মৃত্যুর আগে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ চান শতবর্ষী লক্ষ্মীরাণী 

নিজস্ব প্রতিবেদক : বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার ঝালুকা ইউনিয়নের বাসিন্দা দশরথ চন্দ্র কবিরাজ। শিক্ষাকতা করতেন গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন এলাকায় সংগঠকের কাজ করেন। তার এক ছেলেও মুক্তিযুদ্ধে যান।
জাতীয় চার নেতার অন্যতম রাজশাহীর কৃতি সন্তান এএইচএম কামারুজ্জামানের ঘনিষ্ট সহচর ছিলেন দশরথ চন্দ্র কবিরাজ। রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের বহু আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় অংশ নেন তিনি।
কেবল আওয়ামী লীগ করায় পরবর্তীতে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষের বহু নির্যাতনের শিকার হয়েছে দশরথ কবিরাজের পরিবার। দুই দফা পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে বসতবাড়ি।
 নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে একরকম বিনা চিকিৎসায় ২০০৬ সালের ১৩ আগস্ট মারা যান দশরথ চন্দ্র। কিন্ত বেঁচে আছেন তার স্ত্রী লক্ষ্মীরাণী। ১০৩ বছর বয়সি লক্ষ্মীরাণী পৌঁছে গেছেন জীবন সায়াহ্নে।
মৃত্যুর আগে অন্তত: বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে যান এই বৃদ্ধা। জানাতে চান আওয়ামী লীগ করায় তার পরিবারের উপরে ঘটে যাওয়া নিপীড়নের কথা।
পরিবার বলছে, লক্ষ্মী রাণীর জন্ম ১৯১৭ সালের ১৫ মে। বাল্যকালেই দশরথ চন্দ্র কবিরাজের ঘরে বধূ হয়ে আসেন লক্ষ্মী। অবস্থাপন্ন দশরথের ঘরের লক্ষ্মীই ছিলেন তিনি। তিনি সাত সন্তানের জননী।
ভারত বিভাগ থেকে শুরু করেন মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধিকার আদায়ের সকল আন্দোলন-সংগ্রাম দেখেছেন কাছে থেকে। মুজিব আদর্শে স্বামীর এগিয়ে যাবার ছায়সঙ্গি ছিলেন লক্ষ্মীরাণী।
লক্ষ্মীরাণী জানান, মুক্তিযুদ্ধ শুরুর হবার পর পরই হানাদার বাহিনীর দেশীয় দোসররা তাদের বাড়িতে আগুন দেয়। গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ছিলো তাদের। সব কিছু লুটে নিয়ে যায় রাজাকারের দল। ওই আগুনে ঝছারখার হয়ে যায় পুরো গ্রাম।
 প্রাণ বাঁচাতে তারা পদ্মা পাড়ি দিয়ে সীমান্তের ওপারে ভারতের দেবীপুর ধনিরামপুর সাগরপাড়ায় গিয়ে ওঠেন। সেখানকার কাজিপাড়া শরনার্থী ক্যাম্পে প্রথমে তাদের ঠাঁয় হয়েছিলো।
সেখানে থেকেই দশরথ কবিরাজ মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজ চালিয়ে যান। বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাড়ি দেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন।
এক পর্যায়ে তার সাথে পরিচয় হয় ধনিরামপুর সাগরপাড়ার স্কুল শিক্ষক আমীর হামজার সাথে। ওই শিক্ষকই নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেন দশরথের পরিবারকে। সেখান থেকেই তার বড় ছেলে দিজেন্দ্রনাথ কবিরাজ অংশ নেন মুক্তিযুদ্ধে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর স্বামীর সাতে সন্তানদের নিয়ে নিজ ভিটায় ফেরেন। এসে দেখেন বিনা ভূমি। তারপর গ্রামের লোকেদের সহায়তায় মাটির দেয়াল তুলেন। আবারো শুরু হয় নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম। দশরথ কবিরাজ শুরু করেন শিক্ষকতা। সেই সাথে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় দেশ গঠনে অংশ নেন।
লক্ষ্মীরাণী আরো জানান,  আওয়ামী লীগের সংগ্রামের ইতিহাসের সাথে আমার পরিবার মিশে আছে। আওয়ামী লীগ করার কারণে বহু নির্যাতন আমাদের সইতে হয়েছে। তবু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বুকে ধারণ করে এখনো টিকে আছি।
তিনি বলেন, ২০০০ ও ২০০১ সালে তার বাড়িতে দুই দফা আগুন দিয়েছে বিএনপির সন্ত্রাসী বাহিনী। সবকিছু লুটে নিয়ে গেছে। প্রাণ বাঁচাতে সন্তানেরা বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। তাদের আর একত্র করতে পারেননি।
বাড়িতে থাকতে না পেরে সন্ত্রাসী হামলার ক্ষত নিয়ে  অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে তিনি স্বজনদের বাড়িতে লুকিয়ে আশ্রয় নেন। এবাড়ি-ওবাড়ি করে দিন কেটেছে তাদের। পালিয়ে থাকতে থাকতে একসময় খাদ্য সংকট দেখা দেয়। সেইসাথে তার শারীরিক অবস্থারও খারাপ হতে থাকে । এক সময় বিনাচিকিৎসায় তিনি মারা যান।
লক্ষ্মীরাণী বলেন, তার পরিবারের এই করুণ পরিণতির কথা তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেলে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান তার স্বামী। ওই সময় তিনি, আমাদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে, সময় হলে বিচারের আশ্বাস দেন। নিজ হাতে আমাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা করেন এবং আশ্বাস দেন সময় সুযোগ এলে কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব হবে।
তার ভাষ্য, আমার দৃঢ় বিশ্বাস তিনি (শেখ হাসিনা) দশরথ চন্দ্র কবিরাজের পরিবারের উপর নির্যাতনের কথা ভুলে যাননি। আমার জীবন শেষের দিকে, জানিনা কখন মারা যাবো? তবে জীবনে কিছু না বলা কথা আছে, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট বলতে চাই!
দশরথ চন্দ্র কবিরাজের ছেলে সুকুমার চন্দ্র কবিরাজ ও হামলার শিকার হয়েছেন বাবার সাথে। তিনি জানান, তার পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের আদর্শের।  তিনি ছাত্রলীগ করতেন ১৯৮৩ সালে।
তারপর যুবলীগ করতেন। ইউনিয়ন সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন ১৯৮৯ সালে। এখন পৌর আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের পদে রয়েছেন। তার মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেবকা করতে চান। এটি তার অন্তিম ইচ্ছা। জানিনা তার সেই ইচ্ছা পুরণ হবে কি না।
তিনি বলেন, ২০০০ সালের ৪ অক্টোবর তৎকালীন বিএনপি সরকারের এমপি নাদিম মোস্তফার সন্ত্রাসী বাহিনী আমাদের বাড়িতে হামলা চালায় । হামলায় তিনি ছাড়াও বাবা দশরথ চন্দ্র কবিরাজ মা লক্ষ্মীরাণীসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যই আহত হন। আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয় পুরো ঘরবাড়ি। কোনরকমে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ছাড়েন তারা।
দিনের পর দিন পলাতক জীবন কেটেছে তাদের। পরে এনিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়। এতে আরো ক্ষিপ্ত হন নাদিম মোস্তফা। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের তিন দিন পর ৪ অক্টোবর আবারো তাদের বাড়িতে হামলা চালায় নাদিম বাহিনী।
আরেক দফা আগুন দেয়া হয় বাড়িতে। সবকিছু লুটে দিয়ে যায় হামলাকারীরা। তাদের হামলায় পরিবারের সদস্যরা তিনিসহ পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্য আহত হন। ওই সময় চিকিৎসা নিতেও বাধা দেয় সন্ত্রাসীরা। শেষে পুলিশের হস্তক্ষেপে হাসপাতালে ভর্তি হন আহতরা। তারা এখনো হামার ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াচ্ছেন।
স/আ.মি