মেধাবী শিক্ষার্থী জঙ্গী সুমাইয়া পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ৫মাস ধরে

মাহবুব হোসেন:
নাটোর শহরতলীর চক আমহাটি নির্ভৃত গ্রামের দিন মুজুর মোস্তফা মিয়াজির মেধাবি কন্যা মাহমুদা খাতুন (জঙ্গী সংগঠনের দেয়া নাম সুমাইয়া)। ৫ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সাত নম্বর সে। দিন মুজুর পিতার অভাবের সংসারে যেন আলোর প্রদীপ ছিলো মাহমুদা খাতুন ওরফে সুমাইয়া। নিজের মেধা খাটিয়ে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পায় মাহমুদা।

সে বছর এইচএসসিতে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে ১৪তম স্থানও অর্জন করে সে। এরপর শুরু হয় মাহমুদার উচ্চ শিক্ষার যাত্রারা। উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তিও হন জগনাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর টিউশনি আর উপ-বৃত্তির টাকা দিয়েই পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছিল সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুন। কিন্তু হঠাৎ করেই যেন দিন মুজুর পিতার সব স্বপ্ন ভেঙ্গে যেন চুরমার হয়ে গেল।

কুষ্টিয়ার ভেরামারায় কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কাছে তিন নারী জঙ্গির মধ্যে আটক হয় নব্য জেএমবির সেকেন্ড ইন কমান্ড তালহার স্ত্রী হিসাবে পরিচিত সুমাইয়া। মেধাবি সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুনের জঙ্গীবাদের সাথে জড়িত হওয়ার খবর গণমাধ্যম সহ অন্যদের কাছে শুনে হতবাক ও বিস্মিত হয়ে পড়েছে তার পরিবার। এমন মেধাবি ছাত্রী জঙ্গীবাদের সাথে জড়িয়ে যেতে পারে তা কল্পনার বাহিরে ছিল মাহমুদার পরিবারের।


মাহমুদা খাতুনের পরিবার সূত্র জানায়, ২০১২ সালে স্থানীয় চক আমহাটী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে জিপিএ-৫ পায় সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুন। কিন্তু অভাবের সংসারে মাহমুদার পিতা মোস্তফা মিয়াজি আর পারছিলেন না মেয়ের লেখা-পড়ার খরচ চালাতে। মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় গরীব দিন মুজুর পিতা।

কিন্তু মেধাবি মাহমুদার লেখাপড়া নষ্ট হতে দেয়নি তার ছোট ভাই। এরপর মাহমুদা খাতুন ভর্তি হন নাটোর শহেরর রানী ভবানী সরকারী মহিলা কলেজে। সেখান থেকে ২০১৪সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পায় মাহমুদা খাতুন। আর রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে মেধা তালিকায় ১৪তম স্থান অর্জন করে সে।

 

এরপর শুরু হয় সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুনের উচ্চ শিক্ষার যাত্রা। উচ্চ শিক্ষার সে যাত্রায় সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুন ভর্তি হন রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে সে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ছিলো। ইসলামী ব্যাংকের উপ-বৃত্তি আর টিউশনি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার খরচ বহন কে আসছিল সে। সব কিছু ঠিকঠাক মতোই চলছিলো।

 

মাহমুদার ভাই হয়রত আলী জানান, চলতি বছরে ইসলামী ব্যাংকের উপবৃত্তির টাকা তুলে গত ২৬ জানুয়ারী ঢাকার উদ্দ্যেশে বের হন। এরপর থেকে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর থেকে পরিবার সাথে তার আর যোগাযোগ হয়নি। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন স্থানে খোঁজ করে তার সন্ধান না পেয়ে গত ১৯ ফ্রেবুয়ারী নাটোর সদর থানায় তার মা আম্বিয়া বেগম জিডি করেন।

মাহমুদার মা আম্বিায়া বেগম জানান, তাদের পরিবারে টেলিভিশন থাকলেও ডিসের সংযোগ না থাকায় মেয়ের খবর জানতোনা পরিবার। পাশাপাশি জেএমবির সেকেন্ট ইন কমান্ড তালহার সাথে মাহমুদার বিয়ের বিষয়টি তারা অবগত নন বলে জানান তিনি। তবে মাহমুদা কে বিপথে যারা নিয়ে গেছে তাদের বিচার চান তিনি।

এদিকে, স্থানীয় সংবাদ কর্মীরা মাহমুদার বাড়িতে যাওয়ার পর আটককের খবর শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন তার পরিবার। একজন মেধাবি ছাত্রী জঙ্গীবাদের সাথে জড়িয়ে যাওয়ায় কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন তার পরিবার।

মাহমুদার বোন জাকিয়া জানান, তারা ৫ বোন ও ৩ ভাইয়ের মাহমুদা ৭ম। তার পিতা মোস্তফা মিজি রিক্সা চালাতেন। বয়সের ভারে সে এখন রিক্সা চালাতে পারেন না। এলাকার একটি নার্সারীতে দিন মুজুরের কাজ করেন তিনি।

 

জাকিয়া আরো বলেন, তার বোন বাড়িতে যখন ছিলো,নিরিবিলি চুপচাপ থাকতো। বাহিরের কারো সাথে তেমন যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে মাহমুদার আটকের খবর শুনে তারা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছেন না। যারা মাহমুদা খাতুনকে বিপদে নিয়ে গেছে তাদের বিচার দাবী করেন তিনি।
মাহমুদা খাতুনের পিতা মোস্তফা মিয়াজি বলেন, অভাবের সংসারে মেয়েকে লেখাপড়ার খরচ দেয়ার মতো তার সমর্থন ছিলো না। মেয়ে নিজে টিউশনি আর উপ-বৃত্তির টাকা দিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে গেছে। কিন্তু জঙ্গীবাদের সাথে জড়িত হওয়ার কথা শুনে হতবাক হয়ে পড়েছি। সারা জীবন আওয়ামীলীগ করে এসেছি। মেয়ে যদি সত্যিকারেই জঙ্গিবাদের সাথে জড়িয়ে পড়ে তাহলে তার বিচার দাবী করছি।

 

নিখোঁজের জিডি তদন্ত হয়নি:
নব্য জেএমবির সেকেন্ট ইন কমান্ড তালহার স্ত্রী হিসেবে পরিচিত সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুন পরিবার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় জীবন-যাপন করছিল। মাহমুদার কোন খোঁজ না পেয়ে মা আম্বিয়া বেগম নাটোর সদর থানায় গত ১৯ ফেব্রুয়ারী একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। কিন্তু মাহমুদা নিখোঁজের ৫মাস হলেও জিডির তদন্ত করেনি নাটোর সদর থানা পুলিশ। সে সময় মাহমুদার মা আম্বিয়া বেগম জিডিতে উল্লেখ করেন, আমার মেয়ে মোছাঃ মাহমুদা খাতুন (২০) (মোবাইল নং ০১৭৯৫-০০৫৭৬৩) ঢাকা জগনার্থ কলেজে অর্নাসে পড়ালেখা করে। আমার মেয়ে গত ২৬-০১-১৭ ইং তারিখ সময় আনুমানিক ১০ঘটিকায় বাড়ি থেকে কলেজে যাবে বলিয়া বাহির হয়। আমার মেয়ে বাড়ি থেকে বাহির হওয়ার পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

 

পরবর্তীতে আমার মেয়ের সন্ধানের জন্য তার বান্ধবীদের পাশাপাশি আত্মীয় স্বজন ও সম্ভাব্য সকল জায়গায় খোঁজাখুজি করিয়া আমার মেয়ের কোন সন্ধান পাই নাই এবং আমার মেয়ে অদ্যবধি বাড়িতে ফিরে আসেনি। আমার মেয়েকে খোঁজখুজি অব্যাহত রয়েছে। আমার মেয়েকে খুজিয়া পাইলে অত্র থানায় অবহিত করবো। বিষয়টি থানায় সাধারণ ডায়েরি হিসেবে গ্রহন করা প্রয়োজন।


পরে জিডিতে মেয়েটি বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়। সে সময় জিডিটি গ্রহন করেন নাটোর সদর থানার এএসআই সাহারুল। জিডি নম্বর দেয়া হয় ৯৫১।

কিন্তু মাহমুদা খাতুনের পরিবার নিখোঁজের বিষয়ে ডায়েরি করলেও সে জিডি তদন্ত করেনি সদর থানা পুলিশ। গাফিলতির কারনে ফেলে রাখা হয় জিডিটি।

এবিষয়ে মাহমুদার পিতা মোস্তফা মিয়াজি বলেন, মেয়ে নিখোঁজের পর থানায় ডায়েরি করা হলেও কোন পুলিশ কর্মকর্তা আর সে বিষয়ে তাদের কাছে কিছুই জিজ্ঞাসা করেনি। সে সময় যদি জিডিটি তদন্ত করা হলে মেয়ে হতো আজ বিপদগামী হতো না।

জিডি তদন্তের বিষয়ে নাটোর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মশিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কিছু বলতে নারাজ।

এ ব্যাপারে নাটোরের পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, সুমাইয়া বা মাহমুদা খাতুনের নিখোঁজের বিষয়ে তারা অবগত নন। আর জিডি তদন্ত হয়েছিলো কিনা সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ার শঙ্কা গোয়েন্দা সংস্থার:
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সময় সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুন জঙ্গিবাদের সাথে জড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারনা করছে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় আটকের পর সুমাইয়া ওরফে মাহমুদার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গিয়ে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে তারা। সরকারের ওই গোয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করার সময় সুমাইয়া ওরফে মাহমুদা খাতুন জঙ্গীগোষ্ঠির টার্গেটে পরিনত হয়। তাছাড়া তার পিতার গরীব হওয়ার সুযোগ নিতে পারে জঙ্গী গোষ্ঠিটি।

স/শ