ময়নাতদন্তে আসামিকে যেভাবে বাঁচিয়ে দিলেন চিকিৎসক!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রাজধানীর কল্যাণপুরে গৃহবধূ শাম্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গত ৭ জুন। তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন বিষয়টিকে স্বাভাবিক মৃত্যু বললেও বিষয়টি মানতে পারেননি শাম্মীর ভাইসহ অন্য আত্মীয়-স্বজনরা। কারণ, তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন দৃশ্যমান ছিল। এ বিষয়ে হত্যামামলা দায়েরও করেন তিনি। কিন্তু, মরদেহে আঘাতের চিহ্ন থাকা সত্ত্বেও মৃত্যুটি ‘প্রোভোকেটিভ সুইসাইড’ (উত্তেজনাবশত আত্মহত্যা) কিনা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে তার উল্লেখ করেননি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। ফলে মৃত্যুর সঠিক তথ্য উদঘাটনে অসংলগ্নতা দেখা দিয়েছে।এ কারণে এখনও তদন্তের মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজধানীর কল্যাণপুরের গৃহবধূ শাম্মী হত্যা মামলাটি।

গত ৭ জুন কল্যাণপুরের ভাড়া বাসায় একটি বায়িং হাউসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন টিটুর বিরুদ্ধে স্ত্রী শামীমা লাইলা আরজুমান্না খান শাম্মীকে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ঘটনার পরদিন মিরপুর মডেল থানায় নিহত গৃহবধূর ছোট ভাই ফরহাদ হোসেন খান বাবু বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার পর পুলিশ ঘাতক স্বামী আলমগীর এবং তার তৃতীয় স্ত্রী ইসরাত জাহান মুক্তাকে গ্রেফতার করে।

মামলার বাদী ফরহাদ হোসেন খান বাবুর অভিযোগ, ‘ঘাতক আলমগীরের ধনাঢ্য ভগ্নিপতি মো. আবদুল বাছেদ অর্থের বিনিময়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পরিবর্তন এবং মামলাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছেন। একইসঙ্গে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মিরপুর থানার এসআই নওশের আলী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আসামির পক্ষে কাজ করছেন। ফলে এ মামলায় ন্যায় বিচার পাওয়ায় নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছি।’

সম্প্রতি এসব বিষয় উল্লেখ করে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেই প্রতিবেদনটি হাইকোর্টের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। প্রতিবেদনটি আমলে নিয়ে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের দ্বৈত বেঞ্চ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও মৃতের সুরতহাল প্রতিবেদনকারী এসআই  নওশের আলীকে যাবতীয় নথিসহ তলব করেন।

গত ২১ নভেম্বর এসআই নওশের আলীর নথি পর্যালোচনা করে আদালত বলেন, ‘অনেকদিন হয়ে গেলো, অথচ আপনারা এখনও এ মামলায় অভিযোগপত্র জমা দেননি। আপনারা ঠিকমত তদন্ত করেননি বলেও খরব প্রকাশিত হয়েছে। এসব নিয়ে সাধারণ মানুষের মনে নানান প্রশ্ন উঠছে।’

এরপর আদালত নিহত শাম্মীর ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদকে ব্যাখ্যা দিতে গত ৬ ডিসেম্বর তলব করেন। সোহেল মাহমুদও আদালতে উপস্থিত হয়ে তার ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। কিন্তু তার বক্তব্যের কিছু অসঙ্গতি দেখিয়ে এর বিরোধিতা করেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

পরে আদালতে নিজ নিজ ব্যাখ্যার বিষয়ে  সঙ্গে কথা বলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান ও চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ।

আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন,‘‘আদালতে চিকিৎসক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, তিনি ময়নাতদন্তকালে মরদেহে ‘মার্কস অব ইনজুরি’ (আঘাতের চিহ্ন) পেয়েছেন। অথচ ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে লিখেছেন ‘সুইসাইড ইন নেচার’ (স্বাভাবিক আত্মহত্যা)। আবার মৌখিক ব্যাখ্যায় বলেছেন, ‘প্রোভোকেটিভ সুইসাইড ইন নেচার’ (উত্তেজনাবশত স্বাভাবিক আত্মহত্যা)।’’

তিনি আরও বলেন,‘‘এরপর আদালত ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের কাছে জানতে চান,‘আপনি তো রিপোর্টে ‘সুইসাইড ইন নেচার’ লিখেছেন। অথচ মুখে বলছেন ‘প্রোভোকেটিভ সুইসাইড ইন নেচার’। ‘প্রোভোকেটিভ’ শব্দটি প্রতিবেদনে তো লেখেননি। এসময় আমি আদালতকে জানাই, ‘প্রোভোকেটিভ সুইসাইড ইন নেচার’ বলে কোনও বিধান নেই। একজন ব্যক্তি আত্মহত্যার জন্য নিজে কখনও উত্তেজিত হতে পারেন না। তাকে উত্তেজিত করা হলেই তবে আত্মহত্যা করেন। তবে দণ্ডবিধির ৩০৬ ধারা মতে অ্যাবেটমেন্ট অব সুইসাইডের (আত্মহত্যায় প্ররোচনা) একটি বিধান রয়েছে। কাজেই চিকিৎসক যে বক্তব্য দিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছে তিনি নিজেই তার প্রতিবেদন নিয়ে সন্দিহান।’’

অন্যদিকে ডা. সোহেল মাহমুদ  বলেন, ‘‘ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন নিয়ে  সন্দেহ প্রকাশের মতো কিছুই আমি বলিনি। আদালত আমার কাছে জানতে চান, এই হত্যাকাণ্ডটি ‘প্রোভোকেটিভ’ (উত্তেজনাবশত) কিনা? আমি বলেছি, হতে পারে প্রোভোকেটিভ। আমিতো মৃতের শরীরে যে আঘাতের চিহ্ন পেয়েছি প্রতিবেদনে সবই উল্লেখ করেছি। তাই স্বভাবতই এটা প্রোভোকেটিভ। কিন্তু আমি যদি আঘাতের চিহ্ন উল্লেখ না করে শুধু প্রোভোকেটিভ শব্দটি লিখতাম তাহলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যেতো।’’

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে ‘প্রোভোকেটিভ’ শব্দটি না লেখার বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনে প্রোভোকেটিভ শব্দটি অনেকে লেখেন, অনেকে লেখেন না। আমরাও মাঝে মাঝে লিখি, আবার লিখি না। এটা লেখা জরুরি না। কারণ, তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল-যা আমি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি। এটাতেই ধরে নেওয়া যায় যে তাকে হত্যা করা হয়েছে। নিশ্চয়ই তিনি এই আঘাতের চিহ্নগুলো নিজে করেননি! এগুলো সুইসাইডাল প্রোভোকেটিভ (উত্তেজনাবশত আত্মহত্যা)। যা হতে পারে মানসিক কিংবা শারীরিকভাবে।’

এদিকে হাইকোর্ট চিকিৎসকের বক্তব্যে সন্তুষ্ট হতে না পেরে তার ব্যাখ্যা বাতিল করে দেন। একইসঙ্গে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরোকে (পিআইবি) মামলাটি তদন্ত করার নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের প্রিন্সিপালকে এ হত্যা মামলার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন সম্পর্কে আবারও তদন্তের নির্দেশ দিয়ে অধ্যাপক পর্যায়ের তিনজন বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন।

বাংলাট্রিবিউন