মার্কিন নির্বাচনে কতটা প্রভাব ফেলবে কোভিড-১৯

বিগত প্রায় ১০০ বছর সরকার গঠনের প্রশ্নে মার্কিন রাজনীতিসচেতন সমাজে যে আদর্শিক বিতর্কটি বিরাজমান সেটি হল, অর্থনীতিতে বাজারের ভূমিকা কেমন হবে-সংরক্ষণবাদী না উদারনৈতিক? এবং রাষ্ট্রের প্রকৃতি কী হবে-কল্যাণকামী না সীমাবদ্ধ?

এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান পার্টির পছন্দ বরাবরই ছিল সীমিত সরকার বা লিমিটেড গভর্নমেন্ট। এ পছন্দের পেছনে রিপাবলিকানদের যুক্তি, বৃহৎ সরকার বা লার্জ গভর্নমেন্ট জনগণের দানবীয় অভিভাবকে রূপান্তরিত হলে মার্কিন সমাজের অন্তর্নিহিত গতিময়তা বাধাগ্রস্ত হতে পারে এবং একই পরিণামে পরিশেষে বিলুপ্ত হতে পারে নাগরিকদের ব্যক্তিস্বাধীনতা।

এহেন আদর্শিক অবস্থানের বিপরীতে বৃহৎ সরকারের পাশেই সর্বদা ডেমোক্রেটিক পার্টির উৎসাহপূর্ণ সমর্থন। তাদের বিশ্বাস, বৃহৎ সরকার ছাড়া নাগরিকদের মৌলিক অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়-যে ক্ষমতাবলে সাধারণত বিনিয়োগকারীরা অধিকতর ঝুঁকি নিতে আত্মবিশ্বাস পান এবং সরকারের যে ভূমিকাটি জনগণকে সম্মানজনক জীবনের নিশ্চয়তা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতি নির্বাচনের প্রাক্কালেই এ বিতর্কের জোয়ার-ভাটা চলে। আর আমার বিশ্বাস, ২০২০ সালের নির্বাচনে এ বিতর্কে বেশি পানি পেয়েছে ডেমোক্রেটিক পার্টিই। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, গোটা মার্কিন সমাজ ডেমোক্র্যাট হয়ে গেছে বা যাবে।

আমি আসলে বলতে চাইছি, প্রধানত কোভিড সংক্রমণের প্রভাবে ভোটারদের মনে ডেমোক্র্যাটদের মূল্যবোধ ও মৌলনীতি যতটা সাড়া জাগাচ্ছে, ততটা পারছে না রিপাবলিকানদের মূল্যবোধ ও মৌলনীতি।

এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তো দেখছি ডেমোক্র্যাটদের এজেন্ডা নিয়ে রিপাবলিকানদের মধ্যে শুরু হয়েছে কাড়াকাড়ি।

বলা বাহুল্য, এটি কোনো মহাপুরুষের অনুপ্রেরণা নয়, এটি কোভিড সংক্রমণে বিপর্যস্ত জনপদে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিয়ে অভূতপূর্ব ভীতির প্রতিক্রিয়া এবং ভীতির সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জনগণ বৃহৎ সরকারের হস্তক্ষেপই প্রত্যাশা করে থাকে।

সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস ও সিয়েনা পোলের এক জরিপে দেখা যায়, দুই-তৃতীয়াংশ মার্কিন নাগরিক চান স্বাস্থ্যবীমাকে সরকারি সুবিধা ঘোষণাপূর্বক ফেডারেল সরকারের আওতায় আনা হোক।

দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিক আরও সমর্থন জানিয়েছেন জো বাইডেনের ২ ট্রিলিয়ন ডলারের নবায়নযোগ্য শক্তি ও জ্বালানি-দক্ষ অবকাঠামোমূলক পরিকল্পনার প্রতি।

ভোটারদের অন্তত ৭২ শতাংশ (যার মাঝে ৫৬ শতাংশই রিপাবলিকান) বলছেন, ফেডারেল ও রাজ্য সরকার পর্যায়ে অতিরিক্ত ২ ট্রিলিয়ন ডলারের আরেকটি পরিকল্পনা নেয়া হোক, যা থেকে সাধারণ নাগরিকরা পাবেন কোভিড-১৯ ত্রাণ সহায়তা।

কার্যত জনকল্যাণমূলক এসব ‘বামঘেঁষা’ নীতি-পছন্দের প্রতি ভোটারদের ঠেলে দিয়েছে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি। কারণটাও স্পষ্ট। মার্কিন নাগরিকদের জনজীবন ও অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে চলমান এ মহামারী। অসহ্য হয়ে উঠছে পরিস্থিতি।

এ অবস্থায় অন্য যে কোনো নাগরিকের মতোই তারাও চান এমন একটি সরকার, যারা পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম। চারজন খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদ এলেক্স রিজ-জোনস, জন ডাটোমা, এমেদিও পিওলাত্তো ও লুকা সালভাদোরির এক সাম্প্রতিক গবেষণা সেদিকেই ইঙ্গিত করে।

গবেষণাটির বিষয়বস্তু ছিল, কোভিডভেদে রাজ্যগুলোর ভোটারদের মনোভাব কেমন অর্থাৎ যে রাজ্যে কোভিডের প্রাদুর্ভাব বেশি সেখানে ভোটারদের মনোভাব কী, আবার যেসব রাজ্যে কোভিডজনিত কারণে মৃত্যুর সংখ্যা কম সেখানকার ভোটারদের মতামত কী।

দেখা যাচ্ছে, কোভিডের কারণে অধিক ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যগুলো সরকারি সহায়তা ও হস্তক্ষেপ বৃদ্ধির পক্ষে। একবাক্যে তারা চাইছেন, বেকারত্ব ও স্বাস্থ্যবীমার আওতা বৃদ্ধি করুক সরকার। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান মতাদর্শে সায় কম তাদের। বেসরকারি খাতের প্রাধান্য না বাড়িয়ে এ ইস্যুতে তারা অন্তত ডেমোক্র্যাটদের মতো চাইছেন, সরকারি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিধি বাড়ুক।

মজার বিষয়, ২০১৫ সালে সিংহভাগ আমেরিকান বিশ্বাস করতেন, অযথা নিজের ওপর বোঝা না বাড়িয়ে সরকারের উচিত কিছু কাজ বেসরকারি খাতে দিয়ে দেয়া। আর এখন মাত্র ৩৯ শতাংশ মানুষ ওই ধারণায় বিশ্বাসী বলে জানাচ্ছে পিউ রিসার্চ সেন্টার।

এদিকে বাকি ৫৯ শতাংশ নাগরিকের ধারণা, চলমান আর্থসামাজিক সমস্যা সমাধানে সরকারের পরিধি ও ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি!

তবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ওপর গুরুত্ব বাড়ছে দেখে এটি ভাবার কোনো সুযোগ নেই যে, ডেমোক্র্যাটদের সংখ্যা বাড়ছে আমেরিকায় কিংবা কোভিডসৃষ্ট মেরুকরণের সুযোগে ডেমোক্র্যাটরা কট্টর বাম অথবা রিপাবলিকানরা আরও রক্ষণশীল হতে চলেছে; তা নয়।

বরং মারসেটাস সেন্টারের চার্লস বাহৌস ও রবার্ট গ্রেবয়েজ যেমন দেখিয়েছেন, তেমনিভাবে আমারও মনে হয় দু’দলই বাঁয়ে সরছে; এ ক্ষেত্রে ডেমোক্র্যাটদের গতি যদি হয় ৩৫০ মাইল ঘণ্টা, রিপাবলিকানরা হয়তো এগোচ্ছে প্রতি ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে।

লক্ষণীয়, ১৯৯৬ সালের জাতীয় সম্মেলনে বাম বাম গন্ধ রয়েছে এমন কিছু এজেন্ডা স্রেফ দূরে রেখে দিয়েছিল ডেমোক্রেটিক পার্টি। এবার সেগুলোর প্রায় সব কটি নিয়েই জোরেশোরে আলোচনা করছে তারা।

অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের জাতীয় সম্মেলনে ‘কম রক্ষণশীল’ বলে বিবেচিত একটি ইস্যুও কিন্তু এবারে বাদ পড়েনি রিপাবলিকান পার্টির আলোচনা থেকে। স্পষ্টতই নির্বাচনী বিতর্কে আদর্শিক পরিবর্তনটি একমুখী নয়। সম্ভবত সে জন্যই দুই পার্টির এবারকার নির্বাচনী এজেন্ডায় দেখা যাচ্ছে একটি ঐতিহাসিক প্যাটার্ন।

সেটি হল কোভিড-১৯, বৈশ্বিক আর্থিক সংকট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কিংবা ৩০-এর মহামন্দা অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যখনই কোনো সংকটে পড়েছে, মার্কিন জনগণের ইচ্ছা তখনই সরকারের পরিধি ও ক্ষমতা বৃদ্ধির পক্ষে ঝুঁকেছে।

এমনকি সীমিত সরকারের বুলি ছেড়ে বর্ধিত সরকারের অনুমোদন দিয়েছেন সংকটকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টরাও। অবশ্য প্রবল সংকটেও বাঁয়ে ঘেঁষতে ঘেঁষতে যুক্তরাষ্ট্র বামানুসারী হয়ে পড়বে, এমনটা মনে হয় না।

পূর্ববর্তী সংকটেও দেখা গেছে, কম-বেশি ৭২ শতাংশ মার্কিন নাগরিক রক্ষণশীল বা মধ্যপন্থী; উদারপন্থীদের সংখ্যা ২৪ শতাংশের বেশি নয়। সবচেয়ে বড় কথা, সংকট যেমনই হোক, গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদের প্রতি মার্কিন জনগণের মৌলিক বিশ্বাস অটুট থাকবে বলে ধারণা; বিশেষত যে দেশে সমাজতন্ত্র অপছন্দকারীর সংখ্যা প্রতি তিন জনগণের দু’জন।

অস্বীকার করা যাবে না, গত প্রায় ৩০ বছরে নব্য উদারবাদী অর্থনীতি বৈশ্বিক দারিদ্র্যের যে হ্রাস ঘটিয়েছে, তা মানব ইতিহাসে অভূতপূর্ব। ১৯৭০-এর দশকে স্ট্যাগফ্লেশন (নিশ্চলতা-স্ফীতি) এবং ১৯৮০-র দশকে ইউরোসেক্লরোসিসের (কঠিনী ভবনের) কথা অনেকের মনে থাকার কথা। সে সময়কার সরকারি নিয়মনীতির চাপে কুঁজো হয়ে পড়া অর্থনীতি ও সমৃদ্ধির মন্থর গতি থেকে বিশ্ব অর্থনীতিকে উদ্ধার করে নব্য উদারবাদী নীতি।

হয়তো সে জন্যই বর্ধিত সরকারের প্রতি জনসমর্থন বাড়তে থাকলেও সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা প্রায় শূন্য। মার্কিনিরা পছন্দ করেন সরকার তাদের দিক কোভিডের ত্রাণ, কলেজের শিক্ষা কিংবা শিশুর প্রয়োজনীয় সেবাযত্ন। এর তলে তলে ওয়াশিংটনে ক্ষমতা আরও পুঞ্জীভূতকরণের ধান্দা তারা সমর্থন করবে না।

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্ভবত এ বিষয়ে অবগত। সে জন্যই ২০১৬ সালের মতো এবারও নির্বাচনী প্রচারণায় সরকারের ভূমিকা নিয়ে তেমন কথা বলছেন না তিনি। তার প্রচারণার মধ্যমঞ্চ বরং মার্কিনিদের আত্মপরিচয়, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি ইত্যাদি ইস্যু। ট্রাম্প জানেন, সরকারের ভূমিকা নিয়ে কচলাকচলি বেশি হলে ভালো হবে না এর পরিণাম। তবে ইচ্ছাকৃত হোক বা অনিচ্ছাকৃত, তার সমীকরণে যে ইস্যুতে কম গুরুত্ব দেখা যাচ্ছে সেটি হল, আত্মপরিচয় ও সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধির পাশাপাশি সম্প্রতি জনমনে দারিদ্র্য, রোগ ও কর্মহীনতা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে কোভিড পরিস্থিতি।

গৃহায়ন, অর্থায়ন ও স্বাস্থ্যসেবা-এ তিন খাতের পারফরম্যান্স তাদের ভাবিয়ে তুলেছে-কতিপয় গোষ্ঠী বা ব্যক্তির কাছে জিম্মি হয়ে পড়ল কি না, হোয়াইট হাউস। এ অবস্থায় নির্দ্বিধায় বলা যায়, রিপাবলিকানরা যেমনটি ভাবছেন ততটা সহজ হবে না ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনের সমীকরণ।

 

সূত্রঃ যুগান্তর