মূল্যস্ফীতির লাগাম ছেড়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

মহামারী করোনার পর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের পাশাপাশি বাংলাদেশেও হু হু করে বেড়ে গেছে মূল্যস্ফীতি। পরবর্তীকালে, গত দুবছরে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই মূল্যস্ফীতির পারদ নেমে অনেকটাই স্বাভাবিক পর্যায়ে এলেও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর উল্টো চিত্রই বরং পরিলক্ষিত হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। গত ১২ মাস ধরে ৯ শতাংশের ওপরেই অবস্থান করছে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতি। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশের মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির শুরুটা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটের কারণে ঘটলেও এখন আর তা বলা যাবে না। বিশ্বের অন্যান্য দেশ এমনকি অর্থনীতির ফাঁদের কিনারায় চলে যাওয়া শ্রীলংকার মতো দেশও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অথচ বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১০ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এর পেছনে অভ্যন্তরীণ নীতিনির্ধারণই মূলত দায়ী। যথাসময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। যেসব ইতিবাচক সিদ্ধান্ত এসেছে, সেগুলোও অনেক দেরিতে নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার কথা বলা হলেও যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে তা মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দিচ্ছে। সর্বশেষ বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তও মূল্যস্ফীতি বাড়াবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশে দীর্ঘ সময় ধরে যে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চিত্র সেটা একদিনে হয়নি এবং কী কী কারণে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেটিও জানা। বিশ্ববাজারে যখন পণ্যমূল্য বেড়েছিল, তখন বাংলাদেশেও বেড়েছিল। বিশ্ববাজারে এখন কমছে। কিন্তু দেশের বাজারে কমছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সঠিক পথে হাঁটছে না। তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি যে সংকটগুলোর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, বিশেষ করে উচ্চ মূল্যস্ফীতির জন্য এখন আর বৈশ্বিক কারণগুলোকে দায়ী করা যাবে না। কারণ, বিশ্বের অন্যান্য দেশে মূল্যস্ফীতি কমে এসেছে। শ্রীলংকার মতো দেশও মূল্যস্ফীতি কমিয়ে এনে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমরা পারিনি। অর্থাৎ আমাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো ঠিক করতে হবে। সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক এই মুখ্য অর্থনীতিবিদ বলেন, কেতাবি কৌশলের বাইরে গিয়ে নিজস্ব কায়দায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের যে চেষ্টা করা হয়েছে, সেগুলো কাজে তো আসেইনি, উল্টো মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। গত বছর তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এখন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সেগুলোতেও জড়তা দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ছিল ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ২০২৩ সালের মার্চ মাস থেকে প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতি সামান্য ওঠানামা করলেও তা ৯ শতাংশের ওপরেই ছিল। গত বছর মার্চে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। মে মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির দেখা মেলে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়। পরবর্তী দুই মাস (জুন ও জুলাই) নিম্নমুখী থাকলেও আগস্টে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ হয়। সেপ্টেম্বরে তা সামান্য কমে ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ হয়। কিন্তু অক্টোবরে এসে ফের মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

আগামীতে মূল্যস্ফীতির গতিপথ কোন দিকে যেতে পারে সে বিষয়ে এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সেটা বলা মুশকিল। তবে শিগগিরই নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন- চাহিদার তুলনায় দেশে উৎপাদন ও পণ্য সরবরাহ বাড়াতে হবে। আমাদের বিকল্প সরবরাহ বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে আমদানিতে শুল্ক কমাতে হবে। বাজারকে সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। কারণ অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট মূল্যস্ফীতি আরও অসহনীয় করে তুলছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপনের মান অনেক নিচে নেমে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি কমানোর পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও জোরদার করতে হবে। সামাজিক নিরাপত্তার জন্য সরকার যে বরাদ্দ রেখেছে, তা অপ্রতুল। টিসিবির মতো ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির কার্যক্রমের পরিমাণ ও পরিধি বাড়াতে হবে।

তিনি মনে করেন, মূল্যস্ফীতির যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা অর্জন অসম্ভব নয়। তবে সরকারের চেষ্টা থাকতে হবে।

২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, যা পরবর্তী সময় বাড়িয়ে ৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু তা অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটেও ৬ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। এটিও পরবর্তীকালে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু গত আট মাসের মূল্যস্ফীতির গতিপথ বলছে, এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে। কেননা সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশে অবস্থান করছে। অর্থাৎ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে এখনো ২ দশমিক ১৭ শতাংশ বেশি রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমন সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দেবে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও সরকার বারবার উল্টো পথেই হাঁটছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি যখন বাড়তে শুরু করেছিল তখনই গ্যাস, বিদ্যুতের দাম কমানো উচিত ছিল। সরকার সেটা না করে, উল্টো দফায় দফায় বাড়াচ্ছে। তেলের দাম বাড়ানো দিয়ে শুরু হয়েছিল। সে সময় দাম কমানো যেত। কমাতে পারেনি তা নয়, সরকার চাইলেই উদ্যোগ নিতে পারত। কিন্তু নেয়নি। এখন আবার বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়বে বলে মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ।

এ বিষয়ে ড. জাহিদ হোসেন মনে করেন, তিনটি বিষয়ে আমাদের পদক্ষেপ ও ধৈর্য দরকার। একটি হলো সুদের হার বৃদ্ধি। এটা অনেক দেরিতে হয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত হয়নি। যতটুকু হয়েছে সেটার প্রভাব পড়তে সময় প্রয়োজন। এর মধ্যে যদি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যেটা মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়, তাহলে আর ফল আসবে না। বিদ্যুৎ, গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে মূল্যস্ফীতির ওপর। আরেকটি হচ্ছে ডলার। বিশ্ববাজারে ডলারের ক্ষেত্রে এখন কিছুটা স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা আমদানি শিথিল না হওয়া পর্যন্ত তার প্রভাব বাজারে পড়বে না। এক্ষেত্রে আরও সময় লাগবে। তিনি যোগ করেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ক্ষেত্রে অর্থ সরবরাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ডলার জমা রেখে ব্যাংকাররা সোয়্যাপ লাইনে টাকা নিচ্ছে। এটা তো সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে যায় না। এর ফলে তো অর্থ সরবরাহ বেড়ে যাচ্ছে। এভাবেই কিছু পদক্ষেপ মূল্যস্ফীতির পক্ষে, আবার কিছু পদক্ষেপ বিপক্ষে নেওয়া হচ্ছে। এভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।

এ ছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায় অনেক কাজ করার আছে। কারসাজি বন্ধ করতে হবে। কেবল কড়া-কড়া কথা বললেই তো বাজার নিয়ন্ত্রণে আসবে না। তার বাস্তবায়নও হতে হবে।