মোকাবেলা করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

করোনাভাইরাস সারা বিশ্বকে কত বড় ঝুঁকির মাঝে ঠেলে দিয়েছে, তা সংবাদপত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। বলতে গেলে সারা বিশ্বই আজ এই মহামারীতে আক্রান্ত।

প্রতিদিনই মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে এবং এ সংখ্যা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কেউই এখন অনুমান করতে পারছে না। চীন ও ইউরোপ ছাড়িয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে এখন করোনাভাইরাসটি আঘাত করেছে। পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রাজ্যে এ মহামারী আঘাত করেছে। নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো শহরগুলো পুরো ‘লকডাউন’- মানুষ ঘরের মাঝেই এখন বসবাস করছে।

করোনাভাইরাসটির ভয়াবহতা এই পর্যায়ে গিয়ে যে উন্নীত হবে, তা বোধকরি বিশ্ব নেতারা আঁচ করতে পারেননি। সবাই যার যার মতো করে এখন জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছেন। কিন্তু মহামারীটি নিয়ন্ত্রণে এসেছে, তা বলা যাবে না। এর কোনো প্রতিষেধকও নেই। কোনো কোনো দেশ (জাপান, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র) ওষুধ আবিষ্কারের কথা বলছে বটে। এমনই এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে। সরকার ‘ছুটি’ ঘোষণা করেছে। কিন্তু এ যেন ঈদের ‘আনন্দ’! হাজার হাজার মানুষ গাদাগাদি করে বাসে, ট্রেনে, ফেরিতে একত্রিত হয়ে ঢাকা ছেড়েছেন। এরই মাঝে বেগম খালেদা জিয়াকে সরকার ‘শর্ত সাপেক্ষে’ মুক্তি দিয়েছে। শর্ত আছে দুটি- এক. তিনি বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নেবেন। দুই. তিনি বিদেশে যেতে পারবেন না। সরকারের এক মন্ত্রী বলেছেন, বেগম জিয়ার ‘মুক্তি’র সঙ্গে করোনাভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নেই।

একটা ধারণা ছিল যে করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ এক বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে আছে। সেহেতু সরকার বেগম জিয়াকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে রেখে কোনো ঝুঁকি নিতে চাইছে না। তাই বেগম জিয়ার পরিবারের পক্ষ থেকে করা আবেদন বিবেচনায় নিয়ে বেগম জিয়ার দণ্ড ছয় মাসের জন্য স্থগিত করল সরকার- এ রকম একটি ধারণা সাধারণ মানুষের মাঝে আছে।

ঘটনা যাই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে বেগম জিয়া এখন ‘মুক্ত’। তিনি অসুস্থ, এটা সত্য। কিন্তু যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে শর্তযুক্ত যে ‘মুক্তি’, এই ‘মুক্তি’ বেগম জিয়াকে কোথায় নিয়ে যাবে? এক সময়ের যে অবিসংবাদিত আপসহীন নেত্রী, রাজনীতিতে তার অবস্থান এখন কোথায়? বিএনপি বড় দল। কিন্তু বেগম জিয়াকে ‘মুক্তি’ দিয়ে ‘রাজনীতির বলটা যে এখন শেখ হাসিনার নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিলেন। সময়টা এখন খারাপ।

করোনাভাইরাস এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। বেগম জিয়া আলোচিত হবেন কম। আগামী দু’সপ্তাহ বাংলাদেশের জন্য কঠিন সময়। বড় ধরনের পর্যবেক্ষণে থাকবে বাংলাদেশ। এমনি এক পরিস্থিতিতে বেগম জিয়ার স্থগিত কারাদণ্ড অনেকগুলো সম্ভাবনাকে এখন সামনে নিয়ে এলো।

এক. বেগম জিয়া আদৌ রাজনীতিতে সক্রিয় হবেন কিনা, কিংবা সক্রিয় হলে শর্তভঙ্গ হবে কিনা। দুই. তার ‘নীরবতায়’ দল পরিচালনা করবে কে? তারেক রহমান, না মির্জা ফখরুল? তিন. রাজনীতিতে ‘সক্রিয়’ না থেকে সরকারের আস্থা অর্জন করে বিদেশে চিকিৎসার বিষয়টিকে তিনি প্রাধান্য দেবেন কিনা। চার. করোনাসহ দেশের চলমান অন্যান্য সংকটে বিএনপি সরকারকে সহযোগিতা করবে কিনা।

বেগম জিয়ার বয়স হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সী বেগম জিয়া নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত। তার শারীরিক অসুস্থতা ও সরকারের শর্তের কারণে বিএনপির নেতৃত্বে এক ধরনের স্থবিরতা লক্ষ করা যেতে পারে। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Gerontocracy; অর্থাৎ স্থবিরতা। সাধারণত বয়োজ্যেষ্ঠ রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। গত ১৭ মার্চ The Globalist-এ একটি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে- ‘Coronavirus and Political Leadership: The US Gerontocracy in Action.’ প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, শীর্ষ মার্কিন রাজনীতিবিদদের প্রায় সবাই বয়োজ্যেষ্ঠ।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বয়স ৭৩, হাউস স্পিকার নেনসি পেলসির বয়স ৮০, সিনেটের মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককোনেলের বয়স ৭৮, নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেট দলীয় সম্ভাব্য প্রার্থী জো বাইডেন ৭৭, বার্নি স্যান্ডার্সের ৭৮। নেতৃত্বের সারিতে যারা আছেন, তাদের যথেষ্ট বয়স হওয়ায় একদিকে যেমনি তারা করোনা ঝুঁকিতে রয়েছেন, অন্যদিকে এক ধরনের স্থবিরতাও তৈরি হয়েছে। এ সুযোগে সেখানে deep state শক্তিশালী হয়েছে। বয়সের কারণে যে স্থবিরতা তৈরি হয়, তার বড় প্রমাণ ছিল সাবেক সোভিয়েত নেতা ব্রেজনেভ। জানা যায়, শেষের দিকে ব্রেজনেভ কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন না। তাকে সামনে রেখে একটি ‘চক্র’ তার নামেই শাসনকার্য পরিচালনা করত। জার্মানির চ্যান্সেলর এঞ্জেলা মার্কেলের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বয়সের কারণে তিনি সুষ্ঠু নেতৃত্ব দিতে পারছিলেন না। ফলে তিনি সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বেগম জিয়ার ক্ষেত্রে Gerontocracy কতটুকু প্রযোজ্য হবে, তা এ মুহূর্তে হয়তো বলা যাবে না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে একাধিক রোগে তিনি আক্রান্ত। তার মাথার ওপর রয়েছে শর্ত, আর শর্ত ভাঙলে আবার জেলে যাওয়ার সম্ভাবনা।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়া বেগম জিয়া আর আজকের বেগম জিয়া আকাশ-পাতাল পার্থক্য। সেই আপসহীন নেত্রীর চেহারা এখন আর তার মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এটাই বাস্তবতা। তার বিদেশে চিকিৎসা দরকার। আর সেই চিকিৎসা পেতে হলে সরকারের আনুগত্য তাকে পেতে হবে। ৩৬ বছরের ধরে তিনি দলকে নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। একাধিকবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপট বোধকরি একটু ভিন্ন। প্রকৃতির কাছেই সেই আপসহীন নেত্রী হেরে যাচ্ছেন!

বেগম জিয়া এখন নিজ বাসভবন ফিরোজায়। এটা তার ভাড়া বাড়ি। তিনি এখন আইসোলেশনে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। বয়স্কদের করোনাভাইরাসের ঝুঁকি বেশি। দেশবাসীকে তিনি মির্জা ফখরুলের মাধ্যমে সাবধানে থাকতে বলেছেন। কিন্তু এর আগে শত শত লোককে তাকে ‘পাহারা’ দিয়ে গুলশানে পৌঁছে দেয়ার যে দৃশ্য আমরা মিডিয়ায় দেখলাম, তা অনাকাক্সিক্ষত। যেখানে করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে ‘সোশ্যাল ডিসটেন্স’ বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেখানে শত লোকের মিছিল করে গুলশানে যাওয়া, করোনাভাইরাসের ঝুঁকিটি কি বাড়িয়ে দিল না? আবেগ থাকতেই পারে। কিন্তু বিএনপির কর্মীদের মাঝে কোনো সচেতনতা তৈরি হয়নি! এ সচেতনতার অভাব আছে সর্বক্ষেত্রে।

আরও একটা তথ্য দিই, গত ২৫ মার্চ যুগান্তরের প্রথম পাতায় একটি ছবি ছাপা হয়েছে- তাতে দেখা যায় শত শত লোক গাদাগাদি করে শিমুলিয়া ঘাটে ফেরি পারাপার হচ্ছে। সরকার ছুটি ঘোষণা করেছে। ছুটিতে যেখানে সবার বাসায় থাকার কথা, সেখানে সবাই বাড়ি যাচ্ছে। কোনো কোনো অভিভাবককে দেখলাম তাদের বাচ্চাদের নিয়ে কক্সবাজারে যেতে। সংবাদপত্রে কমলাপুর রেলস্টেশনের ছবিও ছাপা হয়েছে। শত শত লোক লাইনে দাঁড়িয়েছে গাদাগাদি করে। এতটুকু বোধ নেই যে এতে করে করোনাভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।

আমাদের জন্য আগামীতে কোনো ভালো সময় আসবে বলে মনে হয় না। বৈশ্বিক সমস্যার কারণে বাংলাদেশও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ইতিমধ্যে খবর বের হয়েছে যে করোনাভাইরাসের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যু হতে পারে ২২ লাখ মানুষের, আর ব্রিটেনে এ সংখ্যা ৫ লাখ। একটি রিপোর্টে এ তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। রিপোর্টটি তৈরি করেছেন ইম্পিরিয়াল কলেজ অফ লন্ডনের ম্যাথাম্যাটিকাল বায়োলজির প্রফেসর ফার্গুসন। ফার্গুসনের গবেষণা টিম জানিয়েছে, সঠিক পদক্ষেপ না নিলে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়বে। এর সঙ্গে তিনি ১৯১৮ সালে ফ্লু আউটব্রেকের তুলনা করেছেন (নিউজ ১৮ বাংলা, ১৮ মার্চ)। এ রিপোর্টের পরিপ্রেক্ষিতে কিনা জানি না, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনও করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

সেই সঙ্গে ৭০’র বেশি বয়স্ক অসুস্থদের ক্ষেত্রে প্রতিষেধক পদক্ষেপ হিসেবে একদম আইসোলেশনের ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। তার মতো কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোও ‘সেলফ আইসোলেশনে’ গেছেন। ‘সেলফ আইসোলেশনে’ যাওয়ার তালিকায় নাম আছে আরও অনেকের। আরও একটি সংবাদ- ব্লুমবার্গের মতে ভারত হতে পারে পরবর্তী রাষ্ট্র, যেখানে করোনাভাইরাসের কারণে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ইতিমধ্যে ২৫ মার্চ থেকে ২১ দিনের জন্য পুরো দেশটি ‘লকডাউন’ করা হয়েছে। মোদি দেশকে বাঁচাতে ‘পূর্ণ লকডাউন’ ঘোষণা করেছেন।

কিন্তু সাধারণ মানুষ, যারা নিত্যদিনের আয়ে সংসার চালান, তারা বাঁচবেন কীভাবে? ইতিমধ্যে অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ১ দশমিক ৭ লাখ কোটি রুপির অর্থনৈতিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। আর প্রধানমন্ত্রী মোদি স্বাস্থ্য সেক্টরে ১৫ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ করেছেন, যে অর্থ দিয়ে করোনাভাইরাসের মোকাবেলা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসন ২.২ ট্রিলিয়ন (দুই দশমিক দুই ট্রিলিয়ন) ডলার বরাদ্দ করেছে করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য। বাংলাদেশের ঝুঁকিও কম নয়। ইতিমধ্যে পোশাকশিল্পে আড়াইশ’ কোটি ডলারের বেশি অর্ডার বাতিল হয়েছে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ১.১ ভাগ কমবে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থমন্ত্রী। সমাজে এর প্রতিক্রিয়া পড়াটাই স্বাভাবিক। প্রধানমন্ত্রী ইতোমধ্যে ৫ হাজার কোটি টাকার করোনা তহবিল গঠন করেছেন। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী যদি উদ্যোগ নেন, তাহলে দেশের ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ করোনা তহবিল গঠন করা সম্ভব। একাধিক বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করা জরুরি। চীনের সহযোগিতা নিয়ে আমরা এই কাজটি করতে পারি।

চীন এ ক্ষেত্রে পাইওনিয়র। একই সঙ্গে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণও জরুরি। এ কাজটিও চীন করত পারে। বলা হচ্ছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা আগামী ২-৩ মাস পর্যন্ত থাকবে। ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভাইরাসটি বাঁচতে পারে এবং কোনো কোনো গবেষণায় বলা হচ্ছে আগামী শীতে আরও শক্তি নিয়ে ভাইরাসটি আবার ফিরে আসবে। সুতরাং স্বাস্থ্য সেক্টরকে গুরুত্ব দিতে হবে বেশি। অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

গবেষণার সুযোগ বাড়াতে হবে। বেশ কয়েকটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে ‘ভাইরোলজি’ বিভাগকে আরও সক্রিয় করতে হবে। স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্নীতি কমাতে হবে। সব মিলিয়ে করোনা নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে সংকট ও উৎকণ্ঠা, বাংলাদেশ এর বাইরে নয়। এ সংকটকে মোকাবেলা করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে।

তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

tsrahmanbd@yahoo.com