মুদ্রা বাতিল নিয়ে যেসব প্রশ্ন ভারতীয়দের মনে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক :

গত ৮ নভেম্বর রাতে পাঁচশ’ আর হাজার রুপির নোট রাতারাতি বাতিল ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মানুষের ৫০ দিন ভোগান্তি হবে বলে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন। সেই ৫০ দিনের অর্ধেক অতিক্রান্ত। মানুষের কাছে ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে পুরনো টাকা জমা দেওয়ার জন্য হাতে আছে শুধু ডিসেম্বর মাসের বাকিটা। কিন্তু পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ নেই, ওদিকে ভিড় করে আসছে হাজারো প্রশ্ন আর সংশয়। বাংলা ট্রিবিউন-এর অনুসন্ধানে উঠে এসেছে তেমন কিছু প্রশ্নের উত্তর।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির সিদ্ধান্তে বাতিল হয়েছে ৫০০ ও ১ হাজার রুপির নোট

১. ভারতের সাধারণ মানুষ আর ছোট ব্যবসায়ীরা কীভাবে এই ধাক্কা সামলাচ্ছেন?

সোজা উত্তর, তারা এখনও এই ধাক্কা সামলাতেই পারেননি। দোকানপাট, হাটবাজার বা পাইকারি মান্ডিতে ব্যবসাপাতি অন্তত তিরিশ থেকে চল্লিশ শতাংশ কমেছে গত এক মাসে– কারণ মানুষের হাতে নগদ টাকা নেই। দোকানপাটে তড়িঘড়ি কার্ড সোয়াইপ মেশিন বা মোবাইল ওয়ালেটে লেনদেনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে, কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা যৎসামান্য। ফলে বিএমডব্লিউ-র শোরুম থেকে পাড়ার পানের দোকান, সর্বত্রই এক অবস্থা–কোনও ক্রেতা নেই।

সাধারণ মানুষের অবস্থা আরও খারাপ। এটিএমের সামনে লাইন এখনও এতটুকু কমেনি, তাও নিমেষে টাকা ফুরোচ্ছে সেখানে। মাসপয়লায় অনেকেরই ব্যাঙ্কে মাইনে জমা পড়েছে, কিন্তু সে টাকা তুলতে পারছেন না তারা।

২. এত ভোগান্তি সত্ত্বেও মানুষ কি প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপকে সমর্থন করছেন?

এর জবাব হ্যাঁ এবং না। নরেন্দ্র মোদি নিজে বিষয়টি নিয়ে তার নিজস্ব অ্যাপে জনমত জরিপ করিয়েছেন এবং তারপর দাবি করেছেন নব্বই শতাংশেরও বেশি মানুষ সাময়িক দুর্ভোগ সত্ত্বেও সরকারের উদ্যোগকে সমর্থন করছে। তবে প্রশ্ন হল, ভারতে কত শতাংশ লোকেরই বা স্মার্টফোন কিংবা ইন্টারনেট অ্যাক্সেস আছে যে তারা মোবাইল অ্যাপে মতামত জানাবেন? তবে তার পরেও এটা ঠিকই যে কোনও কোনও মানুষ এটিএমের লাইনে দাঁড়িয়েও সরকারের পদক্ষেপে সায় জানাচ্ছেন, কেউ আবার নিজেদের বিরক্তি আর রাগ উগড়ে দিচ্ছেন। কিন্তু যারা নোট বাতিলের পক্ষে ছিলেন, তাদেরও ধৈর্যের বাঁধ দ্রুত ভাঙছে – কারণ মাসখানেক পরেও পরিস্থিতি মোটেও স্বাভাবিক বলা যাবে না।

৩. এটাকে কি দুর্নীতি আর কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঠিক রাস্তা বলে মানুষ মনে করছে?

এখানেও জনমত দ্বিধাবিভক্ত। অনেকেই বলছেন, কালো টাকার কারবারিরা তাদের সম্পদের খুব কম অংশই নগদ টাকায় রাখেন – বেশিটা সঞ্চিত থাকে জমিবাড়ি, সোনাদানা বা বিদেশি অ্যাকাউন্টে। নগদ কালো টাকার পরিমাণ হয়তো দশ শতাংশও নয়, ফলে এই নোট বাতিল করার ঘোষণা আখেরে কতটা কাজে দেবে তা নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। তা ছাড়া দেশের বড় বড় কর্পোরেট শিল্পপতিরা ব্যাঙ্কে যে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ অনাদায়ী রেখেছেন, সেই ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না-নিয়ে সাধারণ মানুষকে কষ্ট দেওয়ার কী মানে, সে প্রশ্নও উঠছে। তবে আবার একটা শ্রেণির মানুষের বিশ্বাস, কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়াই কোথাও তো একটা শুরু করতেই হত – ফলে নরেন্দ্র মোদি সঠিক পদক্ষেপই নিয়েছেন।

পুরান নোট জমা দিতে ব্যাংকগুলোতে এমনই ভিড় করছেন ভারতীয়রা

৪. যদি কালো টাকার বিরুদ্ধে আক্রমণ না-ই শানানো যায়, তাহলে মোদির আসল উদ্দেশ্যটা কী?

দিল্লিতে ক্ষমতার অলিন্দে প্রবল জল্পনা হল, এই ঘোষণার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী আসলে এক ঢিলে দুপাখি মেরেছেন। তিনি নিজের একটা সৎ, বলিষ্ঠ ভাবমূর্তি যেমন তুলে ধরতে পেরেছেন– তেমনি মুলায়ম সিং যাদব, মায়াবতী বা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মতো রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হতচকিত করে দিতে পেরেছেন। সামনেই আসছে উত্তরপ্রদেশ আর পাঞ্জাবের নির্বাচন, সেটাকে মাথায় রেখে মায়া-মুলায়ম-কেজরিওয়ালরা প্রত্যেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নগদ জোগাড় করে ফেলেছিলেন বলে খবর, যার গোটাটাই না কি এখন জলে! এটা সত্যি কি না বলা মুশকিল, তবে মমতা ব্যানার্জি ছাড়া যে তিন বিরোধী নেতা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে সবচেয়ে কড়া ভাষায় আক্রমণ করছেন তারা কিন্তু এরাই!

৫. পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এই ইস্যুতে এতটা সরব কেন?

নিন্দুকরা বলছেন, সারদা চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি বা নারদা স্টিংয়ের টাকাপয়সা এখনও পুরোটা সাদা করে তোলা যায়নি বলেই তৃণমূল নেত্রীর এই গোঁসা। সেটা যদি নাও হয়, দেশে ২০১৯-র সাধারণ নির্বাচনকে মাথায় রেখে নরেন্দ্র মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাখার এটাই যে সবচেয়ে মোক্ষম সুযোগ, তৃণমূল নেত্রী তা বিলক্ষণ বুঝেছেন। তৃণমূল এখন পার্লামেন্টে এককভাবে চতুর্থ বৃহত্তম দল, আগামী নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জি আরও শক্তিশালী ভূমিকায় ফিরে আসার স্বপ্ন দেখছেন। এই কারণেই তিনি বারবার রাজধানীতে ছুটে আসছেন, দিল্লি-পাটনা-লখনৌতে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জনসভা করছেন, এমন কী হিন্দিতে ভাষণ দেওয়ার দক্ষতা বাড়াতে হিন্দি শিক্ষক পর্যন্ত রাখছেন। মোদিকে আক্রমণ করতে গিয়ে শালীনতারও ধার ধারছেন না। এই ইস্যুটাকে তিনি দেখছেন জাতীয় রাজনীতিতে আরও বড় ভূমিকায় তার ফিরে আসার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে।

৬. এই ডামাডোলের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ সেনা মোতায়েন করা হল কেন?

এটাও মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির একটা সুচতুর কৌশল–যার সুবাদে তিনি সেনাবাহিনীর একটা রুটিন জরিপ কাজকর্মকে দিব্বি ‘সেনা মোতায়েন’ বলে চালিয়ে দিতে পেরেছেন। ভারতে ইস্টার্ন কমান্ডের সেনারা প্রতি বছরই টোল প্লাজাগুলোতে কয়েকজন নিরস্ত্র সেনা সদস্যকে পাঠিয়ে ভারি যানবাহনের জরিপ করে থাকে – যাতে জরুরি অবস্থায় কোন কোন গাড়ি রিকুইজিশন করা যায় তার হিসেব তাদের কাছে তৈরি থাকে। গত বছরও ঠিক এই সময়ই কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গে (এবং অন্যান্য রাজ্যেও) একই ধরনের সেনা জরিপ হয়েছিল, তখন কোনও আপত্তি ওঠেনি। কিন্তু এবারে ঠিক সেই জিনিসটাকেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের ‘সেনা মোতায়েন’ বলে দাবি করে বসলেন–কারণ তিনি এই ইস্যুতে মানুষের সহানুভূতি পেতে চেয়েছিলেন।

বাতিল নোট জমা দিতে ব্যাংকগুলোতে ভারতীয়দের এমন ভিড় রাতেরবেলাতেও

৭. তাহলে সব মিলিয়ে কী মনে হচ্ছে, নরেন্দ্র মোদির এই দুঃসাহসী ফাটকা কি খাটছে?

এ প্রশ্নের চূড়ান্ত জবাব দিতে আরও কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী একটা বেপরোয়া ফাটকা খেলেছেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু তাতে নির্বাচনি সাফল্য আসবে কি না সেটা এখনই বলা মুশকিল। এরই মধ্যে বিরোধী দলগুলো, যারা কিছুদিন আগেও একেবারে ছত্রভঙ্গ ছিলেন, তারা কিন্তু পার্লামেন্টে অনেকটা একজোট হতে পেরেছেন। ফেব্রুয়ারি নাগাদ উত্তরপ্রদেশ-পাঞ্জাব-গোয়ার মতো রাজ্যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানেই হবে নরেন্দ্র মোদির আসল পরীক্ষা। কালো টাকার বিরুদ্ধে লড়ছেন বলে ভারতের দলিতরা মায়াবতীকে ভুলে মোদিকে ভোট দেবেন, কিংবা যাদবরা মুলায়মকে ভুলে বিজেপির নামে ধন্য ধন্য করবেন–এমনটা ভারতের রাজনীতিতে আগে কখনও হয়নি।

কিন্তু,  নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদি একটা ফাটকা খেলে ফেলেছেন, ভারতে এমন ফাটকারও কোনও নজির নেই–সেটা সব অঙ্ক উল্টে দেবে কি না তা আগামী দু’তিনমাসেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। উত্তর প্রদেশের ভোটে জিতে তিনি নিজের কর্তৃত্ব আর ক্ষমতাকে হয়তো আরও নিরঙ্কুশ করে তুলবেন, কিংবা এই নোট অচলের ঘোষণার মধ্যে দিয়েই প্রশস্ত হবে তার বিদায়ের পথ!

সূত্র : বাংলাট্র্রিবিউন