‘সংবাদকর্মীদের হাত কেন বারবার টার্গেট’

রকি বাহিনীর সন্ত্রাসীদের থামাবে কে?

মহাদেবপুর প্রতিনিধি :

সাংবাদিক এমদাদুল হক দুলু (৫২)। দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে নওগাঁর বদলগাছী ও মহাদেবপুর উপজেলায় করছেন গ্রামীণ সাংবাদিকতা। এলাকার সমস্যা-সম্ভাবনা ও প্রভাবশালীদের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে মূলধারার সংবাদমাধ্যমে নানা চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় ব্যাপক আলোচনায় এসেছেন। মহাদেবপুরের বিশেষ একটি বাহিনীর কুকীর্তি নিয়ে ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশের জেরে সশস্ত্র হামলায় সন্ত্রাসীদের রডের আঘাতে তার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। শুধু এমদাদুল হক দুলু নয়, এ বাহিনীর সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছেন অনেকেই। ক্ষমতাসীন দলের নাম ভাঙ্গিয়ে বছরের পর বছর চলা এই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের লাগাম টেনে ধরতে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’র (র‌্যাব) মহাপরিচালকসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দ্রুত বাহিনীটির সকল সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবী জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ২৪ আগস্ট মহাদেবপুর সদর থেকে পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে বাড়ি ফেরার পথে দুপুর ১২টার দিকে মহাদেবপুর-মাতাজিহাট সড়কের সারাসন মোড়ে দুই মোটরসাইকেলযোগে পাঁচজন সন্ত্রাসী পথরোধ করে জানতে চায় আপনি কি সাংবাদিক? আপনার মোবাইলে কি ০১৭২৭৮৬৪৩১৫ নম্বর থেকে ফোন এসেছিল? নাম পরিচয় নিশ্চিত হয়েই দুলুর ওপর হত্যার উদ্দেশ্যে তারা আক্রমণ করে। রডের আঘাতে তার ডান হাত ভেঙ্গে যায়। এসময় দুলুর চিৎকারে গ্রামবাসি ছুটে আসলে সন্ত্রাসীরা পালিয়ে যায়। পরে মোবাইলফোনের সূত্র ধরে উপজেলা সদরের জাহাঙ্গীরপুর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের লাইব্রেরীয়ান মেহেদী হাসান সাজুর নাম উল্লেখ করে পাঁচজনকে আসামী দিয়ে থানায় এজাহার দায়ের করেন। এরপর মামলাটি রেকর্ড করা নিয়ে শুরু হয় পুলিশের নানা তালবাহানা। অবশেষে সাংবাদিকদের চাপে মামলাটি রেকর্ড করে পুলিশ। কয়েক মাস ধরে দায়সারা তদন্ত করে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

মামলার বাদী আদালতে নারাজি আবেদন করলে শুনানি শেষে বিজ্ঞ আদালত মামলাটির তদন্তভার দেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) নওগাঁর ওপর। দীর্ঘ তদন্তে তিন বছর আট মাস পর নওগাঁ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিমের ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকির ঠিকাদারী কাজের ম্যানেজার এমরান আলী শামীমকে আটক করে পিবিআই। মামলার অপর আসামী মেহেদী হাসান সাজু এমপির ছেলে রকি ও তার ভাগ্নে সদর ইউপি চেয়ারম্যান সাঈদ হাসান তরফদার শাকিলের বিশ্বস্ত। ঘটনার দিন স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডে আয়োজিত দাদন ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মানববন্ধনে শাকিলের আমন্ত্রণে সংবাদ সংগ্রহের জন্য অংশগ্রহণ করেন দুলু। সাংবাদিক দুলুকে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করার উদ্দেশ্য ছিল তাকে হত্যা পরিকল্পনার অংশবিশেষ! এনিয়ে সেসময় সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। আত্রাই নদীর বালুমহাল ও উপজেলার রাইগাঁ ইউপির’র কৃষ্ণপুর গ্রামের সড়ক নির্মাণ কাজে অনিয়মের সংবাদ প্রকাশ করায় তার ওপর সন্ত্রাসী আক্রমণ করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০২১ সালের তিন মার্চ দুপুর ১২টার দিকে আত্রাই নদীর বালুমহাল ইজারাকে কেন্দ্র করে উপজেলা সদরের কলেজ পাড়া এলাকায় রকি বাহিনীর সন্ত্রাসী হামলার শিকান হন বালু ব্যবসায়ী ও জেলার প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার কামাল হোসেন। এ হামলায় তার পা ভেঙে যায় এবং তিনি গুরুত্বর আহত হন। মৃত্যুর সাথে পাঞ্জালড়ে রাজশাহীতে কয়েক মাস কিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন কামাল। তার স্ত্রী উপজেলা পরিষদের সাবেক মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান মর্জিনা আক্তার বাদী হয়ে থানায় মামলা দায়ের করতে গেলে পুলিশ তালবাহানা শুরু করে। প্রভাবশালীদের চাপে সেই মামলা রেকর্ড করেনি থানা পুলিশ। এরপর ভুক্তভোগীর স্ত্রী বাদী হয়ে নওগাঁর সিনিয়ন জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আমলী আদালত-৩ এ সাতজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামী করে একটি মামলা দায়ের করেন। আদালতের আদেশে মামলাটি রেকর্ড করে পুলিশ। মামলা নম্বর জিআর-২৪৮/২০২১ (মহা:)।

জেলা সদরের একটি হোটলে সংবাদ সম্মেলন চলাকালে মহাদেবপুরের বালু ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার যুবলীগ নেতা মাসুদুর রহমান মাসুদের ওপর হামলা চালায় এ বাহিনীর সদস্যরা। বালুমহাল নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করায় দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি এমএ সালাম এর ওপর হামলা চালিয়ে তার হাত ভেঙে দেয় বালু ব্যবসায়ীরা। এরপর আর তিনি সাংবাদিকতায় ফিরে আসতে পারেননি। এদিকে, ২০২২ সালের আগস্ট মাসে জেলার পত্নীতলা উপজেলার উত্তর মামুদপুর গ্রামের নার্সারি ব্যবসায়ী মিঠুন চৌধুরী ও তার স্ত্রীকে মহাদেবপুরের একটি টর্চার সেলে আটকে রেখে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন এবং তার স্ত্রীর মাথার চুল কেটে দেয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পেলে বিষয়টি টক অফ দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়। এরপর পুলিশ ও র‌্যাব অভিযান চালিয়ে কয়েকজনকে আটক করে। টর্চার সেল নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে মূল অভিযুক্তের সাথে স্থানীয় এমপির ছেলে রকির ছবি প্রচার হলে এলাকায় ব্যাপক তোলপাড় শুরু হয়। পত্রিকায় টর্চার সেলের হোতা হিসেবে রকিকে ইঙ্গিত করে একাধিক খবর ছাপা হয়।

অপরদিকে, গত তিন জুলাই উপজেলার উত্তর ঈশ্বরপুর গ্রামের মৃত সামছুর রহমানের ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানের বাড়িতে প্রকাশ্য দিবালোকে আইনের লোক পরিচয়ে হামলা, মারপিট করে লুটপাটের অভিযোগ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে গত ছয় জুলাই থানায় একটি মামলা রেকর্ড করে নওগাঁ কোর্টে পাঠায় পুলিশ। এতে রকি বাহিনীর দু’জন সদস্যসহ পাঁচ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১০-১২ জনকে আসামী করা হয়েছে। এছাড়াও জমি দখলের উদ্দেশ্যে উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ড এলাকার ডিসব্যবসায়ী রুমেলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর ও ওলামালীগ নেতা আশেক এলাহীর ওপর দফায় দফায় সন্ত্রাসী হামলা চালানোরও অভিযোগ রয়েছে রকি বাহিনীর বিরুদ্ধে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৪ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে কলস মার্কায় ছলিম উদ্দীন তরফদার সেলিম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তার ছেলে সাকলাইন মাহমুদ রকি গড়ে তোলেন এই সন্ত্রাসী বাহিনী। এর সদস্য সংখ্যা শতাধিক। বাহিনীটির প্রধান রকি। সেকেন্ড ইন কমান্ড তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স ও তাদের তরফদার ট্রেডার্স এর ম্যানেজার এমরান আলী শামীম। রকির অধীনে মহাদেবপুর ও বদলগাছীতে ২-৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে; আর শামীমের নিয়ন্ত্রণে নওগাঁ পৌর এলাকায় আছে ১-২টি কিশোর গ্যাং। তারা মহাদেবপুর, বদলগীসহ জেলা সদরে টেন্ডারবাজি, আত্রাই নদীর বালুমহাল নিয়ন্ত্রণ, চাঁদাবাজি, টর্চার সেল পরিচালনা, জমি দখলসহ নানা সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে বছরের পর বছর। রকি বাহিনীর সদস্যরা ক্ষমতাসীন দলের পদ-পদবী ব্যবহার করায় পুলিশ ও প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করতে সাহস করে না। কখনও কখনও এ বাহিনীর সাধারণ সদস্যরা আইনি জটিলতায় পরলেও এমপির প্রভাব খাটিয়ে তারা বারবার পার পেয়ে যায়।

তবে বাহিনী প্রধান সবসময় থাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মদদে চলা এ বাহিনীটি আবার কোথাও কোথাও এমপি বাহিনী বা সেলিম বাহিনী নামেও পরিচিত। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এ বাহিনীর সন্ত্রাসীদের হামলার শিকারের পর থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ উল্টো বাদীর বিরুদ্ধে অবস্থান করেন। আদালতে মামলা করলেও তারা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে নানা কূটকৌশলে বাদী এবং তার লোকজনদের ঘায়েল করেন। অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় এদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস করে না কেউই। ফলে দিন দিন তারা অপ্রতিরুদ্ধ হয়ে উঠেছে। এই সন্ত্রাসী কার্যক্রমের লাগাম টেনে ধরতে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন’র (র‌্যাব) মহাপরিচালকসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ভুক্তভোগীরা। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দ্রুত রকি বাহিনীর সকল সদস্যদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবী জানিয়েছেন স্থানীয় সচেতন মহল।

সাংবাদিক এমদাদুল হক দুলুর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নওগাঁ পিবিআইয়ের এসআই শফিকুল ইসলাম জানান, সাংবাদিক ওপর সন্ত্রাসী হামলার হোতা ছিলেন এমরান আলী শামীম। তথ্যপ্রমাণ পেয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ‘সংবাদকর্মীদের হাত কেন বারবার টার্গেট’ প্রশ্নের উত্তরে নওগাঁ জেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি কায়েস উদ্দিন জানান, সাংবাদিকদের হাত টার্গেট তো আজকে নতুন নয়। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করলে যাদের স্বার্থে আঘাত লাগে তারা আক্রমণ করবে, আঘাত হানবে, হাত ভেঙে দিবে এটা গতানুগতিক। সাংবাদিকরা যত নির্যাতিত হয়েছে, হত্যার শিকার হয়েছে এ দেশে কোনো বিচার হয়নি। আর বিচার না হওয়াতে সন্ত্রাসীদের ক্ষমতা বেড়ে গেছে।

সঠিক বিচার হলে বারবার আক্রমণ হতো না বলেও জানান তিনি। র‌্যাব-৫, রাজশাহীর সিপিসি-৩, জয়পুরহাট ক্যাম্পের (ভারপ্রাপ্ত) কোম্পানি কমান্ডার সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলাম জানান, নতুন যোগদান করেছেন, বিষয়টি তার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখবেন। এ ব্যাপারে মুঠোফোনে জানতে চাইলে নওগাঁর পুলিশ সুপার মুহাম্মদ রাশিদুল হক বক্তব্য দিতে রাজি হননি। অভিযোগের বিষয়ে সাকলাইন মাহমুদ রকি জানান, তার কোনো বাহিনী নেই। এনিয়ে কিছুই জানেন না। বাহিনী চালানোর অভিয়োগ ভিত্তিহীন।