মা-বাবার সঙ্গে এক বাসাতেই ১৫ দিন থাকবে দুই কন্যা শিশু

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

আপাতত আগামী ১৫ দিন জাপানী মা ও বাংলাদেশী পিতার সঙ্গেই গুলশান এক নম্বরে চার কক্ষের একটি ভাড়া বাসায় থাকবে সেই দুই কন্যা শিশু। তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার থেকে ওই বাসাতে শিশু দুটিকে স্থানান্তর করতে সিআইডিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বাসাতে যাতে মা-বাবার মধ্যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে সেজন্য বিষয়টি মনিটরিং করতে ঢাকার সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালককে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা পুলিশ কমিশনার ও সিআইডিকে সার্বিক নিরাপত্তা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার (৩১আগস্ট) এ আদেশ দেন। আদালত আগামী ১৬ ডিসেম্বর পরবর্তী আদেশের জন্য দিন ধার্য করে বলেছেন, এর আগে যদি কোনো সমস্যা হয় তা আদালতের নজরে আনতে বলা হয়েছে উভয়পক্ষকে। আর ওই বাসার খরচ উভয়পক্ষ বহন করবে। আদেশের আগে আইনজীবীদের উপস্থিতিতে খাসকামরায় দুই শিশু, তাদের মা-বাবার বক্তব্য শোনেন আদালত। পরবর্তীতে আইনজীবীদের দীর্ঘ শুনানি শেষে আদেশ দেন। এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার আগেই শিশু দুটিকে নিয়ে আদালতে হাজির হয় সিআইডি। সেখানে শিশু মা, বাবা ও ফুফুসহ আত্মীয়রা উপস্থিত হন।

আদেশের সময় আদালত বলেন, আমরা সমঝোতার জন্য আপনাদের সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু তা পারলেন না। আপনারা নিজেদের যার যার জায়গায় অনড়। এখানে সমস্যাগ্রস্থ বাচ্চারা। তবে আপনারা উভয়পক্ষই ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখতে চান না। আমরাও চাই শিশু দুটি পারিবারিক পরিবেশে মা-বাবার সাহচর্যে থাকুক। একারণে গুলশানের ভাড়া বাসায় থাকবে শিশু দুটি। সেখানে তাদের মা-বাবাও থাকবেন। আদালত বলেন, শিশু দুটির ভালো থাকার বিষয়টি বিবেচনা নিয়েই এই আদেশ দেওয়া হচ্ছে। আপাতত ১৫ দিন থাকুন। দেখা যাক, কি হয়। এরপর পরবর্তী আদেশ দেওয়া হবে।

গতকাল সকালে শুনানিতে অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ এ আবেদনের বিরোধিতা করে বলেন, শিশু দুটি পিতার বাসায় অথবা একটি আবাসিক হোটেলে থাকুক। এর বিরোধিতা করে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বারিধারার একটি বাসার ঠিকানা দিয়ে বলেন, এই বাসাটি ভাড়া করা হয়েছে। সেখানে রাতে শিশু দুটির সঙ্গে মা থাকবেন। আর পিতা সেখানে শিশু দুটির সঙ্গে দেখা সাক্ষাত করতে পারবেন।  কোথায় বাসা ভাড়া নেওয়া হবে তা নিয়ে বিরোধ দেখা দেওয়ায় এবিষয়ে আলোচনার জন্য উভয়পক্ষ সময় নেন। আদালত তাদের আলোচনার জন্য সময় দিয়ে বেলা ৩টায় পরবর্তী শুনানির সময় নির্ধারণ করেন। এর আগে খাসকামরায় শিশু ও তাদের মা-বাবার বক্তব্য শোনেন আদালত।

দ্বিতীয় ধাপে শুনানিতেও দুইপক্ষ সমঝোতায় আসতে না পারায় আদালত ফাওজিয়া করিম ফিরোজের প্রস্তাবে গুলশানের একটি বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেন। এ আদেশের পর আদালত কক্ষে উপস্থিত জাপানি মা বক্তব্য দেন। আদালত তার বক্তব্য শোনেন। পরে উভয়পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য শোনেন। এরপর আগের আদেশ বহাল রেখে বলেন, এ সময়ে কোনো অসুবিধা হলে তা আদালতের নজরে আনবেন। তখন প্রয়োজনীয় আদেশ দেওয়া হবে। এরপর সিআইডি শিশু দুটিকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিয়ে যায়।

গত ১৯ আগস্ট শিশু দুটির মা জাপানী নাগরিক নাকানো এরিকো’র করা এক রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে শিশু দুটিকে ৩১ আগস্ট হাইকোর্টে হাজির করার নির্দেশ দেন। পিতা ও ফুফুকে শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আর গুলশান ও আদাবর থানার ওসিকে তা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেন। এ আদেশের পর গত ২২ আগস্ট রাতে শিশু দুটিকে পিতার বাসা থেকে উদ্ধার করে তেজগাঁও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়।

এ অবস্থায় হাইকোর্ট গত ২৩ আগস্ট পৃথক এক আদেশে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত শিশু দুটিকে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখার নির্দেশ দেন। সেখানে ওই দুই শিশুর জন্য উন্নত পরিবেশের ব্যবস্থা করতে বলা হয়। একইসঙ্গে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত মা এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পিতা কন্যা শিশু দুটির সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন বলে আদেশে বলা হয়। এই নির্দেশনা অনুযায়ী পিতা-মাতা সন্তানদের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সময় দেন । এছাড়া আদালতের আহ্বানে সমঝোতায় পৌছানোর জন্য সন্তানদের পিতা-মাতাকে নিয়ে আইনজীবীরা একাধিক বৈঠক করেন।

জানা যায়, ২০০৮ সালের ১১ জুলাই জাপানী নাগরিক নাকানো এরিকো (৪৬) এবং বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক ইমরান শরীফের (৫৮) বিয়ে হয়। তাদের সংসারে তিনটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তারা তিনজনই টোকিও’র চফো সিটিতে অবস্থিত আমেরিকান স্কুল ইন জাপান (এএসআইজে)-এ পড়ালেখা করছিল। কিন্তু পারিবারিক বিরোধের জেরে চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বিয়ে বিচ্ছেদের জন্য জাপানী আদালতে মামলা করেন এরিকো। কয়েকদিন পর ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের নিজের জিম্মায় রাখতে টোকিও’র পারিবারিক আদালতে পৃথক একটি মামলা করেন এরিকো। টোকিও’র আদালত গত ৩১ মে এরিকোর অনুকুলে মেয়ে দুটিকে জিম্মা হস্তান্তরের আদেশ দেয়।

ওদিকে মেয়ে দুটির বাংলাদেশী পাসপোর্ট বানিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারি দুবাই হয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন পিতা ইমরান শরীফ। দেশে ফিরে সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে ঢাকার আদালতে মামলা করেন। ঢাকার আদালত তার অনুকূলে আদেশ দেয়। এছাড়া সন্তান দুটিকে ঢাকায় কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন তিনি। এ অবস্থায় গত ১৮ জুলাই এরিকো শ্রীলংকা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এরই ধারাবাহিকতায় সন্তান দুটিকে আদালতে হাজির করা এবং নিজের জিম্মায় নেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে বাংলাদেশের হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন মা এরিকো।

সূত্র: কালের কন্ঠ