যে কারণে জাপানে করোনায় মৃত্যুহার খুবই কম

জাপানে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা এত কম কেন? এ ধরনের প্রশ্ন খারাপ শোনালেও এ নিয়ে এখন নানা তত্ত্ব আলোচনায় উঠে আসছে।

কেউ বলছেন এর পেছনে রয়েছে জাপানিদের মনমানসিকতা ও তাদের সংস্কৃতি। আবার কারও মত হলো– জাপানিদের ইমিউনিটি অসাধারণ।


টোকিও ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক তাতসুহিকো কোদামা জাপানের রোগীদের ওপর প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন। তার ধারণা, জাপানে হয়তো আগে কোভিড হয়েছে। কোভিড-১৯ নয়, তবে একই ধরনের জীবাণুর অতীত সংক্রমণ জাপানের মানুষকে ‘ঐতিহাসিক ইমিউনিটি’ দিয়েছে।

তার ব্যাখ্যা এ রকম– মানুষের শরীরে যখন কোনো ভাইরাস ঢুকে, তখন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে। আর তখন শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করে এবং ওই অ্যান্টিবডি ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে।

অ্যান্টিবডি হয় দুই ধরনের– আইজিএম ও আইজিজি। আক্রমণকারী ভাইরাস নতুন না পুরনো তার ওপর নির্ভর করে কোন ধরনের অ্যান্টিবডি সে ক্ষেত্রে কাজ করবে।

তিনি বলেন, কোনো ভাইরাস যদি প্রথমবার আক্রমণ করে, তখন প্রথমে সক্রিয় হয়ে ওঠে আইজিএম অ্যান্টিবডি, পরবর্তী সময় সক্রিয় হয় আইজিজি। আর কেউ যদি এমন ভাইরাসের শিকার হয়, যে ভাইরাস শরীরে আগেও আক্রমণ করেছিল, তখন সে ক্ষেত্রে ইমিউন ব্যবস্থা পরিচিত ভাইরাসের মোকাবেলায় দ্রুত সক্রিয় হয়ে আইজিজি অ্যান্টিবডি ব্যবহার করে।

এ পর্যন্ত জাপানে করোনায় মারা গেছে ৯৭৭ জন। কোভিড-১৯ রোগে মৃত্যুর হার ওই অঞ্চলে জাপানেই যে সর্বনিম্ন তা কিন্তু নয়। মৃত্যুর খুবই কম হার নিয়ে ওই এলাকায় বরং গর্ব করার মতো দেশগুলো হলো- দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং ও ভিয়েতনাম।

কিন্তু এ বছরের শুরুর দিকে জাপানে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল দেশটিতে ওই সময়ে সার্বিকভাবে গড় মৃতের হারের চেয়েও কম। এপ্রিল মাসে সম্ভবত কোভিডের কারণে টোকিওতে গড় মৃত্যুর হার ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি।

তার পরও বছরের প্রথম দিকের হিসাবের ওপর ভিত্তি করে অনুমান করা হচ্ছে– জাপানে এ বছর মোট মৃত্যুর সংখ্যা ২০১৯ সালের চেয়ে কম।

এটি খুবই বিস্ময়কর। কারণ কোভিড ১৯-এ মৃত্যুর হার বাড়ার অনেক শঙ্কা জাপানের ছিল। অথচ জাপান কিন্তু তার প্রতিবেশী দেশগুলোর মতো সর্বশক্তি দিয়ে এই ভাইরাস মোকাবেলায় নামেনি।

ফেব্রুয়ারি মাসে উহানে করোনাভাইরাসের প্রকোপ যখন তুঙ্গে, শহরটির হাসপাতালগুলো রোগীর ভিড়ে যখন উপচে পড়েছে, চীন থেকে ভ্রমণের ব্যাপারে সারা বিশ্ব দেয়াল তুলে দিয়েছে, তখনও জাপান তার সীমান্ত বন্ধ করেনি।

ভাইরাস যখন দ্রুত ছড়াচ্ছে, তখন অল্প দিনের মধ্যেই এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে কোভিডে মারা যাচ্ছে মূলত বয়স্করা। জনসমাগম থেকে এই ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি এবং আক্রান্তের কাছাকাছি বেশি সময় কাটালে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপক আশঙ্কা।

জাপানের ক্ষেত্রে এর সব রয়েছে; অর্থাৎ মাথা পিছু বয়স্ক মানুষের সংখ্যা পৃথিবীর যে কোনো দেশের চেয়ে জাপানে বেশি। জাপানের বড় বড় শহরে ব্যাপকভাবে মানুষের ভিড়ে ঠাসা।

বিশ্বের অন্যতম মেগাসিটি টোকিওতেই বাস করে তিন কোটি ৭০ লাখ মানুষ এবং বেশিরভাগ মানুষের জন্য চলাচলের একমাত্র বাহন হলো ভিড়ে ঠাসা শহরের ট্রেন পরিসেবা।

সেই সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ ছিল– টেস্ট, টেস্ট, আর টেস্ট। এখন পর্যন্ত জাপানে পরীক্ষা করা হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ৪৮ হাজার মানুষকে, যা জাপানের জনসংখ্যার শূন্য দশমিক ২৭ শতাংশ।

ইউরোপের দেশগুলোতে যে মাত্রায় লকডাউন দেয়া হয়েছে, জাপানে সেভাবে কোনো লকডাউন হয়নি। শুধু এপ্রিলের গোড়ায় জাপান সরকার একবার জরুরি অবস্থা জারি করেছিল।

ঘরের ভেতর থাকার জন্য কোনো বাধ্যতামূলক নির্দেশ জারি হয়নি। শুধু অনুরোধ জানানো হয়েছিল এবং সেটি ছিল মানুষের স্বেচ্ছানির্ভর। জরুরি নয় এমন দোকানপাট ও ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল, কিন্তু তা না মানলে কোনো আইনি ব্যবস্থা বা শাস্তির বিধান রাখা হয়নি।

তা হলে অন্য অনেক দেশের মতো সীমান্ত বন্ধ না করে, কঠোর লকডাউন না দিয়ে, ব্যাপক হারে পরীক্ষা না চালিয়ে আর কড়া কোয়ারেন্টিন না দিয়েও জাপান কীভাবে মৃত্যুর সংখ্যা এত কম রাখতে পারল?

জাপানে প্রথম কোভিড ধরা পড়ার ৫ মাস পরও জাপানে করোনা শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ২০ হাজারের নিচে, মৃতের সংখ্যা ১ হাজারের কম।

জাপানে জরুরি অবস্থাও তুলে নেয়া হয়েছে এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রা দ্রুত ফিরে এসেছে।

জাপানে বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের ওপর চালানো টেস্টিং এবং টোকিওতে সরকার এ পর্যন্ত যেসব মানুষকে অপরিকল্পিতভাবে পরীক্ষা করেছে, সেসব পরীক্ষার ফলে দেখা গেছে খু্ব কমসংখ্যক মানুষের মধ্যে এই জীবাণু রয়েছে।

দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গত মাসের শেষের দিকে যখন জরুরি অবস্থা তুলে নেয়ার কথা ঘোষণা করেন, তখন তিনি বেশ গর্বের সঙ্গে এটিকে ‘জাপান মডেল’ হিসেবে উল্লেখ করেন এবং বলেন, অন্য দেশগুলোকে জাপান থেকে শেখা উচিত।

জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী তারো আসো বলেন, জাপানিদের ‘আদর্শ আচরণের’ কারণে করোনা তাণ্ডব চালাতে পারেনি।

 

সুত্রঃ যুগান্তর