মূলধনও খেয়ে ফেলেছে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

একের পর এক দুঃসংবাদ রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের। এবার ব্যাংকটি মূলধনও খেয়ে ফেলেছে। সে কারণে জুন শেষে দুই হাজার কোটি টাকার মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে এ ব্যাংক। এ নিয়ে ৭টি মৌলিক সূচকে পতন ঘটে জনতা ব্যাংকের। অবস্থা খুবই সংকটাপন্ন।

ব্যাংকটির প্রায় সব সূচক এখন নিুমুখী। এক দিকে পুরনো খেলাপির চাপ, অন্যদিকে নতুন করে বিপুল অঙ্কের খেলাপি, প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্য সংকটের কারণে বর্তমানে টাকা ধার করে চলছে জনতা। এছাড়া জুন শেষে বড় ধরনের আর্থিক লোকসানের পাশাপাশি ব্যাংকটির লোকসানি শাখাও বেড়েছে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ যুগান্তরকে বলেন, জনতা এক সময় ভালো ব্যাংক ছিল। কেন এমন হচ্ছে বুঝতে পারছি না। এ ব্যাপারে একটি সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। এতে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকিং সূচকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংকে বিপুল অঙ্কের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। বেড়েছে ঋণ অবলোপন। আমানত কমেছে। বেড়েছে প্রভিশন ঘাটতি। লোকসানি শাখাও বেড়েছে। বাড়ছে আর্থিক নিট লোকসান।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, জুন শেষে মূলধন সংক্রান্ত শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত সাতটি ব্যাংক। এর অর্থ হল, এ ব্যাংকগুলোকে আবারও মূলধন সরবরাহের জন্য জনগণের করের টাকার ওপর নির্ভর করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে হিসাব দিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংকসহ ১০টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৫ হাজার ১৪২ কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত সাত ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২৩ হাজার ২৭০ কোটি এবং বেসরকারি তিন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা।

তথ্যে আরও দেখা যায়, জুন শেষে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ সর্বোচ্চ ৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। এছাড়া সোনালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬ হাজার ৬০২ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩ হাজার ১০৬ কোটি টাকা, জনতা ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ২ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৫২৫ কোটি টাকা, অগ্রণী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ৪১৯ কোটি টাকা, রূপালী ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ১ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৬৪৫ কোটি টাকা, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩০২ কোটি টাকা এবং এসআইবিএলের মূলধন ঘাটতি প্রায় ৪৬ কোটি টাকা।

২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি মেটাতে ১৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। সুশাসনের অভাবে ধুঁকতে থাকা এ প্রতিষ্ঠানগুলো সংকট থেকে উঠে আসতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, বর্তমানে যে অবস্থা চলছে তাতে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে; আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও স্থানীয় ব্যবসা সংশ্লিষ্টদের কাছে এমনই একটা বার্তা যায়। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত দ্রুত সংকট উত্তরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। বৈদেশিক বিনিয়োগের সিদ্ধান্তের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলেও তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, মোট খেলাপি ঋণের ৩২ শতাংশ ১০০ শীর্ষ খেলাপির কাছে আটকে আছে। এর মধ্যে ৫৬ শতাংশই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের। আবার এর মধ্যে ২৬ শতাংশই জনতা ব্যাংকের। বিষয়টি নিয়ে খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ৯ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২২ শতাংশ। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় জুন শেষে বড় অঙ্কের লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। জানুয়ারি-জুন সময়ে ব্যাংকটির লোকসান হয় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। মূলত খেলাপি ঋণের বিপরীতে নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে গিয়েই লোকসানে পড়ে। ২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের নিট মুনাফা ছিল ৯৭ কোটি টাকা। এর আগের বছরে ২৫১ কোটি টাকা মুনাফা করে ব্যাংকটি।

জনতা ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সরকারি সিদ্ধান্তে আমানতের সুদহার কমানোর কারণে আমানত তুলে নিচ্ছেন গ্রাহকরা। এছাড়া এননটেক্স গ্রুপের ২২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির ঋণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অনিয়মের কারণে ঋণের একটি অংশ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

এছাড়া ক্রিসেন্ট গ্রুপের পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা। এর প্রায় পুরোটাই খেলাপি করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে রয়েছে ক্রিসেন্ট লেদারের ৬৩৭ কোটি টাকা, রূপালী কম্পোজিটের ৬৫০ কোটি টাকা, লেক্সকো লিমিটেডের ৪১০ কোটি টাকা, ক্রিসেন্ট ট্যানারির ১৫৮ কোটি টাকা ও রিমেক্স ফুটওয়্যারের ৮৭২ কোটি টাকা। তবে সবমিলিয়ে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সুবিধা পেয়েছে ক্রিসেন্ট গ্রুপ।

এরই মধ্যে গ্রুপটির পাঁচ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ আদায়ে বন্ধকী সম্পদ বিক্রির জন্য নিলাম ডেকেছে জনতা ব্যাংক। এভাবে ৩ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা আদায় করতে চায় ব্যাংকটি। নিলামকৃত সম্পদের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার সাড়ে ১৬ শতাংশ প্লট, সাভার ও হাজারীবাগের জমি, যন্ত্রপাতিসহ কারখানা, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, নিলামের পণ্যও দায় পরিশোধ করতে পারবে না। কারণ দায় আরও বেশি।

ব্যাংকটির তারল্য সংকটের কথা তুলে ধরে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি দিয়েছেন জনতা ব্যাংকের এমডি আবদুছ ছালাম আজাদ। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, ১ জুলাই থেকে আমানত ও ঋণের সুদহার যথাক্রমে ৬ ও ৯ শতাংশ কার্যকর করা হয়। এ কারণে ক্রমান্বয়ে ব্যাংকের আমানত কমতে থাকে। এতে জুলাই ও আগস্টে ২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা আমানত কমে যায়।