যুগে যুগে নবী-রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য

মানুষের হিদায়াতের জন্য মহান আল্লাহ যেসব মহামানবকে মনোনীত করেছেন, তাঁদের ‘নবী-রাসুল’ বলা হয়। যেসব নবীর প্রতি কিতাব নাজিল করা হয়েছে এবং নতুন শরিয়ত দেওয়া হয়েছে, তাঁদের রাসুল বলা হয়। আর প্রত্যেক পয়গম্বরকেই নবী বলা হয়, তাঁকে নতুন কিতাব ও নতুন শরিয়ত দেওয়া হোক বা না হোক। (শরহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যা : ১৩)। যেসব নবীর প্রতি কিতাব নাজিল হয়নি তাঁরা আগের রাসুলদের প্রচারিত শরিয়তের অনুসরণ করে দ্বিনের কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন।

কোরআনে উল্লিখিত নবী-রাসুল : পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল প্রেরিত হয়েছেন তাঁদের ২৫ জনের নাম কোরআনে উল্লেখ রয়েছে। যথা—আদম (আ.), নুহ (আ.), ইদরিস (আ.), হুদ (আ.), সালিহ (আ.), ইবরাহিম (আ.), ইসমাইল (আ.), ইসহাক (আ.), লুত (আ.), ইয়াকুব (আ.), ইউসুফ (আ.), শুয়াইব (আ.), মুসা (আ.), হারুন (আ.), ইলিয়াস (আ.), ইয়াসা (আ.), দাউদ (আ.), সুলাইমান (আ.), আইয়ুব (আ.), ইউনুস (আ.), জুলকিফল (আ.), জাকারিয়া (আ.), ইয়াহইয়া (আ.), ঈসা (আ.), মুহাম্মদ (সা.)। সর্বপ্রথম নবী আদম (আ.)। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ (সা.)।

নবী-রাসুলের সংখ্যা : আবু জর গিফারি (রা.) বলেন, একবার আমি জিজ্ঞাসা করলাম, হে আল্লাহর রাসুল! নবীদের সংখ্যা কত? জবাবে তিনি বলেন, এক লাখ ২৪ হাজার। তন্মধ্যে ৩১৩, অন্য বর্ণনা মতে ৩১৫ জন রাসুল। (মিরকাত, মোল্লা আলী কারি : ১/৫৭)

চেষ্টা করে নবী-রাসুল হওয়া যায় না : নবুয়ত ও রিসালাত একমাত্র আল্লাহ তাআলা দান করেন। কারো চেষ্টা ও পরিশ্রমের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ ফেরেশতাদের মধ্য থেকে মনোনীত করেন বাণীবাহক এবং মানুষের মধ্য থেকেও। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সম্যক দ্রষ্টা।’ (সুরা : হজ, আয়াত : ৭৫)

অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘আল্লাহ তাঁর রিসালাতের ভার কার ওপর অর্পণ করবেন তা তিনিই ভালো জানেন।’ (সুরা : আনআম, আয়াত : ১২৪)

 

নবী-রাসুল প্রেরণের অন্যতম তিন কারণ :

(১)  মানুষ সৎপথে চলার যোগ্যতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে প্রবৃত্তির তাড়নায়, শয়তানের প্ররোচনায় ও পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে সাধারণত অসৎ পথে পরিচালিত হয়। তাই মহান আল্লাহ তাদের সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন।

(২)  আল্লাহর সত্তা অসীম, কিন্তু মানুষের জ্ঞান-বুদ্ধি সসীম। এ সসীম জ্ঞান দ্বারা অসীম আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলির পরিচয় লাভ করা সম্ভব নয়। তাই মহান আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন। তাঁদের দিয়েছেন দিকনির্দেশনারূপে বহু কিতাব ও সহিফা। নবী-রাসুল এবং তাঁদের প্রতি নাজিলকৃত কিতাবের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহকে চিনতে পারে। তাঁর হুকুম-আহকাম জানতে পারে।

(৩)  ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান এবং বুদ্ধি-বিবেচনালব্ধ জ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রয়েছে নানা ধরনের ভুলভ্রান্তির আশঙ্কা। কিন্তু নবী-রাসুলদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অহিভিত্তিক জ্ঞানে ভুলভ্রান্তির কোনো আশঙ্কা নেই। তাই মহান আল্লাহ নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন।

নবী-রাসুলরা নিষ্পাপ : নবী-রাসুল সবাই নিষ্পাপ। তাঁরা শয়তান ও নফসের কুমন্ত্রণা থেকে পবিত্র। এক মুহূর্তের জন্যও তাঁরা আল্লাহর হিফাজতের বাইরে থাকেন না। তাঁরা সগিরা ও কবিরা উভয় প্রকার গুনাহ থেকে পবিত্র। নবুয়তপ্রাপ্তির আগেও পবিত্র, পরেও পবিত্র। তাঁরা উম্মতের সর্বোত্তম আদর্শ। আল্লাহ যা হুকুম করেন তা-ই তাঁরা বলেন ও করেন। নিজ খেয়াল-খুশিমতো অথবা স্বীয় স্বার্থের জন্য কখনো কিছু করেননি। ইরশাদ হয়েছে, ‘তিনি মনগড়া কথাও বলেন না।  এটা তো অহি, যা তাঁর প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’ (সুরা : নাজম,   আয়াত : ৩-৪)। নবী-রাসুলরা সত্যবাদী, ন্যায়পরায়ণ ও তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন ছিলেন। তাঁরা সবাই আল্লাহর বান্দা।

তাঁদের কাউকে আল্লাহ বা আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করা শিরক। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা বলে আল্লাহই মারিয়াম তনয় মসিহ (ঈসা), তারা তো কুফরি করেছে। অথচ মসিহ বলেছিল, হে বনি ইসরাঈল! তোমরা আমার ও তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর ইবাদত করো। কেউ আল্লাহর সঙ্গে শরিক করলে আল্লাহ অবশ্যই তার জন্য জান্নাত হারাম করবেন। আর তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম। জালিমদের কোনো সাহায্যকারী নেই। যারা বলে আল্লাহ তো তিনের মধ্যে একজন। তারা তো কুফরিই করেছে, যদিও আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো ইলাহ নেই। তারা যা বলে তা থেকে নিবৃত্ত না হলে তাদের মধ্যে যারা কুফরি করেছে তাদের ওপর অবশ্যই মর্মন্তুদ শাস্তি আপতিত হবে। (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৭২-৭৩)

নবী-রাসুলরা মানুষ : নবী-রাসুল সবাই মানবজাতির অন্তর্ভুক্ত। আর মানবজাতির সৃষ্টির মূল উপাদান মাটি। ফেরেশতা জাতির সৃষ্টির মূল উপাদান নুর। সে হিসেবে কোনো নবী বা রাসুলই নুরের তৈরি নন। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৯৫৫)

নবী-রাসুলদের দোষারোপ করা পাপ : নবী-রাসুলদের প্রতি ঈমান আনা ফরজ। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা বলো! … আমরা তাঁর রাসুলদের মধ্যে কোনো তারতম্য করি না …।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮৫)

নবী-রাসুলদের ইহতিরাম ও সম্মান করা ফরজ। তাঁদের অপমান-অপদস্থ করা, দোষারোপ করা কুফরি। (খোলাসাতুল ফাতাওয়া : ৪/৩৮৬)

নবীরা কবরে জীবিত : আমাদের নবীজি (সা.)-সহ সব নবী-রাসুল কবরে সশরীরে জীবিত আছেন। এই জীবনকে বারজাখি জীবন বলা হয়। নবী-রাসুলদের এই বারজাখি জীবনের রূপ স্বতন্ত্র এবং দুনিয়ার জীবনের সদৃশ। (মুসনাদু আবি ইয়ালা : ৬/১৪৭, ইলাউস সুনান : ১০/৪৯৪, ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত : ১/২১৪)

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ