রঙ ফর্সা ক্রিমে বাড়ছে চর্মরোগের ঝুঁকি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: বাজারে বিভিন্ন ধরনের রঙ ফর্সাকারী ক্রিম পাওয়া যায়। মূলত নারী ক্রেতাদের টার্গেট করেই এসব ক্রিম বাজারজাত করা। ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে প্রচার করা হয় চটকদার সব বিজ্ঞাপন। সেসব বিজ্ঞাপন দেখে অনেকেই এসব ক্রিম ব্যবহার করেন। তবে রঙ ফর্সাকারী এসব ক্রিম ব্যবহারে চর্ম রোগের ঝুঁকি বাড়ে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আর বিশ্লেষকদের দাবি, নারীর ব্যক্তিত্ব প্রকাশে রঙ নয়, গুণই প্রধান হাতিয়ার হওয়া উচিত।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ডা. শহীদুল্লাহ শিকদার বলেন, ‘রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া (সাইড ইফেক্ট) আছে। এগুলো ব্যবহারে অনেকের শরীরে এলার্জি হয়,কারও  আরও লাল দানা ওঠে, চুলকায় এবং ফুলে যায়। অনেক সময় ইনফেকশন হয়ে ক্ষত তৈরি করে।’

তিনি বলেন, ‘বিউটি পার্লারগুলোয় যেসব ভেষজ হারবাল ব্যবহার করা হয় সেগুলোও ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। এসব ক্রিম তৈরিতেঅনেক অবৈজ্ঞানিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। এমনকি যারা এসব ক্রিম তৈরি করেন তাদের উপাদানেরপরিমাপ ও কোনটা কোন ত্বকে লাগালে উপকার হবে সে বিষেয়ে কোনও ধারণা থাকে না। সুতরাং এগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া একটু বেশি।’

ডা. শহীদুল্লাহ শিকদার বলেন, ‘ক্রিম বিক্রির জন্য আমরা আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন দেখি। কিন্তু রঙ ফর্সা করার পরিবর্তে এসব ক্রিম ব্যবহারের পর মুখে আরও বেশি দাগ দেখা যায়। মানুষের ত্বকে কেমিক্যাল লাগানোর পর সেখানে সূর্যের আলো পড়লে বিক্রিয়ার ফলে ত্বকে দাগ পড়ে যায়। এক্ষেত্রে ক্রিমটি দেশি বা বিদেশি হওয়ার বিষয় নয়। আমরা রোগীদের মুখের দাগের কারণ খুঁজতে বলি। তবে অন্তঃসত্ত্বা বা হরমোনজনিত কারণে মুখে দাগ পড়ে। শুধু নারী নয়, পুরুষদের মুখেও বিভিন্ন কারণে দাগ হতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘প্রসাধনী সামগ্রী ব্যবহার বা রোগের কারণে মুখে দাগ হতে পারে। তাই রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার না করে রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে সহজে সুস্থ হওয়া সম্ভব। আর প্রাকৃতিক রঙই সর্বোৎকৃষ্ট রঙ। তাই ত্বক ক্ষতিগ্রস্ত করে এমন ক্রিম ব্যবহার করা উচিত নয়।’

রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘ফর্সা রঙকে উচ্চতর মর্যাদা দেওয়া একটি আরোপিত ধারণা। আর্যদের আমল থেকে শুরু করে উপনিবেশিক শাসন আমল পর্যন্ত ফর্সা বর্ণের মানুষদের আধিপত্য এই বর্ণের প্রতি অধিক আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বর্তমানে সেই আগ্রহকে আরও বাড়িয়েছে বিভিন্ন ত্বক ফর্সাকারী প্রসাধন সামগ্রীর বাণিজ্যিকীকরণ। যাদের বিজ্ঞাপন দেখে মনে হবে গায়ের রঙ ফর্সা না হলে জীবনে কোনও কিছু অর্জন করাই সম্ভব নয়। গায়ের কোনও নির্দিষ্ট রঙ এককভাবে কোনও কিছু অর্জন করতে সক্ষম নয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘কৃত্রিমভাবে রঙ নিয়ন্ত্রণ শুধু ত্বকের ক্ষতিই নয়, শারীরের নানা ধরনের ক্ষতি করতে পারে। এই বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্পষ্টভাবে সতর্ক করেছে।’

এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের (ঢামেক) চর্ম ও যৌন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাসুদা খাতুন বলেন, ‘বাজারে প্রচলিত রঙ ফর্সাকারী ক্রিমগুলো একেবারেই ব্যবহার করা উচিত নয়। আমরা প্রতিদিন যে রোগী দেখি এরমধ্যে কমপক্ষে ২-৪ জন রোগী থাকে যারা রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার করে সমস্যায় পড়েছেন। বিশেষ করে গৌরী ক্রিম, পাকিস্তানি ক্রিমগুলো ব্যবহার করে মেয়েরা বেশি বিপদে পড়ছেন।’

তিনি বলেন, ‘রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহারে গায়ের রঙ খুব কমই ফর্সা হয়। অনেক সময় এই ক্রিম ব্যবহার বন্ধ করে দিলেও ত্বকে নানা সমস্যা দেখা দেয়। ত্বকের কোনও অংশ সাদা আবার কোনও অংশ কালো হয়ে যায়। এই ক্রিম ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করে দিলে পরবর্তীতে গায়ের রঙ আরও কালো হয়ে যেতে পারে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা রোগীকে সুস্থ থাকতে কাউন্সেলিং করি। স্থানীয়ভাবে তৈরি ক্রিম যদি কেউ দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে তাহলে তার হাই প্রেসার ও ডায়াবেটিস হতে পারে।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের চর্ম ও যৌন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. তুষার কান্তি সিকদার বলেন, ‘রঙ ফর্সাকারী ক্রিম ব্যবহার খুবই পরিচিত একটি বিষয়। কিছু কোম্পানির ক্রিম বিশ্বব্যাপী চলছে। এসব ক্রিম ব্যবহার সব সময় খারাপ হয় বিষয়টি তেমন নয়। যাদের ত্বক সেনসিটিভ তাদের জন্য ক্ষতিকর। ত্বক সেনসিটিভ না হলে অনেকের জন্য উপকারী।’

রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সংগঠন জেন্ডার ইন মিডিয়া ফোরামের সদস্য নাসিমুন আরা হক (মিনু) বলেন, ‘আমরা মানুষকে বিচার করি রূপ ও রঙ দিয়ে। ফর্সা হলে চাকরি  হবে, বিয়ে হবে, ফেলোশিপ হবে- সবই হবে এমন সব বিজ্ঞাপন আমরা গণমাধ্যমে দেখি। এই ধরনের চিন্তা ভাবনা বর্ণবাদী। রঙ নয়, মানুষের গুণ দিয়ে আমরা তাকে বিচার করবো। রঙয়ের বিষয়টি মাথায় ঢুকিয়ে মেয়েদের মনটাকে ছোট করে ফেলা হয়। এসব কারণে আমরা রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিরুদ্ধে সচেতন করতে আন্দোলন করি।’

তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে এই ক্রিম ব্যবহার করে কেউ ফর্সাও হয় না। রঙ ফর্সার এই আচরণটাই ভুল। সব মানুষকে ফর্সা কেন হতে হবে? এই চিন্তাটাই আমাদের সব আগে আসা দরকার।’

 

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন