যে কাজ সবার, সে কাজ কারও নয়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশে বহুদিন ধরে English for Today নাম দিয়ে একটা সিরিজ জাতীয় শিক্ষাক্রমে চালু আছে। মাঝে মাঝে এ সিরিজটাকে ঘষামাজা করা হয় এর জৌলুস বৃদ্ধি করার জন্য।

কিন্তু যারা এ কাজে নিরন্তর পরিশ্রম ও মেধা ব্যয় করে যাচ্ছেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেছেন- বাস্তবে এটা পণ্ডশ্রমে পর্যবসিত হয়েছে। এ সিরিজের ইংরেজি যারা পড়ে এবং পড়ায়, তারা আনন্দের আদানপ্রদান করতে পুরাপুরি ব্যর্থ হয়। এককথায় এ পাঠচর্চা ইংরেজি অক্ষর (ABC = প্রাথমিক জ্ঞান) শিক্ষা করাতেও ব্যর্থ।

আমি এত জোর দিয়ে বলছি এজন্য যে, আমি নিজে একজন ভুক্তভোগী, কারণ আমি এ পাঠচর্চার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। অবিলম্বে এ সর্বনাশা সিরিজ দেশ থেকে সমূলে উৎপাটন করতে হবে।

English for Today জাতির মেধা নাশকারী উপাদান ছাড়া আর কিছু নয়। ইংরেজির বৈরী চাপে ছাত্রছাত্রীদের সহজাত মেধা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হতে বসেছে। আমরা প্রায়ই বিজ্ঞজনদের Body Language শব্দটা ব্যবহার করতে শুনি। এর দ্বারা একটা মানুষের মনের অবস্থার বহিঃপ্রকাশকে বোঝানো হয়। তাকিয়ে দেখুন, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর দিকে।

এই বিদেশি ভাষাটা কীভাবে শুষে নিয়েছে শিক্ষা ও তারুণ্যের তেজ। তাদের বিবর্ণ মুখয়াভব, ক্লেশিত অঙ্গভঙ্গি মুহূর্তেই শ্রেণিকক্ষের কাঙ্ক্ষিত আভা নিষ্প্রভ করে দেয়। এই হল আমাদের আগামী দিনের শিক্ষিত জাতি, যাদের প্রাণরস নিঃশেষিত হচ্ছে বিদেশি কুশাসনে নয় বরং একটা বিদেশি ভাষা শিক্ষার জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন বিষয় হল গণিত, যা কষতে অন্তর্জাত মেধার প্রয়োজন পড়ে; আর পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ বিষয় হল ভাষা, যা শেখার জন্য শুধু লোকবসতিময় স্থানে বসবাসই যথেষ্ট; যেমন আমাদের অশিক্ষিত শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে অনর্গল ইংরেজি বলতে শেখে। তারা শূন্যস্থান পূরণ করে ভাষাটা শেখে না।

ইংরেজি একটা ভাষা। যে কোনো ভাষার প্রধান দাবি হল, ভাবের লেনদেন। আমাদের দেশে ভাষার প্রধান দাবিটাকে একদম নির্বাসনে পাঠিয়ে পুরো জাতিকে শেকসপিয়র বানানোর কল্পবিলাসের কলা চাষ চলছে। ভুললে চলবে না- বাঙালিমাত্রই রবীন্দ্রনাথ নয়।

একটা বিদেশি ভাষা সমগ্র দেশকে শিক্ষা দেয়া হবে নিজ ভাষার একটা অক্ষর ব্যবহার না করেই। এ যেন Gulliver’s Travels-এর সেই গল্পটা- ছাদ থেকে বাড়ি নির্মাণ শুরু হয়ে ভূগর্ভস্থ ভিত্তিতে শেষ করার কথাই মনে করিয়ে দেয়। অবিলম্বে এ আজগুবি প্রজেক্ট বাতিল করা হোক।

মাত্রাধিক Unit/Lesson সংবলিত বইগুলো অর্ধপূর্ণ, অপূর্ণ, কুসংক্ষেপিত, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে রুগ্ণ গদ্যে জটাকীর্ণ, যা Reading for Pleasure-এর শাশ্বত সুখপাঠ্যতাকে দুষ্পাঠ্যতায় ঠেলে দিয়েছে। অথচ গ্রামের দরিদ্র পিতামাতার কষ্টার্জিত অর্থ কোচিংয়ের জন্য খরচ হচ্ছে কোনোরকম ফল লাভ ছাড়াই। এসব তথাকথিত Communicative English নামধারী দুর্বল রচনাসম্ভার শিক্ষার্থীদের কার্যত সব বিষয়ে পাঠবিমুখ করে তুলছে। এখানে ভাষার চারটি দক্ষতার কথা দাবি করা হয়েছে- Reading, Writing, Speaking ও Listening. এ দাবিটা মাতৃভাষাভাষীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যদিও প্রথম দুটি দক্ষতা ছাড়াও ভাষা সফল। যদি কোনো ব্যক্তি চারটি দক্ষতায় দক্ষ হয়, তবে সে নিজ ভাষায় স্বাবলম্বী বলে বিবেচিত। কিন্তু নিজ ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে কিংবা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ভিনদেশি গ্রন্থপাঠের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

সেক্ষেত্রে ভাষার পঞ্চম দক্ষতা অর্জন আবশ্যক, আর তা হল Translation. এই সত্যিটাকে অপাঙ্ক্তেয় রেখে ইংরেজি শিক্ষার চাপ শুধু নিজ ভাষা নয় বরং শিক্ষা নামের সর্বমুখী শক্তিটাকেই অপ্রাপনীয় করে তুলছে। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন ওঠা বাঞ্ছনীয় যে, যারা দেশ চালাচ্ছেন- তারা ছাত্রজীবনে Communicative English সিরিজ পড়েননি বলে কি বিদেশিদের সঙ্গে communication করতে পারছেন না; কিংবা এ যুগের শিক্ষিতদের চেয়ে কম ইংরেজি জানেন?

দেশের মঙ্গল চিন্তা করা যে কোনো নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য এবং অধিকার। তাই এতক্ষণ দেশে ইংরেজি শিক্ষার অবস্থা অভিজ্ঞতালব্ধ দৃষ্টিকোণ থেকে বলার চেষ্টা করেছি। অতি গুরুত্বপূর্ণ ভাষার তকমা পাওয়া ইংরেজি আজ এদেশে সত্যিই অতি হীনাবস্থায় পতিত। লক্ষ করুন, প্রথম শ্রেণি থেকে স্নাতক পর্যন্ত ইংরেজি একটি আবশ্যিক বিষয়, অথচ স্নাতক শ্রেণিতে এসেও ইংরেজি বড় হাতের অক্ষর লেখায় পাঁচ নম্বর।

এখান থেকে সহজেই বোঝা যায়, ‘অতিরিক্ত সবই খারাপ’- এ কথাটির চিরকালীন প্রতিভাস সম্ভবত অম্লান। যে কাজ সবার, সে কাজ কারও নয়। তাই ১৬ কোটি মানুষকে ইংরেজি শেখাতে চাইলে ১% মানুষও ইংরেজি শিখবে না, এটাই স্বাভাবিক।

গ্রামাঞ্চলের কলেজগুলোয় (শহরের কলেজগুলোকেও খুব এগিয়ে রাখছি না) ৯৫% শিক্ষার্থী ভর্তি হয় বড়জোর ২০ থেকে ৫০টি ইংরেজি শব্দের পুঁজি নিয়ে। তাদের এই নগণ্য পুঁজিও আবার অর্থবৈকল্যমুক্ত নয়। অথচ তাদের জন্য প্রণীত বই ও প্রশ্ন কাঠামো ইংরেজিতে দক্ষ ব্যক্তিরও স্বেদবিন্দু ঝরাবে নিঃসন্দেহে। ২০১৫ সালের উচ্চমাধ্যমিক ২য় বর্ষের জন্য ইংরেজি ২য় পত্রের যে প্রশ্ন কাঠামো নির্ধারণ করা হয়েছিল, তা এককথায় উপরোল্লিখিত শতাংশ সূচিতে শিক্ষার্থীর জন্য দুঃস্পর্শ। এ বই পাঠবৈরী ছাড়া আর কিছু নয়।

Reading Based এই প্রশ্ন কাঠামোয় শিক্ষার্থীদের পাস নম্বর তোলা প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া ২য় বর্ষ শুরু হয় মে মাসের শেষের দিকে, তারপর রোজা, পূজা, দুই ঈদ, প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষার বন্ধ বাদে ক্লাসের জন্য যে কদিন পাওয়া যায়, তা ২য় বর্ষের ইংরেজি সিলেবাসের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ শেষ করার জন্যও যথেষ্ট নয়।

অতএব বই, প্রশ্ন কাঠামো ও সময়সূচি অতিসত্বর পরিবর্তনের পাশাপাশি আরও কিছু সংস্কার অপরিহার্য। বুঝতে হবে ইংরেজি একটি ভাষা, গণিত নয়। এটা বলার জন্য, কষার জন্য নয়। তাই বই এবং পরীক্ষা উভয়ই যেন সহজ ও উপভোগ্য হয়, সেরকম পদ্ধতি অনুসরণ করাই কাম্য।

‘যাহা কহিয়াছি, তাহাতে হর্ষাঞ্চিত নহি।

ভ্রুকুঞ্চিতদের বাক্যবানেও প্রস্তুত রহিয়াছি, অহত হইব না।

দেশকে ভালোবাসিয়াছি, বলিয়াছি মনের কথা।

কর্তাব্যক্তি, যাহার ইচ্ছায় শিক্ষা পদ্ধতি নবপরিণতি লভিতে পারে,

ডাকিলে সাড়া দিব সবিস্তারে বলিবার তরে।’

প্রভাষক, বোয়ালী কলেজ, সখিপুর, টাঙ্গাইল

mrmukul70@gmail.com