মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত কে এই আল-কায়দার শীর্ষ নেতা?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার প্রধান মতাদর্শী হিসেবে চিহ্নিত আয়মান আল-জাওয়াহিরি। সম্প্রতি আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন আল-কায়েদার এই শীর্ষ নেতা।

একজন শল্য চিকিৎসক ছিলেন আল-জাওয়াহিরি। মিশরে ইসলামি জিহাদ নামে জঙ্গি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেন ২০১১ সালের মে মাসে মার্কিন বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার পর আল-জাওয়াহিরি আল-কায়েদার দায়িত্বগ্রহণ করেন।

ওসামা বিন লাদেনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন জাওয়াহিরি। ওসামা বিন লাদেন বেঁচে থাকা অবস্থায় জাওয়াহিরিকে আল-কায়েদার দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে গণ্য করা হতো।

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার তিনিই ছিলেন মূল পরিকল্পনাকারী এমনটাও ধারণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেডের তালিকায় ছিল তার নাম। তাকে ধরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্র ২ কোটি ৫০ লাখ ডলারের পুরস্কারও ঘোষণা করে।

টুইন টাওয়ার হামলার পরের বছরগুলোতে, জাওয়াহিরি আল-কায়েদার বিশিষ্ট মুখপাত্র হিসাবে আবির্ভূত হন। ২০০৭ সালে ১৬টি ভিডিও এবং অডিওটেপের মাধ্যমে প্রকাশ্যে আসেন এই আল-কায়েদা নেতা।

এর আগেও তাকে টার্গেট করে হামলা চালিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তে তাকে লক্ষ্য করে মিসাইল হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ওই হামলায় আল-কায়েদার ৪ সদস্য নিহত হন। বেঁচে যান জাওয়াহিরি। তার দুই সপ্তাহ পর ভিডিও বার্তা পাঠান তিনি।

১৯৫১ সালের ১৯ জুন মিশরের কায়রোতে জন্ম আয়মান আল-জাওয়াহিরির। মধ্যবিত্ত তবে শিক্ষিত পরিবারে জন্ম তার।
তার দাদা, রাবিয়া আল-জাওয়াহিরি, মধ্যপ্রাচ্যে সুন্নি ইসলামিক শিক্ষার কেন্দ্র আল-আজহারের গ্র্যান্ড ইমাম ছিলেন। তার এক চাচা ছিলেন আরব লীগের প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল।

jagonews24

স্কুলে থাকাকালীন রাজনৈতিক ইসলামের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন জাওয়াহিরি। নিষিদ্ধ ঘোষিত মুসলিম ব্রাদারহুড, মিশরের প্রাচীন ও বৃহত্তম ইসলামি সংগঠনের সদস্য হওয়ার কারণে ১৫ বছর বয়সে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল বিভাগে পড়ার সময়ও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ১৯৭৪ সালে স্নাতক এবং তার চার বছর পর সার্জারিতে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন জাওয়াহিরি। তার বাবার নাম মোহাম্মদ। একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফার্মাকোলজির অধ্যাপক ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে তার মৃত্যু হয়।

জাওয়াহিরি পারিবারিক ঐতিহ্য অব্যাহত রাখতে কায়রোর উপশহরে একটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর তিনি উগ্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হন, সেসময় যারা মিশরের সরকারকে উৎখাত করার আহ্বান জানিয়েছিল। মিশর ইসলামিক জিহাদ, যেটি ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা পায় সেখানে যোগ দেন জাওয়াহিরি।

১৯৮১ সালে কায়রোতে একটি সামরিক কুচকাওয়াজের সময় সৈন্যদের পোশাক পরে বেশ কয়েকজন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে হত্যা করে। এসময় জাওয়াহিরিকেও সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রেসিডেন্ট সাদাত ইসরায়েলের সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং তার শত শত সমালোচককে গ্রেপ্তার করেন। ফলে তার ওপর ক্ষুব্ধ হয় ইসলামপন্থী সংগঠনগুলো।

গণবিচারের সময়, জাওয়াহিরি আসামিদের একজন নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন এবং আদালতকে বলেন ‘আমরা মুসলিম যারা আমাদের ধর্মে বিশ্বাসী। আমরা একটি ইসলামী রাষ্ট্র এবং ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি’। যদিও সাদাতের হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ থেকে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে জাওয়াহিরিকে অস্ত্র রাখার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

তার সহকর্মী ইসলামপন্থী বন্দীদের মতে, জাওয়াহিরি মিশরে কারাগারে থাকার সময় কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিয়মিত অত্যাচারের শিকার হতেন যেটি তাকে ধর্মান্ধ এবং হিংসাত্মক চরমপন্থীতে পরিণত করে।

১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়ার পর জাওয়াহিরি সৌদি আরবে চলে যান। এরপর তিনি পাকিস্তানের পেশোয়ার এবং পরে প্রতিবেশী আফগানিস্তানে চলে যান। সোভিয়েত দখলের সময় দেশে চিকিৎসক হিসাবে কাজ করার সময় মিশরীয় ইসলামিক জিহাদের একটি দল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

jagonews24

জাওয়াহিরি ১৯৯৩ সালে পুনরায় মিশরীয় ইসলামিক জিহাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী আতিফ সিদকিসহ মিশরীয় সরকারের মন্ত্রীদের ওপর ধারাবাহিক আক্রমণের পিছনে নেতৃত্ব দেন।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সরকার পতন এবং দেশে একটি ইসলামিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রুপটির প্রচারণার ফলে এক হাজার দু’শো জনের বেশি মিশরীয় নিহত হন।

১৯৯৭ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে ভ্যানগার্ডস অব কনকয়েস্ট জিহাদি সংগঠনের নেতা হিসাবে নামকরণ করে। একই বছর লুক্সরে বিদেশি পর্যটকদের গণহত্যার পেছনে ইসলামী জিহাদের একটি দল ছিল বলে মনে করা হয়। এ ঘটনার দুই বছর পর মিশরের সামরিক আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

জাওয়াহিরি নব্বয়ের দশকে অভয়ারণ্য এবং অর্থায়নের উৎস সন্ধানে বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ করেন বলে ধারণা করা হয়। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পরের বছরগুলোতে, তিনি বুলগেরিয়া, ডেনমার্ক এবং সুইজারল্যান্ডে বসবাস করতেন বলে জানা যায়। কখনো বলকান, অস্ট্রিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, ইরান এবং ফিলিপাইনেও ভ্রমণ করার জন্য ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেন।

১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে, চেচনিয়ায় বৈধ ভিসা ছাড়াই ধরা পড়ার পর তিনি ছয় মাস রাশিয়ান হেফাজতে কাটিয়েছেন বলে জানা যায়। ১৯৯৭ সালে জাওয়াহিরি আফগান শহর জালালাবাদে চলে যান বলে ধারণা করা হয়, যেখানে ওসামা বিন লাদেন ছিলেন।

এক বছর পর, মিশরীয় ইসলামিক জিহাদ ওয়ার্ল্ড ইসলামিক ফ্রন্ট গঠনের জন্য বিন লাদেনের আল-কায়েদাসহ আরও পাঁচটি উগ্র ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী একত্রিত হয়। ফ্রন্টলাইনে আসার ছয় মাস পর দুটি একযোগে হামলার ঘটনা ঘটে কেনিয়া ও তানজানিয়ার মার্কিন দূতাবাসে। দুই হামলায় ২২৩ জন নিহত হন। জাওয়াহিরি সেই ব্যক্তিদের মধ্যে একজন যাদের স্যাটেলাইট টেলিফোন কথোপকথন থেকে নিশ্চিত হয় যে বিন লাদেন ও আল-কায়েদা ওই হামলার জন্য দায়ী।

jagonews24

হামলার দুই সপ্তাহ পর, যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সংগঠনটির প্রশিক্ষণ শিবিরে বোমা হামলা চালায়। এ ঘটনার পরদিন, জাওয়াহিরি একজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে টেলিফোন করে বলেন ‘আমেরিকাকে বলুন যে তার বোমা হামলা, তার হুমকি এবং তার আগ্রাসন আমাদের ভয় দেখায় না। যুদ্ধ মাত্র শুরু হয়েছে’।

বিন লাদেন নিহত হওয়ার পর মার্কিন বিমান হামলায় জাওয়াহিরির দলের অনেকেই নিহত হয়। সে কারণে বিশ্বব্যাপী সমন্বয় করার ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়ে সংগঠনটির। ৭১ বছর বয়সী জাওয়াহিরিও আত্মগোপনেই ছিলেন।

 

সুত্রঃ জাগো নিউজ