মিয়ানমার এবং সেই পুরোনো কবিতা

ওরা প্রথমে এল কমিউনিস্টদের জন্য,

আমি কিছু বললাম না

কারণ আমি তো কমিউনিস্ট নই।

এরপর ওরা এল সমাজতন্ত্রীদের জন্য,

আমি কিছু বললাম না

কারণ আমি তো সমাজতন্ত্রী নই।

এরপর ওরা এল ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের জন্য,

আমি কিছু বললাম না

কারণ আমি তো ট্রেড ইউনিয়নিস্ট নই।

এরপর ওরা এল ইহুদিদের জন্য,

আমি কিছু বললাম না

কারণ আমি তো ইহুদি নই।

এরপর ওরা আমার জন্য এল

আমার হয়ে বলার জন্য, তখন আর কেউ নেই।

এই লাইনগুলো বিশ্বের বিভিন্ন হলোকস্ট মেমোরিয়ালে খোদিত আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৬ সালের ৬ জানুয়ারি ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে এক জার্মান লুথেরান ধর্মযাজকের স্বীকারোক্তিমূলক বক্তৃতার মূল বক্তব্যের পদ্যরূপ এই লাইনগুলো। যাজক মার্টিন নিয়েমোলার ছিলেন কমিউনিস্টবিরোধী এবং হিটলারের উত্থানের সময় তাঁর সমর্থক। পরে হিটলার যখন ধর্মের ওপর রাষ্ট্রের আধিপত্য চাপিয়ে দেন, তিনি তখন হিটলারবিরোধী যাজকদের একটি দলের নেতৃত্বে আসেন। ১৯৩৭ সালে তাঁকে বন্দী করা হয়। মিত্রশক্তির জয়ের পর ১৯৪৫ সালে তিনি কারাগার থেকে মুক্ত হন। হিটলারকে সমর্থন করে যে অপরাধ করেছিলেন, সে জন্য অনুতাপ প্রকাশ করে তিনি এই বক্তৃতা দেন। সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে তা ব্যাপক প্রচার লাভ করে।

১৯৪৮ সালে বার্মা যখন ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন কথা ছিল যে দেশের বিভিন্ন সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। এমনকি চাইলে তারা বিচ্ছিন্নও হয়ে যেতে পারবে—এমন শর্তও মেনে নিয়েছিলেন স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতা অং সান। বাস্তবে সেসব কিছুই ঘটেনি। বরং শুরু থেকেই সংখ্যাগরিষ্ঠ বামাররা পুরো দেশে তাদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৬২ সালে বামারনিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করে বিদ্রোহী সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপর নির্বিচার নির্যাতন চালানো শুরু করে। অং সান সু চির পাঁচ বছরের শাসনকাল ছিল এরই সামান্য পরিবর্তিত রূপ। পরোক্ষে প্রকৃত ক্ষমতা ছিল সেনাবাহিনীর হাতেই।

শক্তিমান প্রতিবেশী চীন মিয়ানমারের এ পরিবর্তনকে সেনা অভ্যুত্থান বলতেই রাজি হয়নি। তাদের মতে, এটা মন্ত্রিসভায় পরিবর্তনমাত্র। রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রসঙ্গেও চীন বরাবর সেনাদের পাশেই থেকেছে। চীনের জন্য কি শিক্ষণীয় কিছু আছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে

মিয়ানমারে সরকারিভাবে আটটি বৃহত্তর গোষ্ঠীর মধ্যে ১৩৫টি জাতিসত্তার স্বীকৃতি আছে (অবশ্য রোহিঙ্গারা তার মধ্যে নেই)। ২০১৪ সালের জনগণনা অনুযায়ী মিয়ানমারের মোট লোকসংখ্যা ৫ কোটি ১৪ লাখ, যার ৬৮ শতাংশ বামার। সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মধ্যে সবচেয়ে বড় শান, শতকরা ৯ ভাগ। তারপর কারেন ৭, হান চীনা ২.৫ শতাংশ। এরপরই রাখাইন ও ‘বাঙালি’ প্রতিটি ২ শতাংশের কম। সন্দেহ নেই বাঙালি বলতে রোহিঙ্গাদের বোঝানো হয়েছে। তবে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এই সংখ্যাতত্ত্ব বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করা হয় না। নিরপেক্ষ অনুমানে লোকসংখ্যা হওয়ার কথা ৬ কোটি বা তার বেশি। এই যে ফারাক, এটা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর লোকসংখ্যা কম দেখানোর উদ্দেশ্যেই হয়তো করা হয়েছে, এমন সন্দেহ আছে। রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বিচার করলেও বিষয়টা ধরা পড়ে। ‘বাঙালি’ অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের সংখ্যা বলা হচ্ছে ১.৮ শতাংশ, কমবেশি ৯ লাখ। সরকারি হিসাবে এখন ৬ লাখের মতো রোহিঙ্গা অবশিষ্ট আছে মিয়ানমারে। ২০১৭ সালের গণহত্যা শুরুর পর অন্তত ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এর আগে ২০১৬ সালে এসেছে ৮০ হাজার এবং আগের কয়েক বছরে অন্তত আরও ৩ লাখ। অর্থাৎ সৌদি আরব এবং অন্যান্য দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের বাদ দিলেও শুধু বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা অন্তত ১৮ লাখ।

এই ১৮ লাখ রোহিঙ্গার অন্তত ১২ লাখকে চরম নির্যাতনের মুখে বিতাড়ন করেছে বামারনিয়ন্ত্রিত মিয়ানমার সেনাবাহিনী। চার দশকের বেশি সময় ধরে কাজটি তারা করেছে। সব সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ওপরই নির্যাতন চালিয়েছে তারা। শান, কারেন এবং আরও অনেক গোষ্ঠী সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়েছে ও চালাচ্ছে। চীন সীমান্তে ওয়া স্টেট তো প্রায় স্বাধীন রাজ্যই প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। তবে রোহিঙ্গারা যেহেতু ছিল সবচেয়ে দুর্বল, তাদের ওপর নির্যাতনের মাত্রাটাও ছিল সবচেয়ে বেশি।

অং সান সু চি যখন দীর্ঘদিন নিজ গৃহে অন্তরীণ ছিলেন, বামারদের মতো রোহিঙ্গারাও তাঁর মুক্তির আন্দোলনে অংশ নিয়েছে। তারা আশা করেছিল, গণতন্ত্র এলে ন্যায়বিচারও প্রতিষ্ঠিত হবে, তাদের ওপর নির্যাতনেরও সমাপ্তি ঘটবে। তাদের সে আশা দুরাশাই থেকে গেছে। যে প্রবল অন্যায়ের মধ্যে রোহিঙ্গারা বাস করছিল, তার কোনো সুরাহা তো হলোই না, বরং সু চির শাসনামলেই সংঘটিত হলো রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুরতম গণহত্যা এবং জাতিগত নিধন। আর এরপর সু চি গেলেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যা মামলায় সেনাবাহিনীর হয়ে সাফাই গাইতে।

এত কিছু করেও অবশ্য শেষ রক্ষা হলো না। সেই সেনাবাহিনী আবার অন্তরীণ করেছে তাঁকে এবং বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করছে। যে বামার শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনে নীরব থেকেছে বা পরোক্ষে মদদ দিয়েছে, সেনাদের অস্ত্র আজ ঘুরে গেছে তাদের দিকেই। পয়লা ফেব্রুয়ারি সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে বিক্ষোভকারীদের ওপর সেনা-পুলিশের খড়্গ নেমে এসেছে। শুধু গত রোববারই নিহত হয়েছেন ৭০ জন বিক্ষোভকারী, গত দেড় মাসে মৃতের সংখ্যা অন্তত ১২০ জন। এই সহিংসতা থামার কোনো আশু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বিক্ষোভের মুখে সেনারা চট করে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন, তেমন সম্ভাবনাও ক্ষীণ।

সংখ্যাগুরু বামার জনগোষ্ঠী এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘাত একসময় নিশ্চয় শেষ হবে। শেষ হবে সম্ভবত ২০১০-১১ সালের মতোই কোনো একটা সমঝোতার মধ্য দিয়ে। বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যাবে, এমনটি আশা করা ঠিক হবে না। আপসরফায় সু চি এবং তাঁর দল হয়তো আবার ক্ষমতার ভাগ পাবেন। তবে সেনাবাহিনী এবং তাদের বামার দোসরেরা যত দিন রোহিঙ্গা এবং অন্য সব সংখ্যালঘুর অধিকারসহ মানুষের মতো বাঁচতে না দেবে, তত দিন পর্যন্ত স্থায়ী শান্তি সুদূরপরাহতই থেকে যাবে।

শক্তিমান প্রতিবেশী চীন মিয়ানমারের এই পরিবর্তনকে সেনা-অভ্যুত্থান বলতেই রাজি হয়নি। তাদের মতে, এটা মন্ত্রিসভায় পরিবর্তনমাত্র। রোহিঙ্গা গণহত্যা প্রসঙ্গেও চীন বরাবর সেনাদের পাশেই থেকেছে। চীনের জন্য কি শিক্ষণীয় কিছু আছে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে? মিয়ানমারে অন্তত ৩৭টি চীনা মালিকানাধীন কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে গত কয়েক দিনে। সংকীর্ণ স্বার্থে বরাবর মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজদের পক্ষেই থেকেছে চীন। ন্যায়ের পক্ষে অবদান রাখার সময় হয়তো এসেছে বৈশ্বিক আধিপত্যকামী চীনা নেতৃত্বের সামনে।

মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

 

সুত্রঃ প্রথম আলো