মাশরাফির রাজনীতি নিয়ে ফেসবুকে ঝড়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

মাশরাফি বিন মর্তুজা, বাংলাদেশের ওয়ানডে ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। তাঁর রাজনীতিতে অন্তর্ভূক্তি নিয়ে সরগরম দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।

নির্বাচনের ডামাডোলে প্রাথীরা স্বাভাবিকভাবে আলোচনার ইস্যু হলেও মাশরাফির ব্যাপারটা ভিন্ন।

২০০১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত জাতীয় ক্রিকেট দলের অংশ হয়ে থাকা মাশরাফিকে ক্রিকেটভক্তদের বাইরেও অনেকেই তার নেতৃত্বগুণ ও প্রভাববিস্তারকারী চরিত্রের জন্য আদর্শ হিসেবে ভেবে থাকেন।

তবে এখন যখন মাশরাফি রাজনীতির ময়দানে নাম লিখিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে আসন্ন সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে, তখন মাশরাফিকে নিয়ে জনমানুষের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

মাশরাফি কেনো রাজনীতিতে, তিনি নিজে তাঁর ভেরিফাইড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এর ব্যাখ্যা দিলে সেখানে প্রচুর মন্তব্য আসে।

২০০১, ক্রিকেটের আঙিনায় পথচলা শুরু। আজ ২০১৮। এই প্রায় দেড় যুগে ক্রিকেট যা খেলেছি, জীবন দিয়ে খেলেছি। কখনও আপোস করিনি। আগামী বিশ্বকাপ পর্যন্ত আপোস করতেও চাই না। বাকিটা মহান আল্লাহর ইচ্ছা।

রাজনীতির তাড়না আমার ভেতরে ছিলই। কারণ, সবসময় বিশ্বাস করেছি, রাজনীতি ছাড়া দেশের উন্নয়ন জোরালোভাবে সম্ভব নয়। ক্রিকেট খেলেছি, আপনাদের ভালোবাসা পেয়েছি। নাহলে হয়তোবা ২০১১ সালেই হারিয়ে যেতাম। এই মাশরাফিই হয়তো এতদিনে থাকতো না। ২০১১ সালে আপনাদের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছি, তা আমাকে এই সাত বছর চলতে সহায়তা করেছে। এবার আমার সামনে সুযোগ এসেছে আমার দেশের মানুষের জন্য কিছু করার। বিশ্বকাপের পরের সাড়ে চার বছর আমার জন্য কী অপেক্ষায় আছে, সেটাও জানি না। তাই আমি সময়কে মূল্যায়ন করেছি। সময়ের ডাক শুনেছি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, সময়ের কাজ সময়েই করা উচিত।

বঙ্গবন্ধুকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু তার কথা জেনে, উপলব্ধি করেই বেড়ে উঠেছি। পড়াশোনা করে, অনেকের কাছে শুনে যতটুকু জেনেছি, সেসব থেকেই উনাকে হৃদয়ে ধারণ করেছি। অার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পারিবারিকভাবেই অামার অস্থি-মজ্জায়, মননে-মগজে।
এখন বঙ্গবন্ধু-কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা যে উন্নয়ন কাজ করছেন, তার সারথি হয়ে আমার এলাকার জন্য কিছু করতে চাই। এটা যদি করতে না পারি, তাহলে আমার কাছে মনে হবে, আমার এলাকার প্রতি আমি মোটেও সুবিচার করছি না। বঞ্চিত করছি। ক্রিকেট খেলতে খেলতে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যতটুকু সামাজিক কাজ করেছি; আমার মনে হয়েছে, সেটুকুই যথেষ্ট নয়। আরও বড় পরিসরে করার সুযোগ খুঁজেছি সবসময় এবং রাজনীতি আমাকে সেই সুযোগটা করে দিচ্ছে।

কোনো ব্যক্তি বা কোনো দলকে আঘাত করার জন্য আমি রাজনীতিতে আসছি না। যে যার আদর্শ নিয়ে সুন্দর জীবন-যাপন করবে, পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধে সহনশীল ও সহযোগিতাপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিরাজ করবে, সেটিই আমার চাওয়া।

অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের মতো মানুষ কেন রাজনীতিতে আসবে! সত্যি বলতে, আমি জানি না, আমি কেমন মানুষ। ভালো মানুষ হিসেবে আমার যে পরিচিতি ছড়িয়েছে, সেটাও আমার ভেতর বারবার প্রশ্ন জাগিয়েছে, কেন আমি ভালো মানুষ? দুটি বল করে, আপনাদের কয়েকটি আনন্দের মূহুর্ত উপহার দিয়ে, দু’জনকে জড়িয়ে ধরেই যদি ভালো মানুষ হওয়া যায়, তাহলে স্রেফ এরকম ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছা আমার কখনোই ছিল না। সত্যিকার অর্থেই আমি কেমন মানুষ, আমার বিশ্বাস, সেটি বিচার করার সময় সামনে। যদি আমি নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারি এবং আমার দল সরকার গঠন করে, তার পর আমার কর্মেই ফুটে উঠবে আমি কতটা ভালো মানুষ।

জানি, বলা যত সহজ, কাজ করে দেখানো তার চেয়ে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু চ্যালেঞ্জটা নিতে আমি পিছপা হইনি। চাইলেই আমি নিজের সহজাত পরিবেশের ভেতর থাকতে পারতাম। কিন্তু আমি স্বপ্ন দেখি, আমার এলাকার মানুষ সমৃদ্ধির পথে অারেক ধাপ এগিয়ে যাক। অালো ছড়িয়ে পড়ুক নড়াইলবাসীর উপর। অামি চাই সমৃদ্ধ নড়াইল। সেই পথে আমার যত কষ্টই হোক, অামি থাকবো অামার প্রিয় নড়াইলবাসীর পাশে।

মনোনয়নপত্র কেনার সপ্তাহখানেক আগে আমার মেয়েকে আমি ব্যাংককের সবচেয়ে বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেই সামর্থ্য আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। কিন্তু আমি ভেবেছি, ওই মানুষটির কথা, যে আরও অনেক জটিল রোগে আক্রান্ত হয়েও প্রাপ্য চিকিৎসা পাচ্ছে না। আমি ভেবেছি সেই ছেলে-মেয়েদের কথা, যারা প্রতিভাবান হয়েও মফস্বল থেকে উচ্চশিক্ষার দুয়ার পর্যন্ত যেতে পারছে না। ভেবেছি খেটে খাওয়া সেই মানুষদের কথা, যারা দিন-রাত পরিশ্রম করেও প্রাপ্যটুকু অনেক সময় পাচ্ছে না।

আমি বিশ্বাস করি, বাংলাদেশের সব সচেতন, যোগ্য ও ভালো মানুষের রাজনীতিতে আসা উচিত। অনেকেই হয়তো সাহস করে উঠতে পারেননা নানা কারণে, মানসিক সীমাবদ্ধতায়। আমার মনে হয়েছে, মানসিক বাধার সেই দেয়াল ভাঙা জরুরি। তাই ভেতরের তাগিদ পূরণের উদ্যোগটা আমিই নিলাম। ক্রিকেটের মাঠে দেড় যুগ ধরে তিলতিল করে গড়ে ওঠা মাশরাফির অবস্থান হয়তো আজ অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে রাজনীতির মাঠে নামার কারণে। কিন্তু আমি নিজে সত্যিকার অর্থেই রোমাঞ্চিত নতুন কিছুর সম্ভাবনায়। আমি আশা করি এমন কিছু করতে পারব, যা দেখে ভবিষ্যতে হাজারও মাশরাফি এগিয়ে আসবে ইনশাল্লাহ।

আমি আবারও বলছি, কোনো ব্যক্তি বা দলকে আঘাত করার ইচ্ছে আমার নেই। কেবল সময়ের দাবি মেটানোর চেষ্টা করছি মাত্র। আশা করি, আপনাদের ভালোবাসা আমাকে এই ইনিংসেও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আপনাদের সমর্থন ও দোয়ায় সিক্ত হতে চাই।

সংসদ, নির্বাচন, মাশরাফি

এই প্রতিবেদন লেখার সময় সেখানে প্রায় ৩৬ হাজার মন্তব্য ছিল।

শুধুমাত্র নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলে অংশ নেয়ার কারণে মাশরাফিকে নেতিবাচক মন্তব্য পেতে হয়েছে তাঁর পেইজে। তাদের মধ্যে কিছু বাছাইকৃত মন্তব্য এখানে দেওয়া হলো।

ফখরুদ্দিন নামের এক ব্যক্তি লেখেন, “জগতে মানুষ যে কত রঙের হয় এই আপনাকে দেখে আরেকবার বুঝলাম। ইমরান খান হওয়ার যদি এতই সখ জাগবো তো নিজে আলাদা একটা দল গঠন করলেই ত পারতেন। ঘুরেফিরে চ্যতনার ট্যাবলেট আপনেও খাইলেন।”

শামসুদ্দিন নামে এক ব্যাক্তি মন্তব্য করেন, “রাজনীতি করতে তো কেউ নিষেধ করে নাই। একটি ন্যাশনাল টীমে থাইকা, পাবলিক মানি থেকে বেতন-ভাতা-প্রটোকল সুবিধাদি নিয়া একটা দলের হয়ে ইলেকশান করা নৈতিকতা বিরোধী।”

যদিও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। যেখানে কোনো বেতন-ভাতা জনগণের অর্থ থেকে আসে না।

জুয়েল মাহমুদ বলেন “দোয়া করছি রাজনীতির মাঠে প্রথম বলেই যেনো আউট হয়ে একই সাথে রাজনীতি এবং খেলার মাঠ থেকে বিদায় হয়ে জাতীকে আপনি এবং আপনার প্রিয় নেত্রী উদ্ধার করবেন। নিপাত যাক জননেতা মাশরাফি।”

“…মাশরাফিই একমাত্র প্লেয়ার যার কোন হেটার্স ছিল না। কিন্তু রাজনীতিতে মাশরাফির আসার কথা শুনে কিছু লোক তাকেও গালাগাল করছে। আজ মাশরাফি যদি আওয়ামীলীগের না হয়ে সেই লোকগুলোর দলে যেতো, তাহলে কি তারা গালাগালি করত?…,” এমন মন্তব্য করেন জাকারিয়া জ্যাক নামের একজন।

নেতিবাচক মন্তব্যের পাশাপাশি ইতিবাচক মন্তব্যের সংখ্যাও কম নয়

সংসদ, নির্বাচন, মাশরাফি

মাহামুদুল হাসান নামের একজন আশা প্রকাশ করে মন্তব্য করেছেন, “একজন মাশরাফি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে শত শত মাশরাফি রাজনীতি অঙ্গনে আসবে। এবং এই মাশরাফিদের হাত ধরে সুনাম নষ্ট হওয়া প্রতিহিংসার রাজনীতি থেকে মুক্তি পাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ।”

মাসুদ রানা সেই ফেসবুক পোস্টের নিচে লেখেন, “আপনাকে ভালোবাসার মানুষের অভাব নেই, কয়েকজন হয়ত কটু কথা বলবে কিন্তু নড়াইলের উন্নয়ন দেখে তাদের মুখ হয়ে যাবে বিশ্বাস করি… ক্রিকেটার মাশরাফি-কে যতটা ভালোবেসেছি,লিডার মাশরাফি কেও ততটাই ভালোবাসি…”

মূলত কী লেখা মাশরাফি বিন মর্তুজার সেই ফেসবুক পোস্টে?

মাশরাফি বিন মর্তুজা আওয়ামী লীগের হয়ে মনোনয়ন পত্র কেনার পর থেকেই তাঁর পক্ষে বিপক্ষে নানা ধরণের মন্তব্য শোনা গিয়েছে।

তাই মাশরাফি কেনো রাজনীতিতে এলেন এবং আওয়ামী লীগেই বা কেনো যোগ দিলেন তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন মাশরাফি।

মাশরাফি বলছেন, “ক্রিকেট খেলতে খেলতে সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে যতটুকু সামাজিক কাজ করেছি; আমার মনে হয়েছে, সেটুকুই যথেষ্ট নয়। আরও বড় পরিসরে করার সুযোগ খুঁজেছি সবসময় এবং রাজনীতি আমাকে সেই সুযোগটা করে দিচ্ছে।”

সেই স্ট্যাটাসে তিনি এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “দুটি বল করে, আপনাদের কয়েকটি আনন্দের মূহুর্ত উপহার দিয়ে, দু’জনকে জড়িয়ে ধরেই যদি ভালো মানুষ হওয়া যায়, তাহলে স্রেফ এরকম ভালো মানুষ হওয়ার ইচ্ছা আমার কখনোই ছিল না।”

“সত্যিকার অর্থেই আমি কেমন মানুষ, আমার বিশ্বাস, সেটি বিচার করার সময় সামনে। যদি আমি নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারি এবং আমার দল সরকার গঠন করে, তার পর আমার কর্মেই ফুটে উঠবে আমি কতটা ভালো মানুষ।”

সাবেক ক্রিকেটাররা কী বলছেন?

রাজনীতিতে আসা বা না আসা মাশরাফি বিন মর্তুজার একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছা বলে মনে করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ।

বিবিসি বাংলাকে মি: ফারুক বলেন, “খেলায় এর প্রভাব খুব বেশি পড়বে বলে মনে হয়না। মাশরাফির চরিত্রটাই এমন যে খুব লড়াকু, সমালোচনায় ভেঙ্গে পড়ার মতো নন তিনি।”

তবে মি: ফারুক তার ব্যক্তিগত অভিমত দেন এভাবে, “হয়তো খেলা শেষ করে আসলে ব্যাপারটা ভালো হতো আমার মনে হয়, তবু শেষ পর্যন্ত এটা মাশরাফির ইচ্ছা।”

“যেহেতু খেলোয়াড়ি জীবনও প্রায় শেষের দিকে এবং এরপরের নির্বাচন আসতে আরো ৪-৫ বছর সময় অপেক্ষা করতে হতো সেক্ষেত্রে এবার না হলে রাজনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়তে হতো।”