যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে কেবল তাদেরই দোষারোপ করলে হবে না

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে কেবল তাদেরই দোষারোপ করলে হবে না। এর মূল উদঘাটন করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে, কেন তারা এই ভুল পথে গেল। এ মন্তব্য করেছেন খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও। তিনি বলেছেন, জঙ্গিবাদ আমাদের দেশের না। আমাদের সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় ‍কৃষ্টির সঙ্গে জঙ্গিবাদ মেলে না। এটা পুরোপুরি আমদানি করা বিষয়। তবে দেশে জঙ্গিবাদ আছে এবং কতিপয় ব্যক্তি এটা করছে।
আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও। তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে খ্রিস্টানদের সর্বোচ্চ সম্মাননা পোপ মনোনীত হওয়ার জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন। তারও আগে তিনি ক্যাথলিক যাজকদের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘পলিউম’ পেয়েছেন ।

বুধবার (১২ অক্টোবর) সকাল ৯ টায় আর্চবিশপ হাউসে গিয়ে দেখা গেল, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা ভিড় করেছেন। তারা প্যাট্রিক ডি রোজারিও-র সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। প্রচণ্ড ব্যস্ততার মাঝেও কাউকেই তিনি নিরাশ করেননি। উপস্থিত সবার সঙ্গে কথা বলেছেন। ছবিও তুলেছেন হাসিমুখে। এরই মাঝে বাংলা ট্রিবিউনকেও সময় দেন।

 

আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও বর্তমান সময়ের জঙ্গিবাদ নিয়ে বললেন তার ভাবনার কথা। পোপ পদে তার মনোনয়নকে বাংলাদেশের মানুষের জন্য একটি স্বীকৃতি হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেন, মনোনয়ন পাওয়ার সংবাদ শুনে প্রথমে তিনি বিচলিত ছিলেন। তবে এখন বাংলাদেশ নিয়ে এবং দেশের মানুষ নিয়ে কথা বলার সুযোগ পাবেন বলে স্বস্তি অনুভব করছেন।

 

দেশের জঙ্গিবাদ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথমেই প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেন, ‘জঙ্গিবাদ আমাদের দেশের নয়। আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। তারপরেও বর্তমান পরিস্থিতি অস্বীকার করা যাবে না। যদিও সরকার খুব অল্প সময়ের মধ্যে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে এনেছে।’

 

তিনি বলেন,‘এ নিয়ে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সঙ্গে বিশেষ করে সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা হয়েছে। কথা বলেছি ফরিদউদ্দীন মাসউদের সঙ্গেও। আমরা আমাদের মতামত দিয়েছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আমাদের কথা শুনেছেন। কী করে বিভিন্ন ধর্মের লোকেরা তাদের আপন আপন আঙ্গিকে এই জঙ্গিদের বিষয়ে নিজ ধর্মে শিক্ষা দিতে পারেন, সেটা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কোনও ধর্মই যে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে না এটা মানুষকে বোঝাতে হবে।’

 

একই সঙ্গে প্যাট্রিক ডি রোজারিও জঙ্গিবাদে যারা জড়িয়েছে তাদের দোষারোপ করতে কিছুটা অনীহা প্রকাশ করে বলেন,‘যারা জঙ্গিবাদে জড়িয়েছে কেবল তাদেরকেই দোষারোপ করলে হবে না। এর মূল উদঘাটন করতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে কেন তারা এই ভুল পথে গেল।’

 

আর্চবিশপ বলেন, ‘‘আমাদের পোপ মহোদয় কয়েকমাস আগে বলেছেন, ‘ইসলাম ধর্মকে জঙ্গিবাদের জন্য দোষারোপ করা ঠিক নয়।’ এরমধ্যে বিভিন্ন বৈষম্য রয়েছে। সামাজিক কারণ, পারিবারিক গঠনের অভাব, ধর্মকে ব্যবহার-এসব কারণগুলো বের করতে হবে ও বিশ্লেষণ করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, মানবতা শিক্ষার দৈন্যতার অভাবেই বাংলাদেশে আজ জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।’’
তিনি আরও বলেন, ‘গুলশান হামলা, শোলাকিয়া হামলার আগে আমরা ভেবেছিলাম, এসব ছেলেমেয়েরা আসছে গ্রামে-গঞ্জের সাধারণ মাদ্রাসা-স্কুল থেকে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, তারা বিত্তবান পরিবারের উচ্চশিক্ষিত সন্তান। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা ছিল, তা বদলে গেছে। কাজেই বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবতে হবে।’

 

তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা ঠিক না। এই শিক্ষা ব্যবস্থা বোকা ও জ্ঞানী বানাচ্ছে, কিন্তু মানুষ বানাচ্ছে না।ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা থাকবে। কিন্তু মানুষ মানুষকে ঘৃণা করবে কেন।সবাই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি-এটা যদি বিশ্বাস করি, তাহলেতো ধর্ম আমাকে অনুমতি দেয়নি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিকে মেরে ফেলার। একজন মানুষের কোনও অধিকার নেই আরেকজন মানুষকে শেষ করে দেওয়ার। এসবই শিক্ষার দৈন্যতা।’

.

গম্ভীর আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসে জানতে চাইলাম, মনোনয়ন পাওয়ার পর কী ভেবেছেন। ঠোটের কোনে হাসি ছড়িয়ে প্যাট্রিক ডি রোজারিও বলেন, ‘গত ৯ অক্টোবর প্রথমে ভীষণ অবাক হয়েছি। কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিলাম না। আমি বিচলিত ছিলাম।এই জিনিসটা যে আমার কাছে আসবে ভাবতে পারিনি। এটাই ছিল প্রথম উপলব্ধি।’

 

ধীরে ধীরে তিনি বলেন, ‘মণ্ডলী কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ অনেক দূরে। এখানে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের লোকের সংখ্যা খুবই কম। মোটে ৫ লাখের মতো। তারপর নিজেই ভেবেছি, ঈশ্বরের কাছ থেকে পোপ মহোদয়ের মধ্য দিয়ে একটা ভালোবাসা এসেছে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য, বাংলাদেশের মানুষের জন্য। কারণ, আমি মনে করি , এ মনোনয়ন বাংলাদেশকে একটা নতুন মর্যাদায় নিয়ে গেছে। এটা বাংলাদেশের জন্য উপহার। বাংলাদেশের একটা স্বীকৃতি। বাংলাদেশের যা কিছু ভালো আছে, যা সম্পদ আছে সেগুলো বিশ্বের কাছে প্রচারের একটা মাধ্যম এই স্বীকৃতি। ’

 

বাংলাদেশ ছোট। আমাদের মণ্ডলি আরও ছোট। আমিতো আরও ছোট। কিন্তু এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে বড় করে দেখা হচ্ছে, এটাই এখন আমার উপলব্ধি।আর এই উপলব্ধিটা যখন আমি বুঝতে পারলাম তখন খুব স্বস্তি হচ্ছে। ঈশ্বর যদি আমাকে এই কাজের জন্য ডাকেন। আর আমার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের এই গৌরব প্রকাশিত হয়, চার্চের গৌরব প্রকাশিত হয়। পোপ মহোদয়ের যে সর্বজনীন শিক্ষা, সেগুলো যদি আমি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এবং দেশের সাধারণ জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে পারি, সেই ভূমিকাই আমাকে ডাকছে। পোপ মহোদয়ের আহ্বানে আমি এখন সাড়া দেবার জন্য প্রস্তুত আছি। আমার সামর্থ্য অনুযায়ী প্রস্তুত আছি।’

 

তিনি জানান, ‘এবার ১৭ জন নির্বাচিত হয়েছেন কার্ডিনাল হিসেবে, তার মধ্যে বাংলাদেশের প্যাট্রিক ডি রোজারিওসহ ১৩ জনের বয়স ৮০ বছরের নিচে। আর যাদের বয়স ৮০ বছর তাদেরকে সম্মান করে এই মনোনয়ন দেওয়া হলেও যাদের বয়স ৮০ বছরের নিচে তাদের অধিকার আছে নির্বাচন করার। পোপ পদে বহাল থাকার। বর্তমান পোপ মারা গেলে বা ইস্তফা দিলে ১২০ জন কার্ডিনাল পরবর্তী পোপকে নির্বাচিত করেন। এদের মধ্যে আমিও একজন কার্ডিনাল।’ বাংলাদেশ চার্চ প্রথমবার এই নির্বাচনে অংশ নেবে বলেন প্যাট্রিক ডি রোজারিও।

 

কিসের ভিত্তিতে এই কার্ডিনাল নির্বাচন করা হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও রাষ্ট্রের সমস্যা এবং চার্চের সমস্যা দেখে পোপ এই ১২০ জনকে মনোনয়ন দেন। আর পোপের বর্তমান মূল্যায়ন হচ্ছে, এই ১২০ জন কার্ডিনাল যেন কেবল ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এটা যেন সারাবিশ্বে বিকেন্দ্রীকরণ হতে পারে। কারণ, বিগত দিনগুলোতে বেশিরভাগ কার্ডিনাল নির্বাচিত হতেন ইউরোপ থেকে, বিশেষ করে ইতালি থেকে। তবে এবারে কার্ডিনাল নির্বাচিত হয়েছেন পাঁচটি উপমহাদেশ থেকে। কার্ডিনাল বিকেন্দ্রীকরণে এটি পোপের আন্তরিকতার একটা উদাহরণ। এই কণ্ঠস্বরগুলো সারা পৃথিবী থেকে যাচ্ছে। এটা সর্বজনীন একটি উদ্যোগ ।’

 

১২০ জন কার্ডিনাল সরাসরি গোপন ব্যালেটের মাধ্যমে নতুন পোপ নির্বাচিত করবেন। এই ১২০ জন কার্ডিনালের মধ্য থেকেই পরবর্তী পোপ নির্বাচিত হবেন। আগামী ১৯ নভেম্বর ভ্যাটিক্যান সিটিতে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এরপর ২৮ নভেম্বরে শ্রীলঙ্কায় এশিয়ান বিশপদের একটি সম্মেলনে যোগ দেবেন প্যাট্রিক ডি রোজারিওর।

 

১৯৪৩ সালে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার পাদ্রিশিবপুর গ্রামে জন্ম প্যাট্রিক ডি রোজারিও-র। গ্রামের স্কুলে লেখাপড়া শেষ করে নটরডেম কলেজে ভর্তি হন। এরপর করাচী হয়ে বেলজিয়ামে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এরপর ১৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭২ সালে তিনি প্রথম ফাদার হন। ১৯৯০ সালে প্রথম রাজশাহী বিভাগ এবং ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে বিশপের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এছাড়া, বাংলাদেশের আট জন বিশপের প্রধান সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালের নভেম্বরে মনোনয়ন পেয়ে এখনও পর্যন্ত তিনি আর্চ বিশপ পদের দায়িত্বে রয়েছেন।

 

সবশেষে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সমস্যা ও কৃষ্টি নিয়ে কথা বলবো বিশ্বের কাছে। মানুষের জন্য কথা বলতে পারবো এটাই বড় অর্জন। ’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন