মুফতি আবদুস সালাম চাটগামীর বর্ণাঢ্য জীবন

হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান মুফতি ও সদ্য নিযুক্ত মহাপরিচালক মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বুধবার (৮ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ১১ টায় হাটহাজারী মাদরাসার পরিচালনা কমিটির পরামর্শ সভা চলাকালে মুফতি আবদুস সালাম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এরপর অ্যাম্বুলেন্স করে হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।

জন্ম ও পড়াশোনা : মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (রহ.) ছিলেন একজন ক্ষণজন্মা মহামনীষী। আল্লাহভীরু ও উচ্চতর যোগ্যতা সম্পন্ন আলেম হিসেবে তিনি সবার কাছে অত্যাধিক গ্রহণযোগ্য ও সম্মানিত ছিলেন। শুধু তাই নয়, বরং পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি।

মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী (রহ.) ১৯৪৩ সালে মোতাবেক ১৩৬৩ হিজরিতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা থানার নলদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫৮ সালে গ্রামে প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে বাবুনগর মাদরাসায় ভর্তি হন। ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রামের জিরি মাদ্রাসায় চার বছর পড়াশোনা শেষে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেন। শিক্ষাজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব পরীক্ষায় সব সময় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করতেন। তাছাড়া ছাত্র সংসদ জমিয়তুত তলাবার জিরি শাখার প্রধান হিসেবে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।

পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষা : ১৯৬৭ সালে বাংলাদেশের (প্রথম) মুহাদ্দিস আল্লামা আবদুল ওয়াদুদ (রহ.)-এর নির্দেশনাক্রমে মুফতি আবদুস সালাম (রহ.) পাকিস্তানে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া আল্লামা বান্নুরি টাউন করাচিতে ভর্তি হন। তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা মুহাম্মদ ইউসুফ বানুরি (রহ.)-এর তত্ত্বাবধানে প্রথম বছর তিনি উচ্চতর হাদিস শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেন। পরের বছর সেখানে ইফতা বিভাগ চালু হয়। অতঃপর এ বিভাগের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী হিসেবে তিনি আল ফিকহুল ইসলামী নিয়ে পড়াশোনা করেন। এ সময় হাদিস ও ফিকাহ বিষয়ক গভীর ব্যুৎপত্তি অর্জনে তিনি অসংখ্য গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন, যার ফলে ইসলামী আইন ও হাদিস বিষয়ে তিনি উপমহাদেশের একজন বরেণ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

তিন দশক প্রধান মুফতির দায়িত্ব পালন : হাদিস ও ইফতা বিভাগের শিক্ষা সমাপ্তির পর একই প্রতিষ্ঠানের মুফতি হিসেবে নিয়োগ পান। পাকিস্তানের বিখ্যাত মুফতি ওলি হাসান টুংকি (রহ.)-এর বার্ধক্যজনিত অসুস্থার কারণে মুফতি আবদুস সালাম ভারপ্রাপ্ত প্রধান মুফতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এ সময় নিজের মেধা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে মুফতি ওলি হাসান টুংকির মৃত্যুর পর তিনি বিশ্বখ্যাত এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুফতির পদ লাভ করেন।

লক্ষাধিক ফতোয়া প্রদান : একজন বাঙালি আলেম হিসেবে বিষয়টি যেমন অনেক গর্বের ছিল, তেমনি তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রতিভার দৃষ্টান্ত ছিল। করাচির বিশ্বখ্যাত জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়ার এ পদে তিনি দীর্ঘ তিন দশক দায়িত্ব পালন করেন। এ প্রতিষ্ঠানের ইফতা বিভাগে প্রতি বছর ৯ হাজারের বেশি ফতোয়া জমা হত৷ সেই হিসেবে এ দীর্ঘ সময় তিনি দুই লাখের বেশি লিখিত ফতোয়া সম্পাদনা করেন, যা ওই প্রতিষ্ঠানের ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপন করে।

জামেয়াতুল উলুম আল ইসলামিয়া আল্লামা বান্নুরি টাউন করাচির দ্বিতীয় মহাপরিচালক আল্লামা আহমদুর রহমান বলেন, ‘ফাতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে মুফতি আব্দুস চাটগামী এক অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন।’ (বাইয়্যিনাতে বান্নুরি, পৃষ্ঠা : ২৪৪)

প্রধান মুফতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মুফতি আবদুস সালাম একই প্রতিষ্ঠানে প্রসিদ্ধ হাদিস গ্রন্থ সহিহ মুসলিম ও সুনানে তিরমিজি গ্রন্থের পাঠদান করেন। এছাড়াও করাচীর ঐতিহ্যবাহী আহমদ উসমানি জামে মসজিদের খতিবও হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

রচনাগ্রন্থ : মুফতি আবদুস সালাম রচিত ‘জাওয়াহিরুল ফাতওয়া’ ফতোয়া জগতে সাড়া জাগানো নির্ভরযোগ্য একটি গ্রন্থ। ৪ খণ্ডের অনবদ্য গ্রন্থ ছাড়াও করাচির প্রথম সারির প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলাদেশি এ আলেমের একাধিক গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। তাঁর উল্লেখ্যযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে আছে, মাকালাতে চাটগামী, করোনাকালীন সমস্যা ও তার শরয়ী বিধান, দিল জাগানো সুরভী মালফুজাতে বোয়ালভী রহ., বিতর নামাযা ও রাকাত সংখ্যা, কুরবানী আহকাম ও জরুরী মাসায়েল, আহকামে তাওহীদ ও রেসালত ইত্যাদি।

দেশে ফিরে হাটহাজারি মাদরাসায় যোগদান : ২০০০ সালে মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী ইসলামী শিক্ষা প্রসারে  নিজ দেশে ফিরে আসেন। কথিত আছে যে, করাচির বান্নুরী টাউন থেকে চলে এলেও বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে অন্য কাউকে প্রধান মুফতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বরং দেশে ফিরেও বিশেষ সম্মাননা হিসেবে মুফতি আব্দুস সালাম চাটগামী প্রধান মুফতি পদে ছিলেন। এরপর দারুল উলুম হাটহাজারীর মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আহ্বানে ২০০১ সালে হাটহাজারী মাদরাসায় প্রধান মুফতি হিসেবে যোগদান করেন। তাঁর নিয়োগের পর হাটহাজারি মাদরাসায় ২ বছর মেয়াদি উচ্চতর হাদিস শাস্ত্র বিভাগ চালু হয়।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ