মার্কিন কংগ্রেসে প্রস্তাব এবং আমাদের দায়িত্ব

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি গণহত্যাকে স্বীকৃতির প্রস্তাব করেছেন দুজন মার্কিন আইনপ্রণেতা। প্রস্তাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। সেইসঙ্গে একাত্তরের গণহত্যার জন্য পাকিস্তান সরকারকে বাংলাদেশের জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তাব এবং যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদের বিচার করার জন্যও আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি গণহত্যাকে স্বীকৃতির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশ বলছে, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে কূটনৈতিক প্রয়াস অব্যাহত থাকবে।

আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরে একাত্তরে পাকিস্তানের মিত্র মার্কিন, ক্ষমা এবং বিচারের দাবি তুলছে। যা অনেক আগেই বাস্তবায়ন হবার ছিল। দেরিতে হলেও এমন পদক্ষেপকে স্বাগত জানাতে হয়। এর ফলে আমাদের নতুন প্রজন্ম এবং পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম সঠিক ভাবে জানতে পারবে যে, একত্তরে আসলে কি ঘটেছিল।

 বাংলাদেশ মাত্র ৮ মাস ২২ দিনে পাকসেনারা হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের মতে, এখনো সুযোগ আছে একাত্তরের গণহত্যার পুরো নয় মাসের স্বীকৃতির আদায়ের। সারাবিশ্বই গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার। সরকার আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হলেই দাবি আদায় সম্ভব। বিশ্ব জনমতকে পক্ষে এনে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের এখনই সময়

পাকিস্তানের নতুন প্রজন্মের কথা এজন্যই বলছি কারণ, পেশাগত কারণে আমি অনেকগুলো বছর দেশের বাইরে অবস্থান করেছি। বিদেশে অনেক পাকিস্তানি ছেলের সাথে আমার কথা হয়েছে। তারা বিভিন্ন ভাবে আমাকে প্রশ্ন করেছে, আমরা এক দেশ ছিলাম, কেন আলাদা হয়েছি। আমি বিভিন্ন সময়ে তাদের সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়েছি। বুঝেছি যে তারা একাত্তর সম্পর্কে কিছুই জানেনা।

পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে যারা পছন্দ করেনা, তারা বলেছে সবকিছুর জন্য জুলফিকার আলী ভূট্রো দায়ি। আবার পিপিপি সমর্থক যারা তারা বলেছে, সবকিছুর জন্য ইন্ডিয়া দায়ি। আমি তাদের সত্যটা বোঝাতে চেস্টা করেছি।

এখন আমার মনে হচ্ছে, আজ যখন পাকিস্তানীদের ঘরে ঘরে ক্ষমা আর বিচারের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা উঠবে তখন আসল সত্যটা তাদের প্রতিটি পরিবারের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। বাংলাদেশ সম্পর্কে পাকিস্তানের আমজনতার ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে।

তবে মার্কিন আইনপ্রণেতাদের এমন প্রস্তাবে বসে থাকবে না পাকিস্তান। তাই পাক সরকারের অপচেষ্টা ঠেকাতে বাংলাদেশকে আরো অনেক বেশি তৎপর হতে হবে। গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে ভারত-ভূটানসহ বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে সঙ্গে নিয়ে এগুতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে গত ১৪ অক্টোবর কংগ্রেসম্যান রো খান্না এবং কংগ্রেসম্যান স্টিভ চ্যাবট একাত্তরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে স্বীকৃতি দেয়ার দাবিতে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবের রেজুলেশন শিরোনাম হচ্ছে- ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’।

একাত্তরে পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর যে সহিংসতা চালিয়েছে তাকে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতি আহ্বান জানানো হয় রেজুলেশনে।

এছাড়া পাকিস্তানকে বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এবং যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদের বিচার করার জন্যও আহ্বান জানানো হয় এতে। ১৯৭০ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে নির্বাচনে জয়লাভ এবং পরবর্তীতে ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে তার আলোচনা ব্যর্থ হয় জানিয়ে রেজুলেশনে বলা হয়, জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি তার জেনারেলদের বলেছিল ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করো এবং বাকিরা আমাদের হাত চাটবে। এতে আরো বলা হয়, ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে এবং সামরিক বাহিনী ও উগ্র ইসলামিক দলের সহায়তায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে।

রিপাবলিকান দলের সদস্য স্টিভ চ্যাবট টুইটে লিখেন, ‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার ঘটনা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার ওহিও অঙ্গরাজ্যর সহকর্মীর সহযোগিতায় বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর চালানো নৃশংসতা বিশেষ করে যার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তাকে স্বীকৃতি দেয়ার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’

এরপরের টুইটে স্টিভ চ্যাবট লিখেন, ‘গণহত্যার শিকার লাখো মানুষের স্মৃতিকে আমাদের বছরের পর বছর ধরে মুছে যেতে দেয়া উচিত নয়। এ গণহত্যার স্বীকৃতি ঐতিহাসিক রেকর্ডকে সমৃদ্ধি করবে। এটা হলে দেশবাসীকে শিক্ষিত করবে। সঙ্গে সঙ্গে অপরাধীদের এই বার্তা দেবে- এ ধরনের অপরাধ সহ্য করা হবে না কিংবা কেউ ভুলে যাবে না।’

অন্যদিকে রো খান্না টুইটে লেখেন, ১৯৭১ সালে বাঙালি গণহত্যার স্মরণে প্রথম প্রস্তাব তোলেন স্টিভ চ্যাবট। এ প্রস্তাবে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিস্মৃত গণহত্যার শিকার লাখো জাতিগত বাঙালি এবং হিন্দু নিহত হয়েছেন কিংবা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।’

সব বিচারেই পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের গণহত্যা বিশ্বের ইতিহাসে বৃহৎ গণহত্যা। একাত্তরের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযানে প্রাণ হারিয়েছেন ৫০ হাজার নিরীহ মানুষ। সংখ্যার দিক থেকে বড় গণহত্যা চালায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী। পাঁচ বছরে তারা প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে। গেস্টাপো বাহিনীর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় বছরে গড়ে প্রায় ১২ লাখ মানুষ। আর বাংলাদেশ মাত্র ৮ মাস ২২ দিনে পাকসেনারা হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের মতে, ২৫ মার্চের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির কোনো সুযোগ নেই। এখনো সুযোগ আছে একাত্তরের গণহত্যার পুরো নয় মাসের স্বীকৃতির আদায়ের। সারাবিশ্বই গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার। সরকার আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হলেই দাবি আদায় সম্ভব। বিশ্ব জনমতকে পক্ষে এনে গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের এখনই সময়।

লেখক : সাংবাদিক।

 

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ