যেভাবে জিয়ার নাম অপসারণ করা হলো

সুপ্রিয় পাঠক, এটা জেনে নিশ্চয়ই আনন্দিত হবেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বালটিমুর শহরের একটি সড়ক থেকে গত ৯ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমানের নাম সরিয়ে ফেলা হয়েছে। পূর্বে বালটিমুরের মেয়র মি. ব্রেনডন স্কট যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির চাপে এবং তাদের দেওয়া মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে সেই শহরের একটি সড়কের নাম রেখেছিলেন ‘জিয়া ওয়ে’। খবরটি পেয়ে অবাক এবং মর্মাহত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের দফতর  সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ, যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের নেতারা, বিশেষ করে দফতর সম্পাদক মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী এই ভেবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে অন্য দেশের একজন সামরিক স্বৈরশাসকের নামে রাস্তা হতে পারে না। তারা প্রতিজ্ঞা করেন এই নাম অপসারণ করার সব চেষ্টাই করতে হবে।

তিনি ঢাকায় বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সেটার ধারাবাহিকতায় সপ্তাহ তিনেক আগে এক দিন ড. সেলিম মাহমুদ এবং ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া এবং আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক উপকমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট কুমার দেবল আমার বাড়ি এলে আমরা কৌশল নির্ধারণ করি। আমার ওপর দায়িত্ব প্রদান করা হয় আমাদের হাই কোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যেসব নিন্দামূলক মন্তব্য করেছে, সেগুলো সংক্ষিপ্ত আকারে বালটিমুর মেয়রের কাছে পাঠানোর। আমি সেই মতে বাল্টিমুরের মেয়র সাহেবকে যা লিখলাম তা হলো এই যে, ২০১১ সালের মার্চ মাসে হাই কোর্ট বিভাগ এক মামলার রায়ে জিয়াউর রহমানকে ঠান্ডা মাথার খুনি বলে উল্লেখ করে। আমার লেখায় আমি আরও উল্লেখ করি যে, পঞ্চম এবং সপ্তম সংশোধনী মামলার রায়ে আমাদের সর্বোচ্চ আদালতের আপিল এবং হাই কোর্ট বিভাগ জিয়া, মোশতাক এবং বিচারপতি সায়েম এই তিনজনকে অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক পন্থায় বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখল করার দায়ে শুধু ভর্ৎসনাই করেনি বরং তাদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলেও আখ্যায়িত করেছে। রায়ে বলা হয়েছে, এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের এবং অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা দখলের জন্য মামলা হওয়া উচিত এবং জনগণ যেন সর্বকাল তাদের ঘৃণার চোখে দেখে। উচ্চ আদালতসমূহ আরও বলেছে, জিয়া গং তাদের শপথ ভঙ্গ করে আগ্নেয়াস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখল করে দেশে সংবিধানের এবং গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। আইন অনুযায়ী জিয়া গংদের কোনো যোগ্যতা ছিল না দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার, যা করে তারা শপথ ভঙ্গের অপরাধে অপরাধী। বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার ভূমিকার কথা উল্লেখ করে আমি উল্লেখ করি যে, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দেওয়া সাক্ষ্যগুলো নিরঙ্কুশভাবে প্রমাণ করে যে, জাতির জনকের হত্যায় জিয়ার প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল, যে কথা কি না জিয়ার অতি আপনজন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার পুস্তক ‘চ্যালেঞ্জ অব ডেভেলপমেন্ট’-এ পরিষ্কার করেই লিখেছেন। এ ছাড়াও ১৯৭৬ সালের ২ আগস্ট লন্ডনে এক টেলিভিশন টকশোতে দুজন খুনি যথা কর্নেল ফারুক এবং রশিদ অকপটেই প্রকাশ করেছে যে, তারা জাতির পিতার হত্যা পরিকল্পনা নিয়ে তৎকালীন দ্বিতীয় সেনাপ্রধান জিয়ার সঙ্গে আলাপ করেছে এবং জিয়া তাদের পুলিশে না দিয়ে বরং উৎসাহিত করে তখনই রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ করেছিল। তদুপরি ১৯৭৬ সালের ৩০ মে লন্ডনের বহুল প্রচারিত ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় এক পূর্ণ পৃষ্ঠা লিখনীর মাধ্যমে সাজাপ্রাপ্ত খুনি কর্নেল ফারুক জাতির পিতা হত্যায় জিয়ার ভূমিকার বিশদভাবে উল্লেখ করে। তাছাড়াও প্রথমে মোশতাক এবং পরে জিয়া খুনিদের বিচারের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রথমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি আইন প্রণয়ন করেছিল, যার কারণে জাতির পিতা হত্যা মামলা ২১ বছর করা যায়নি। পরে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে সে আইন বাতিল করার পর বিচার হয়। তদুপরি জিয়া জাতির পিতা হত্যাকারীদের পদোন্নতি দিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে লোভনীয় পদে পদায়ন করেছে, যে ঘটনাসমূহ নিন্ডিদ্রভাবে প্রমাণ করে যে, জিয়া জাতির পিতা হত্যায় জড়িত ছিল, যে কথা হাই কোর্টে সাক্ষী দেওয়ার সময় বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন নাগরিক সাংবাদিক লরেন্স লিপসুলজও বলেছেন। অন্যান্য মামলার রায়েও হাই কোর্ট উল্লেখ করেছে যে, জিয়া সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধাকে প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বস্তুত হত্যা করেছে। এমতাবস্থায় আব্রাহাম লিংকনের দেশে, প্রধান বিচারপতি জন মার্শালের দেশে অন্য দেশের একজন অস্ত্রের জোরে ক্ষমতা দখলদারের নামে, যাকে সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত একজন খুনি, একজন দেশদ্রোহী, গণতন্ত্রের এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ব্যাহতকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে, তার নামে কোনো সড়ক থাকতে পারে না। অন্যদিকে সিদ্দিকী সাহেবসহ যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ নেতারাও বহু স্বাক্ষর সংবলিত একটি প্রতিবাদলিপি পাঠালে বাল্টিমুরের মেয়র সাহেব দুটি প্রতিবাদলিপি এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত সমস্ত তথ্য-উপাত্ত, যথা হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের রায়, পর্যালোচনা করে আমাদের সঙ্গে জুম প্ল্যাটফরমে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিলে আমরা কজনা, যথা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, শামীম চৌধুরী, ড. প্রদীপ রঞ্জন কর, মঞ্জুর চৌধুরী, অ্যাড. শাহ মোহাম্মদ বখতিয়ার, এম এ করিম জাহাঙ্গীর, জালাল উদ্দিন জলিল, টি মোল্লা, রুমানা আক্তার, শহিদুল ইসলাম ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে যোগদান করেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক (এই প্রবন্ধের লেখক) এবং সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ এ আরাফাত। ওই জুম মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে আমাদের দাবি উত্থাপন করি। বাল্টিমুর মেয়রের পক্ষে ছিলেন ক্যাটলিনা রদ্রিগেজ, ডেভিড লিয়াম প্রমুখ। ওই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে সবার কথা ও মতামত শোনার পর মেয়রের পক্ষে পরিষ্কার ঘোষণা দেওয়া হয় যে, ‘জিয়া ওয়ে’ নামে যে সড়কটির নামকরণ করা হয়েছিল, তা মুছে দেওয়া হলো এবং সড়কের দেয়াল থেকে ‘জিয়া ওয়ে’ নামের নেমপ্লেটও বিনা বিলম্বে তুলে নেওয়া হবে।

ওই সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তির জয়। কেননা আদালত কর্তৃক ঘোষিত একজন খুনি, বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলদার স্বৈরশাসকের নামে পৃথিবীর কোনো গণতান্ত্রিক দেশের রাস্তার নাম থাকতে পারে না। এই মহৎ কাজে যারা অংশ নিয়েছেন তারা সবাই সাধুবাদ পাওয়ার দাবিদার।

 

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন