যে বাঁচায় তাকে মারছি কেন?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে বেশি হারে বৃক্ষরোপণের জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। গত ৫ জুন পরিবেশ দিবসে ‘জাতীয় বৃক্ষরোপণ অভিযান ও বৃক্ষমেলা-২০২২’ উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে তিনি এ আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বন-বনানী ঘেরা, সবুজ শ্যামল আমাদের এ দেশ। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, খাদ্য, জ্বালানি, বাসস্থান, আসবাবপত্রের চাহিদা পূরণ এবং নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও বনাঞ্চলের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে পরিবেশ, প্রতিবেশ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, ভূমির ক্ষয়রোধ, মরুময়তা হ্রাস, কার্বন আধার সৃষ্টি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, সাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সর্বোপরি টেকসই উন্নয়নে বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকার দেশব্যাপী ব্যাপক বনায়ন কার্যক্রমগ্রহণের ফলে দেশে বৃক্ষাচ্ছাদনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাষ্ট্রপতি বৃক্ষরোপণ অভিযানকে সফল ও টেকসই রূপ দিতে হলে জনগণকে দেশের আবহাওয়া ও মাটির উপযোগী বনজ, ফলজ ও ঔষধি বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ধ করার কথাও বলেন ।

 বৃক্ষ বিলুপ্ত হলে আমার আমাদের জীবনযাপনের শ্বাসকার্য চালাতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাব না, অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরে যাবে এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করে হলেও আমাদের বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ করা দরকার। কারণ আমরা করোনাকালীন সময়ে দেখেছি অক্সিজেন কতটা প্রয়োজন বা অক্সিজেনের অভাব কতটা অসহায় করে তোলে?

প্রকৃতপক্ষে ১৫ জুলাই থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর বৃক্ষরোপণের উপযুক্ত সময়। সুতরাং বৃক্ষরোপণের আরেকটি ক্যালেন্ডার পার করতে যাচ্ছে দেশ। আমাদের কতটুকু লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছি আমরা?

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের প্রস্তুতকৃত তালিকায় বলা হয়েছে, এশিয়ায় সবচেয়ে বনাঞ্চল কম পাকিস্তানে। এ দেশটির আয়তনের মাত্র ১ দশমিক ৯ শতাংশ বনাঞ্চল। বাংলাদেশের স্থান তৃতীয়। জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, প্রতিটি রাষ্ট্রে মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকতে হবে। অথচ এ দেশের ১১ পয়েন্ট ২ শতাংশ মাত্র বনভূমি। দেশে গত ১৮ বছরে উজাড় হয়ে গেছে প্রায় তিন লাখ ৭৮ হাজার একর বনভূমি, যা মোট বনভূমির প্রাায় ৮ ভাগ। ফলে জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।

গাছ আমাদের পরম বন্ধু। গাছের প্রয়োজনীয়তা সকল ভাবেই। অক্সিজেন, ছায়া, পুষ্টি ও সৌন্দর্য ছাড়াও অকাজের গাছটিও জ্বালানি হিসেবে মানুষের উপকারে আসে। শিল্পের নানা উপাদান হিসেবে গাছ ও তার ফল ব্যবহার হয়। গাছের সীমাহীন গুরুত্ব থাকলেও আমাদের বনগুলোর অবস্থা আজ হতাশাজনক। বিখ্যাত সুন্দরবন আমাদের গর্ব। কিন্তু এখন আর সুন্দরবনের সেই সৌন্দর্য নেই।

ভাওয়ালের শাল-গজারীর বন ধ্বংসের পথে। মধুপুর আর সিলেটের বনের অবস্থাও ভালো নয়। পাবর্ত্য জেলাগুলোর র্নিবিচারে বৃক্ষ নিধনের ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে পাহাড়ধস ও নদী ভাঙনের ঘটনা, ধ্বংস হচ্ছে বসতবাড়ি, প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে পার্বত্য বনাঞ্চলে প্রবেশ করে বন উজাড় করে বসতবাড়ি গড়ে তুলেছে। তারা জ্বালানি ও জীবন নির্বাহের জন্য কী পরিমাণ বৃক্ষনিধন করছে তা কল্পনার বাইরে। অথচ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মোকাবিলায় বনাঞ্চল গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে বর্ষাকালেও তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে প্রায় প্রতিদিনই। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ফলে প্রকৃতিও বিরূপ আচরণ করে যার পরিণাম হল বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান কারণ বৃক্ষ নিধন। বনভূমি উজাড়ের ফলে বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ছে আর কমছে অক্সিজেনের পরিমাণ। অতিরিক্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের বরফ এবং বাড়ছে সমুদ্রের উচ্চতা। ধেয়ে আসছে জলোচ্ছ্বাস, তলিয়ে যাচ্ছে নিম্নাঞ্চল। নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।

বিশেষ করে কৃষিক্ষেত্রে এর প্রভাব মারাত্মকভাবে পড়েছে। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, ঝড়, বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এখন আমাদের নিত্যসঙ্গী। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় ফণীর ছোবল থেকে আমাদের অনেকাংশে রক্ষা করেছে সুন্দরবন। এ থেকে সহজেই বোঝা যাচ্ছে, বনভূমির গুরুত্ব কতটা। পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা দেশের একটি বাংলাদেশ। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ), ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক যৌথ গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, পরিবেশ রক্ষা সূচকে বিশ্বের ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৭।

‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স (ইপিআই) ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে পরিবেশ রক্ষায় বাংলাদেশের এমন করুণ চিত্র উঠে এসেছে। ইয়েল ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল আর্থ সায়েন্স ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক ডব্লিউইএফ-এর সহায়তায় গবেষণাটি করেছে। গবেষণার ভিত্তিতে প্রতি দুই বছর পর পরিবেশ রক্ষায় বিভিন্ন দেশের অবস্থান তুলে ধরতে বৈশ্বিক এ সূচক প্রকাশ করা হয়। এর আগে ২০২০ ও ২০১৮ সালের তালিকায় বাংলাদেশ ১৮০ দেশের মধ্যে ছিল ১৭৯তম। ২০১৬ সালের তালিকায় ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৭৩। আর ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯।

মোট ১০টি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে ইপিআই সূচক তৈরি করা হয়। এগুলো হলো বায়ুর মান, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন, ক্ষতিকর ভারী ধাতু, জীববৈচিত্র্য ও বাসস্থান, বনায়ন, মৎস্যসম্পদ, জলবায়ু ও জ্বালানি, বায়ুদূষণ, পানিসম্পদ এবং কৃষি। ১০টি বিষয়ের প্রতিটিতে প্রাপ্ত নম্বর গড় করে বিভিন্ন দেশের অবস্থানের ক্রমতালিকা বা ইপিআই র‌্যাংকিং তৈরি করা হয়। এবারের তালিকায় বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ২৩ দশমিক ১০।

বনভূমি বাড়াতে সরকারের নেওয়া সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ হলো ‘টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল)’ প্রকল্প যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলবে। ২২ সালের শেষের দিকে আমরা তার কতটুকু পাচ্ছি। সরকারের কোন উদ্যোগই সফল হবে না আমরা যদি নিজ নিজ অবস্থান থেকে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করি। সত্যিকার অর্থে বৃক্ষরোপণের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে গাছ লাগাতে হবে নিজের স্বার্থে ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণে। সেই সাথে শুধু ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে বিদেশি গাছ না লাগিয়ে আমাদের ঐতিহ্যের ধারক বাহক দেশি আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু গাছ লাগাতে উৎসাহী করতে হবে। কারণ এসব বিদেশি গাছের ভিড়ে এতে শুধু দেশি ফলদগাছই হারাচ্ছে তা নয়, পরিবেশ প্রকৃতির ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। দেশের জীববৈচিত্রের জন্যও দেখা দিচ্ছে মারাত্মক হুমকি। মানব দেহের জন্যও বিদেশি গাছ ক্ষতিকর বলে মনে করছেন প্রাণীবিদ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞরা।

বৃক্ষ বিলুপ্ত হলে আমার আমাদের জীবন-যাপনের শ্বাসকার্য চালাতে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাব না, অক্সিজেনের অভাবে মানুষ মরে যাবে এই চরম সত্যটি উপলব্ধি করে হলেও আমাদের বেশি বেশি বৃক্ষরোপণ করা দরকার। কারণ আমরা করোনাকালীন সময়ে দেখেছি অক্সিজেন কতটা প্রয়োজন বা অক্সিজেনের অভাব কতটা অসহায় করে তোলে? এই একমাত্র কারণটি ছাড়াও বৃক্ষ আমাদের কতটা প্রয়োজ্য তা অযোগ্য ছাড়া যোগ্যদের বোঝাতে হবে বলে আমার মনে হয় না। দেশের সকল সেক্টর আজ উন্নয়নের পথে। আমরা যত উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করব, পরিবেশের জন্য বৃক্ষরোপন তত বেশি করতে হবে। কারণ ভারসাম্য রক্ষা না হলে পরিবেশ বিলুপ্ত হয়ে পরবে।

এখন পরিবেশ সচেতনতা যেমন বেড়েছে, তেমনই পরিবেশ ধ্বংসের হারও বেড়েছে। মানুষ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ব্যাপারে আগের তুলনায় বেশি আগ্রহী হয়েছে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে পরিবেশেরও ক্ষতি করছে। যেমন রাতারগুলের পরিবেশ কিছুদিন আগেও ভালো ছিল। পর্যটন করতে গিয়ে সেই পরিবেশ নষ্ট করা হচ্ছে। এই যে একদল মানুষ পরিবেশ রক্ষার জন্য সংঘবদ্ধ হচ্ছে এবং আরেক দল সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে পরিবেশের ক্ষতি করছে, তাদের মধ্যে ঐক্য দরকার। কারণ উভয় পক্ষ পরিবেশ ভালোবাসে। তাহলে পরিবেশ আন্দোলনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সহজ হবে।

দেশ চালানোর জন্য সরকার দরকার। সরকারের জন্য রাজনৈতিক দল দরকার। রাজনৈতিক দল টিকিয়ে রাখতে প্রতিদিন বিভিন্ন কর্মসূচি ও আন্দোলন চলছে। চলছে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। এখানে বিতর্ক রয়েছে কারণ এক একটি রাজনৈতিক দল এক একটি লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের কোন বির্তক নেই। সেই বিষয়ে আলোচনা এবছর কম হয়েছে বলেই মনে হয়। পরিবেশ রক্ষায় সকলের সম্মিলিত ভূমিকা রাখা জরুরি। পরিবেশ দিবসে সকল দল একসাথে বৃক্ষরোপণের কর্মসূচি নেওয়াটা কি উচিত ছিল না?

অন্তত পরিবেশ রক্ষায় একটি সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করে আপনারা প্রমাণ করুন দেশের স্বার্থে আপনারা এক। পরিবেশের ভারমাস্য রক্ষা না হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পড়বে দেশ। তাই পরিবেশ রক্ষায় সচেতন হোন। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন জোরদার করুন। পরিবেশ রক্ষা দেশপ্রেমেরই বর্হিপ্রকাশ।

লেখক: সাংবাদিক।
gopalodikari1213@gmail.com

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ