মিয়ানমারের সঙ্গে সংঘাতে যাব না, আলোচনাতেই সমাধান

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমেই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা আলোচনা করেছি, চুক্তি সম্পাদন করেছি এবং মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা এখনও কাজ করে যাচ্ছি। মিয়ানমারের সঙ্গে আমরা ঝগড়া বাধাতে যাইনি।

প্রধানমন্ত্রী বৃহস্পতিবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শনে গিয়ে উপস্থিত কর্মকর্তাদের উদ্দেশে এসব কথা বলেন। তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বেও রয়েছেন। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের অংশ হিসেবে প্রথমবারের মতো প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় পরিদর্শন করেন তিনি।

‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই পররাষ্ট্রনীতিতেই তার সরকার বিশ্বাসী এবং সেই নীতিতেই সরকার পরিচালিত হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এটাই বলব- মিয়ানমার যেহেতু আমাদের প্রতিবেশী। আমরা কখনও তাদের সঙ্গে সংঘাতে যাব না। বরং তাদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে তাদের নাগরিকদের তারা যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায়, সেই প্রচেষ্টাই আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। সে বিষয়ে সবাই যেন সেভাবেই দায়িত্ব পালন করেন, সে জন্যও আমি অনুরোধ করব।

প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগ, যাই হোক না কেন তাকে মোকাবেলা করার ক্ষমতা বাংলাদেশ রাখে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়াটাও আজ বিশ্বের অনেকের কাছেই বিস্ময়। আমরা মানবিক কারণেই এটা করেছি। নিজেদেরও বলতে গেলে রিফিউজি হিসেবে ’৭৫-এর পরে ৬ বছর বিদেশে অবস্থান করতে হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, নিজের নামটাও আমরা ব্যবহার করতে পারিনি। এ রকম দিনও আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের শরণার্থীরা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের নিজেদেরই অভিজ্ঞতা রয়েছে, ১৯৭১ সালে আমাদের ১ কোটি মানুষ শরণার্থী হিসেবে ছিল। তাদেরকে নিয়ে এসে পুনর্বাসন করতে হয়েছে, সেই অভিজ্ঞতাটাও রয়েছে। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কারও সঙ্গে যুদ্ধ করব না, আমরা যুদ্ধ করতে চাই না, সবার সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই।

সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. শামসুল হক, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল আওরঙ্গজেব চৌধুরী, বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব সাজ্জাদুল হাসান, প্রতিরক্ষা সচিব আখতার হোসেন ভূঁইয়া, প্রধানমন্ত্রীর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ পদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এ জাতির পিতাকে হত্যার পর এ দেশ সমগ্র বিশ্বে তার মর্যাদা হারিয়েছিল। আর ২১ বছর পর ’৯৬ সালে আমাদের সরকার গঠনের পর সরকারের লক্ষ্যই ছিল এই হৃত গৌরব পুনরুদ্ধার করা। শেখ হাসিনা স্মৃতিচারণ করে বলেন, এই জায়গাটা আমাদের অনেক স্মৃতিবিজড়িত জায়গা। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি হিসেবে এখানেই অফিস করেছেন। তখন এটাই ছিল তার অফিস। আর আমরা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হিসেবে যেটা ব্যবহার করছি, সেটা ছিল পার্লামেন্ট হাউস।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের প্রতীক হচ্ছে তার প্রতিরক্ষা। একটা দেশকে কীভাবে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করা যায়, আবার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়গুলোও এখান থেকেই কার্যকর করা হয়। আমাদের দেশের আবহাওয়া জলবায়ু থেকে শুরু করে অনেক কাজই হয় এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে।

স্বাভাবিকভাবেই সরকার গঠনের পর সবসময় এ মন্ত্রণালয়টি তিনি নিজের কাছেই রাখেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এর ফলে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্র বাহিনীকে যেমন আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা যাচ্ছে, তেমনি ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে জলবায়ুর প্রভাব নিয়ে কাজ করারও একটা সুযোগ আমাদের রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে স্থলসীমানা চুক্তি এবং সমুদ্র সমস্যা সমাধানে তার সরকারের উদ্যোগ তুলে ধরে বলেন, জাতির পিতাই এর শুরুটা করে যান।

কিন্তু কেন যে পরবর্তী সরকারগুলো সেটা বাস্তবায়ন করেনি, সেটা বোধগম্য নয়। তিনি বলেন, সে সময় ১৯৭৪ সালেই জাতির পিতা ভারতের সঙ্গে ‘স্থলসীমানা চুক্তি’ করে সংসদে আইন পাস করে সংবিধান সংশোধন করে তা সন্নিবেশিত করে যান।

আর বঙ্গবন্ধু সেই ’৭৪ সালেই সমুদ্রসীমানা আইন করে যান, যেখানে জাতিসংঘও এ আইন করেছে ১৯৮২ সালে। কাজেই পৃথিবীর বহু দেশ পরবর্তী সময়ে সমুদ্রসীমা নিয়ে কোনো বিরোধ নিষ্পত্তির দরকার হলে আমাদের আইনটাকেই ব্যবহার করত।

 

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের সংবিধানে যেহেতু স্থলসীমানা আইনটি পাস হয়নি তাই স্বাভাবিকভাবেই সেটা আর তখন কার্যকর হয়নি এবং আমাদের কোনো সরকারও ভারতের কাছে বিষয়টি তোলেনি। তবে, ’৯৬ সালে সরকারে আসার পরই এ বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করে, সেটি সরকার বাস্তবায়ন করে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা শান্তি চাই, শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই কিন্তু কেউ যদি আমাদের আক্রমণ করে তার যথাযথ জবাব যেন আমরা দিতে পারি এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যেন রক্ষা করতে পারি সে প্রস্তুতিটা সবসময় আমাদের থাকতে হবে।

তিনি বলেন, যুদ্ধের জন্য নয়, শান্তির জন্যও আমাদের প্রস্তুতি দরকার। আর সেখানেও অবশ্যই আমরা একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যাতে চলতে পারি সে ব্যবস্থাটাও আমাদের থাকা উচিত। এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় হল এখন শান্তি রক্ষার জন্য আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা যাচ্ছে (শান্তিরক্ষা মিশনে), পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যাচ্ছে। আমাদের যারা সেখানে যাবে, আমি মনে করি, তারা সব বিষয়েই পারদর্শী হবে।

এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী তার প্রথমবারের পেন্টাগন সফরের বিষয় উল্লেখ করে বলেন, এ অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের সেনাবাহিনীর সব পদকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা জাতিসংঘে যাচ্ছি, কাজেই পরিচয়ের ক্ষেত্রে যেন সবাই সমান থাকতে পারি, যে যত ছোট বা বড় হোক না কেন। সে জন্য সব পদবিকে ঢেলে সাজানো হল। মন্ত্রণালয়গুলোও যেন আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর হয়, সে পদক্ষেপটাও আমরা নিয়েছি।

পরে প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার স্মৃতি রক্ষার্থে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে স্থাপিত বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি সেখানে রক্ষিত পরিদর্শন বইয়েও স্বাক্ষর করেন।