন ব্যাংকে ঘুরতে হচ্ছে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক রাকাব রাজশাহী অঞ্চলের সাধারণ কৃষকসহ উদ্যোক্তাদের। সময়মতো ঋণ না পেয়ে কৃষি ফসল চাষসহ ছোট ও মাঝারি আকারে কৃষি ভিত্তিক খামার, মাছচাষসহ কৃষিভিত্তিক নানা ধরনের উৎপাদনমুখি কার্যক্রম করতেও পারছেন উদ্যোক্তারা।

 

  • ঋণ লাভের চরম ভোগান্তির শিকার হয়ে তাঁদের মাঝে চরম ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছে। আবার কমিশন ও ঘুষ বাণিজ্যের কারণেও নি:স্ব হতে হচ্ছে কৃষক এবং উদ্যোক্তাদের। কেউ কেউ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে লাখ টাকার মামলা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন অতিরিক্ত সুদ বাণিজ্যের কারণে। সবমিলিয়ে রাজশাহী অঞ্চলে কৃষক ও উদ্যোক্তাদের কাছে মরার ওপর খাড়ার ঘায়ে পরিণত হয়েছে রাকাব।
  •  
    রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার আমগাছী গ্রামের মসলেম উদ্দিন অভিযোগ করে জানান, চলতি বছরের জুন মাসে দুগ্ধজাত গাভীর খামার স্থাপনের জন্য রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের দুর্গাপুর শাখায় একটি আবেদন করেন। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর নিকট থেকে ২ লাখ টাকা ঋণ দানের ব্যাংক ফিসহ সকল কাগজপত্র নেয় রাকাব দুর্গাপুর শাখা। এরপর থেকে একে একে বিভিন্ন কাগজপত্র চাওয়া হয়। নেওয়া হয়, জমির কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা সে নিয়ে নেওয়া আইনজীবীর মতামতও।

 

এভাবে অন্তত দুই মাস ঘুরানো হয় মসলেম উদ্দিনকে। এরপর কাগজপত্র পাঠানো হয় কৃষি ব্যাংকের রাজশাহী জোনাল শাখায়। সেখানে আারো মাস দেড়েক ফেলে রাখা হয় ওই ফাইলটি। শেষ পর্যন্ত সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ওই ঋণ পাশ করা হয় জোনাল শাখ থেকে। কিন্তু ঋণের টাকা প্রদানের সময় বাধ সাধেন দুর্গাপুর শাখার ব্যবস্থাপক জিয়াউল হক।

মসলেম উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘আবেদনের অন্তত তিন মাস পরে ‘দুগ্ধজাত গাভীর খামার’ করার জন্য দুই লাখ লোন পাশ হলেও ম্যানেজার আজ নয়, কাল নয় করে টালবাহানা শুরু করেন। তিনি ইশারা-ইঙ্গিতে কমিশনও দাবি করেন। ওই কমিশন না দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত গাভীর খামারের ঋনের টাকা তিনি দেননি।’

  • মসলেম উদ্দিন আরো জানান, ওই ঋণ না পেয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে আবার কৃষি ব্যাংক দুর্গাপুর শাখায় তিনি যোগাযোগ করেন। এরপর গরুর খামার করার জন্য তাঁকে দুই লাখ ঋণ প্রদানের কথা বলে আবারো নানা ধরনের কাগজপত্র নেওয়া হয়। এরপর ওই ঋণ দানের নামে কৃষি ব্যাংক জোনাল ম্যানেজার মশিহুর রহমান ও দুর্গাপুর শাখা ম্যানেজার জিয়াউল হক দু’জনে মিলে আবারো নানা ধরনের টালবাহানা করতে থাকেন। একপর্যায়ে চলতি ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে তিনি মসলেম উদ্দিন ক্ষুব্ধ হয়ে ব্যাংক থেকে তার জমা দেওয়া কাগজপত্র নিয়ে চলে আসেন।

মসলেম উদ্দিন অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরেই গরু পালন করে আসছি। এই অবস্থায় কৃষি ব্যাংক দুর্গাপুর শাখা থেকে ঋণ নিয়ে মাঝারি আকারের খামার তৈরীর জন্য সকল প্রস্তুতি শেষ করে রেখেছি। অথচ দিনের পর দিন ঘুরিয়ে শেষ পর্যন্ত আমাকে আর ঋণ দেওয়া হয়নি। অন্যদের মতো টাকা দিতে না পারায় আমাকে ঋণ দেওয়া হয়নি।’

  • একই অভিযোগ করে দুর্গাপুরের পানানগর গ্রামের সাইফুল ইসলাম। তিনি জানান, ধানচাষের জন্য দেড় লাখ টাকা ঋণ লাভের আশায় তিনি ২৫ হাজার টাকা ওই শাখার এক কর্মকর্তাকে দেন। কিন্তু পরে আবারো ১০ হাজার টাকা দাবি করা হয় তার নিকট থেকে। কিন্তু ওই টাকা না দেওয়ায় পরে তাঁকে আর ঋণই দেওয়া হয়নি।

উপজেলার সিংগা গ্রামের বাসীন্দা আকবর আলী বলেন, ‘সম্প্রতি পেয়ারা বাগান করার জন্য কৃষি ব্যাংক দুর্গাপুর শাখা থেকে তিন লাখ টাকা ঋণ লাভের জন্য তিনি ওই শাখার ব্যবস্থাপকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু শাখ ব্যবস্থাপক ঋণটি পাশ করতে জোনাল ম্যানেজারসহ বিভিন্ন জায়গায় কমিশন দিতে হবে বলে তার নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। ওই টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় আকবর আলীকে ঋণ দিতেও অস্বীকার করেন শাখা ব্যবস্থাপক।

  • তবে ঋণ দানের নামে কমিশন বাণিজ্যের কথা অস্বীকার করেন শাখা ব্যবস্থাপক জিয়াউল হক। তিনি বলেন, এসব অভিযোগ ঠিক নয়। তবে আমগাছী গ্রামের মসলেম উদ্দিনের খামার না থাকায় জোনাল শাখা থেকে তাঁর ঋণটি জোনাল শাখা থেকে শেষ পর্যন্ত পাশ করা হয়নি। তাহলে আগের দুগ্ধজাত গাভী খামারের পাশকৃত ঋণটি কেন দেওয়া হলো না, জানতে চাইলে তিনি এর কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

অন্য দুই গ্রাহকের হয়রানি ও ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে জানতে চাইলে জিয়াউল হোক সেগুলোও অস্বীকার করেন।
এসব বিষয়ে জানতে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক রাজশাহী জোনাল শাখার জোনাল ম্যানেজার মশিহুর রহমান বলেন, ‘একজন গ্রাহকের খামার না থাকায় তাকে গুরু পালনের ওপর ঋণ দেওয়া হয়নি। এর বাইরে অন্য গ্রাহকদের বিষয়টি আমার জানা নাই। তবে ঋণ দানের নামে কমিশন আদায়ের বিষয়টি ঠিক নয়। তারপরেও কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অবশ্যই তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

  • এদিকে অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু দুর্গাপুরেই নয়, রাকাবের অধিকাংশ শাখাতেই ঋণদানের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। ফলে কৃষিনির্ভর রাজশাহী অঞ্চল ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছেন কৃষকরা। আবার ঋণ প্রদান করা হলেও তার উচ্চ সুদের কারণে সেগুলো পরিশোধ করতে গিয়ে সহায়-সম্বল হারাতে হচ্ছে কৃষকদের। এমন ভুক্তভোগীর সংখ্যাও হাজার হাজার।

 

একাধিক গ্রাহক অভিযোগ করে বলেন, লাখ টাকার নিচে কৃষির ঋণ নিয়ে কয়েক লাখ টাকার মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরছেন এমন কৃষকের সংখ্যাও হাজার হাজার। এসবেরই নেপথ্যে রয়েছে রাকাবের কিছু অসাধু কর্মকর্তার কমিশন ও ঘুষবাণিজ্য। কমিশন ও ঘুষ দিতে গিয়ে কখনো কখনো কৃষকরা ঋণের অর্ধেক টাকাও খোয়াচ্ছেন। যার কারণে পরে আর ওই ঋণ পরিশোথ করতে পারেছন না।

স/আর