‘মেডিকেল টেস্ট না হওয়ার কারণে ধর্ষণের আসামি খালাস পেতে পারে না’

ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়াই পারিপার্শ্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে ধর্ষণ মামলায় যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামির সাজা বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এ রায়টি হাইকোর্টের একটি যুগান্তকারী রায় বলে মন্তব্য করেছেন আইনজীবীরা।

হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়, ‘শুধু ডাক্তারি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে ধর্ষণ প্রমাণ হয়নি বা আপিলকারী ধর্ষণ করেনি এ অজুহাতে আসামি খালাস পেতে পারে না।’ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষ্য ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পারলে তার ভিত্তিতে সাজা দেয়া যেতে পারে।

তাই মেডিকেল রিপোর্ট না থাকার কারণে আসামি যে ধর্ষণ করেনি মর্মে খালাস পাবেন, এ অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। ভুক্তভোগী দেরিতে মামলা করলেও তা মিথ্যা নয় বলেও রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে খুলনার (নিম্ন) আদালতে দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে আসামির করা আপিল খারিজ করে চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। সম্প্রতি ওই রায়ের ১৫ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।

ওই সময় আদালতের শুনানিতে আসামি পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আমিনুল হক হেলাল ও সৈয়দ আল আহসাফুর আলী রেজা। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জান্নাতুল ফেরদৌসি রুপা ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ আহমেদ হিরো। এছাড়া বাদী পক্ষে অ্যাডভোকেট মো. ইছা শুনানিতে অংশ নেন।

এর আগে, খুলনার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল -১ এর বিচারক ধর্ষণ মামলার একমাত্র আসামি ইব্রাহীম গাজীকে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯ (১) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে সাজা দেন। পাশাপাশি আসামিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। জরিমানা অনাদায়ে আরও দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।

ওই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা হাইকোর্টে সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন। আদালত আপিল খারিজ করে নিম্ন আদালতের দেয়া সাজা বহাল রাখেন।

রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল জাহিদ আহমেদ বলেন, আদালতে আসামি পক্ষের আইনজীবী তিনটি যুক্তিতে আসামির খালাস চান। প্রথমত, ঘটনার আটদিন পর অর্থাৎ বিলম্বে অভিযোগ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভিকটিমের মা একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হওয়া স্বত্বেও আদালতে তিনি সাক্ষ্য দেননি এবং তৃতীয়ত ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা এ মামলায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ছিল কিন্তু বাদীপক্ষ তাতে ব্যর্থ হয়েছে।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আরও বলেন, আমি এসব যুক্তির বিরুদ্ধে দেশ-বিদেশের কয়েকটি মামলার নজির আদালতে উপস্থাপন করি। এরমধ্যে স্টেট অব পাঞ্জাব-বনাম-গুরমিত সিং, (১৯৯৬) ২ সুপ্রিম কোর্ট কেসেস ৩৮৪; আল-আমীন ও অন্য ৫ জন–বনাম রাষ্ট্র, ৫১ ডিএলআর ১৫৪; আব্দুস সোবহান বিশ্বাস বনাম রাষ্ট্র, ৫৪ ডিএলআর ৫৫৬ এবং বাদল ও অন্য একজন বনাম রাষ্ট্র, ৪ বিএলসি ৩৮১ মামলার নজির উদ্ধৃত করে আদালতে জানানো হয় ধর্ষণের মত অপরাধের ক্ষেত্রে ভিকটিমের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তার অভিভাবক সহজে থানা পুলিশ করতে চান না। অনেক চিন্তা ভাবনার পরই তারা আইনের আশ্রয় নেন। এ ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।

এছাড়া আসামিপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় সালিশের মাধ্যমে মীমাংসার অজুহাতসহ থানা-পুলিশকে প্রভাবিত করে অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে বিলম্ব হতে পারে যা ধর্তব্য নয় বলেও আইনজীবী জাহিদ আহমেদ আদালতকে জানান।

যুক্তিতর্কে সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতে আরও উল্লেখ করেন, ধর্ষণের মত অপরাধের ক্ষেত্রে অন্য কোন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী থাকে না, তাই ভিকটিমের সাক্ষী ও পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দিয়েই অপরাধের বিচার করতে হয়। একজন ১৫ বছরের নাবালিকা, যার সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ সে শুধু শুধু আসামির বিরুদ্ধে নিজের লজ্জার কথা কেন নিজের মুখে বর্ণনা করবে? যেহেতু আসামিপক্ষ জেরা করে ভিকটিমের সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় কোন চীড় ধরাতে পারেনি, কাজেই শুধুমাত্র তার (ভিকটিমের) সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করেই আসামিকে সাজা দেয়া সঠিক হয়েছে।

এছাড়া ট্রাইব্যুনালের আদেশ স্বত্বেও ভিকটিমের ডাক্তারি পরীক্ষা না করায় ঘটনার প্রমাণ হয়নি, এমনকি ডাক্তারি পরীক্ষায় (মেডিকেল টেস্ট) ধর্ষণের কোনো আলামত না পাওয়া গেলেও শুধুমাত্র ভিকটিমের মৌখিক সাক্ষ্যের ভিত্তিতে আসামিকে সাজা দেয়া যুক্তিযুক্ত ও সঠিক বলেও জানান আইনজীবী জাহিদ আহমেদ।

উল্লেখ্য, খুলনার দাকোপ উপজেলার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাসলিমা খাতুনকে স্কুলে যাওয়া আসার পথে আসামি মো. ইব্রাহীম গাজী প্রায়ই উত্যক্ত এবং কু-প্রস্তাব দিত। কিন্তু প্রতিদিনের মত স্থানীয় কালিকাবটি জামে মসজিদে পবিত্র কোরআন শরীফ পড়তে যাওয়ার আগে ২০০৬ সালের ১৫ এপ্রিল আনুমানিক ভোর পৌণে ৬টার দিকে মসজিদ সংলগ্ন পুকুর ঘাটে ওযু করতে যায়। সেখানে আগে থেকে ওঁত পেতে থাকা আসামি পেছন থেকে ভিকটিমকে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে ধরে এবং পাঁজাকোলে করে মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থানের পাশে বাঁশ বাগানের নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। আসামি জোর করে তার মুখ চেপে ধরে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের ফলে ভিকটিমের রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এরপর আসামি সেখান থেকে পালিয়ে যায়।

ওই ঘটনায় তসলিমার বাবা শেখ মো. আজাহার আলী আসামির বিচার চাইলে সালিশ বসে। সালিশে মীমাংসা হয়নি বরং বলা হয়, ছেলে-মেয়েদের মধ্যে এমন ঘটনা হয়েই থাকে। ঘটনার পর ১৭ এপ্রিল থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশও মামলা নেয়নি। পরে তিনি ওই বছরের ২৩ এপ্রিল আদালতে নালিশি মামলা করেন। এর পর ১৭ মে ভিকটিমের স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে নির্দেশ দেন। ভিকটিমের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন মেডিকেল কর্তৃপক্ষ।

এরপর আটজন সাক্ষীর জবানবন্দি গ্রহণ করে আসামির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত। পরে মমালায় দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ আদালত আসামি ইব্রাহীম গাজীকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ৯(১) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি আসামিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ২ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ