যেভাবে দেওয়া হয় নোবেল পুরস্কার

নোবেল পুরস্কার বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও দামি পুরস্কার। বিশ্বমানব কল্যাণে সফল ও অসাধারণ উদ্ভাবন-আবিষ্কারের মতো মৌলিক অবদানের জন্য ১৯০১ সাল নারী, পুরুষ ও প্রতিষ্ঠানকে এই পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

আগামীকাল (৪ অক্টোবর) থেকেই ঘোষণা করা হবে চলতি বছরের নোবেল বিজয়ীদের নাম। করোনা মহামারির কারণে এ বছর সমাজে বিজ্ঞানের ভূমিকা নিয়ে আগ্রহ আরও বেড়েছে।

পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও চিকিৎসাবিজ্ঞানে কারা পুরস্কার পাচ্ছে-সবার নজর এখন সেদিকেই। আলোচনায় আছে বিশ্বশান্তির বিষয়টিও।

নোবেল পুরস্কার যেভাবে শুরু

নোবেল পুরস্কার প্রবর্তন করেন সুইডিস বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবক আলফ্রেড নোবেল। আলফ্রেড তার জীবদ্দশায় ডিনামাইটসহ ৩৫৫টি উদ্ভাবন করেন।

এসবের মাধ্যমে প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন তিনি। অর্জিত সব অর্থ দান করে ১৮৯৫ সালে একটি উইল করেন তিনি।

যার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সাল থেকে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য এবং শান্তি-এই পাঁচটি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার প্রচলন করা হয় এবং পরে অর্থনীতি বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হয় ১৯৬৯ সালে।

কারা পায় পুরস্কার

আলফ্রেড নোবেলের উইল মতে, পুরস্কার তাদেরই দিতে হবে, ‘যারা আন্তঃরাষ্ট্র সম্পর্ক, সেনাবাহিনীর সংকোচন বা অবলোপন ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ ও সেরাটা মানবজাতিকে উপহার দেবে।’

এই সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ তাদের নিজেদের কিংবা অন্যের নাম জমা দিতে পারে।

কোন দেশ থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়

দুটি জায়গা থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তার মধ্যে শুধু নোবেল শান্তি পুরস্কারটি নরওয়ের অসলো থেকে আর বাকিগুলো দেওয়া হয় সুইডেনের স্টকহোম থেকে।

কারা সিদ্ধান্ত নেয়

কাকে পুরস্কার দেওয়া হবে-সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি নামে নরওয়ের পার্লামেন্ট নিয়োজিত পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি।

এর সদস্যরা প্রায়ই পার্লামেন্টের অবসরপ্রাপ্ত রাজনীতিক। কিন্তু সবসময় এমনটি হবে তেমনটা নয়। বর্তমান কমিটির প্রধান হিসাবে আছেন একজন আইনজীবী। একজন বুদ্ধিজীবীও আছেন।

যেভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়

পুরস্কারের জন্য প্রথমে মনোনয়নপত্র জমা নেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়া শেষ হয় প্রতি বছর ৩১ জানুয়ারি। ফেব্রুয়ারিতে প্রথম বৈঠকে বসে নোবেল কমিটি।

বৈঠকে সব মনোনয়নপত্র আলোচনা করা হয় এবং প্রার্থীদের একটি তালিকা করা হয়। এরপর প্রত্যেক প্রার্থীকে মূল্যায়ন ও আলাদা আলাদাভাবে স্থায়ী উপদেষ্টা ও অন্যান্য পেশাজীবী দলের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা হয়।

কাদের মনোনীত করা হয়

নোবেল কমিটির সম্পূর্ণ আলোচনা সর্বদাই গোপন রাখা হয়। এমনকি গোপন রাখা হয় মনোনীত প্রার্থীদের তালিকাও। ‘৫০ বছরের গোপনীয়তা নিয়ম’ অনুযায়ী, পঞ্চাশ বছর পর মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়।

এবারের ৩২৯ জন প্রার্থীর তালিকাটিও নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউটে সুরক্ষিত আছে। ভল্টের ভেতর সারিবদ্ধভাবে রাখা ফোল্ডারগুলোতে সবুজ ফোল্ডারে রয়েছে মনোনয়নপ্রাপ্তদের তালিকা এবং নীল ফোল্ডারে রয়েছে সংশ্লিষ্ট চিঠিপত্র।

সর্বশেষ প্রকাশিত তালিকাটি ছিল নোবেলের ১৯৭১ সালের আসরের। সে বছর নোবেল জিতেছিলেন পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডট। বিংশ শতকের স্নায়ুযুদ্ধের সময় পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যকার উত্তেজনা কমিয়ে আনতে তার নেওয়া পদক্ষেপের জন্য এ পুরস্কার পান তিনি।

বিজয়ীদের কী দেওয়া হয়

প্রত্যেক বিজয়ীকে একটি পদক দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালের আগ পর্যন্ত নোবেল বিজয়ীরা যে পদক পেতেন, সেটা ছিল ২৩ ক্যারেট স্বর্ণের।

এরপর থেকে ১৮ ক্যারেট সবুজ স্বর্ণের ধাতবের ওপর ২৪ ক্যারেট স্বর্ণের প্রলেপ দেওয়া পদক দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া একটি সনদ ও মোটা অঙ্কের অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়।

এই অর্থের পরিমাণ এক কোটি সুইডিশ ক্রোনার বা ১১ লাখ ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় অঙ্কটা প্রায় আট কোটি টাকা।

একটি ভুল বোঝাবুঝি

আলফ্রেড ডিনামাইটসহ বেশ কিছু জীবনধ্বংসকারী বিস্ফোরক আবিষ্কার করেন। ফলে লোকেরা তাকে সেই সময় খুব একটা ভালো চোখে দেখত না।

এমনকি ১৮৮৮ সালের ১২ এপ্রিল যখন তার বড় ভাই লুডভিগ বেড়াতে গিয়ে ফ্রান্সের কান শহরে মারা যান তখন ফরাসি দৈনিক ‘লা ফিগারো’ প্রতিবেদনে লেখে, ‘মৃত্যুর সওদাগর গতকাল কানে মারা গেছেন।

তিনি হচ্ছেন নোবেল, ডিনামাইটের উদ্ভাবক।’ সেই খবরে এও বলা হয় কিভাবে লোকেদের দ্রুত সময় হত্যা করা যায়, সেই পদ্ধতি আবিষ্কার করে নোবেল ধনকুবের হয়েছেন।

অনেকের ধারণা এই নেতিবাচক সংবাদটি নোবেলকে খুব নাড়া দেয় এবং এর প্রতিক্রিয়াতেই তিনি মানুষের কল্যাণে কিছু করতে আগ্রহী হন।

ফলে তিনি তার সব সম্পদ একটি ট্রাস্টের অধীন রেখে সেটা থেকে মানবকল্যাণে যারা অবদান রাখবেন তাদের পুরস্কৃত করার ঘোষণা দিয়ে যান।

মরণোত্তর পুরস্কার

১৯৭৪ সাল থেকে নোবেল ফাউন্ডেশন এক ঘোষণায় জানায়, এখন থেকে মরণোত্তর পুরস্কার নাও দেওয়া হতে পারে। তবে মনোনীত কোনো ব্যক্তি অক্টোবরে পুরস্কার ঘোষণা ও ডিসেম্বরে পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের মাঝামাঝি যেকোনো সময় মারা গেলে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে।

এই পরিবর্তন কার্যকর হওয়ার আগে দুজন মরণোত্তর নোবেল পেয়েছিলেন। তারা হচ্ছেন ডাগ হ্যামার্স্কোল্ড ১৯৬১ সালে শান্তিতে ও এরিক আক্সেল কারফেল্ড ১৯৩১ সালে সাহিত্যে।

শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন থুনবার্গ

এবারের শান্তি পুরস্কারটি জিতে নিতে পারেন জলবায়ু ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সুইস কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ। পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কপ-২৬ শীর্ষ জলবায়ু সম্মেলন। সম্মেলন সামনে রেখে নোবেল কমিটি বৈশ্বিক উষ্ণতার ওপর গুরুত্ব দিতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নোবেল পুরস্কার পর্যবেক্ষকদের মতে, বিশ্বব্যাপী চলমান যে সমস্যার দিকে কমিটির সদস্যরা বিশেষ নজর দেন, তার ওপর নির্ভর করে পুরস্কারের বিজয়ী। নরওয়েতে পাঁচ সদস্যের কমিটি প্রতিবার বিজয়ী নির্বাচন করেন।

শান্তি পুরস্কারের দাবিদার মার্কেল

গণতন্ত্র এবং বাকস্বাধীনতা ইস্যুও বিবেচনায় নিতে পারে নোবেল কমিটি। ফলে সম্ভাব্য বিজয়ীর এ তালিকায় রয়েছেন বেলারুশের নির্বাসিত বিরোধীদলীয় নেতা ভিয়াতলানা সিকানুস্কায়া ও কারাবন্দি রুশ রাজনীতিক আলেক্সাই নাভালনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ভ্যাকসিন বিতরণ সংস্থা কোভ্যাক্সের মতো প্রতিষ্ঠান এবার বিজয়ী হতে পারে বলেও ধারণা করছেন অনেকে। এবারের শান্তি পুরস্কার পাওয়ার দাবি রাখেন বিদায়ী জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, হয়তো তিনি কোনো বিদ্রোহী কিংবা প্রকৃত কোনো চিন্তক নন, কিন্তু নীতিগতভাবে তিনি একাই একটা বিশাল প্রতিষ্ঠানের মতো।

প্রতি ২০ পুরুষ বিজয়ীর বিপরীতে ১ জন নারী

নোবেল পুরস্কার নিয়ে প্রচলিত বিতর্কগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নারীদের মূল্যায়ন না করার অভিযোগ। গত কয়েক দশকে নারী বিজয়ীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্বি পেলেও তাদের শতকরা হার এখনো এক অঙ্কের, মাত্র ৬%। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হলেও ৯৬০ বিজয়ীর তালিকায় নারীর সংখ্যা মাত্র ৫৭।

অর্থাৎ প্রতি ২০ জন পুরুষের বিপরীতে গড়ে একজন নারী। সমালোচকরা বলছেন, নোবেল কমিটি পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে মেয়েদের অবজ্ঞা করে।

হিটলারকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন

এডলফ হিটলারের মতো একজন কুখ্যাত স্বৈরশাসককেও শান্তিতে নোবেল পদকের জন্য মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল।

১৯৩৯ সালে সুইডেনের একজন বিচারক তাকে মনোয়ন দিয়েছিলেন। যদিও তিনি পরে দাবি করেন এটা তিনি নিছক মজা করেই করেছেন।

কিন্তু তিনি ছাড়া আর কেউ এটাতে মজাদার কিছুই খুঁজে পাননি। ফলে পরবর্তীতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে তাকে এই নমিনেশন তুলে নিতে হয়েছিল।

এ ছাড়াও পরবর্তীতে ১৯৪৫ এবং ১৯৪৮ সালে যুদ্ধবাজ সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনকে মনোনয়ন দেওয়া নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়।

 

সূত্রঃ যুগান্তর