মানবিকতা ও উদারতায় অনন্য বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন

সংবেদনশীল সংবিধানের অস্তিত্ব পাওয়া গেলেও সংবেদনশীল রাষ্ট্রের হদিস পাওয়া দুষ্কর। রাষ্ট্র তার জনগণের প্রতি সংবেদনশীল হলে, তা সেই জনগোষ্ঠীর জন্য হতে পারে অনন্য সুযোগ। গণতন্ত্র সম্পর্কিত আব্রাহাম লিংকনের বহুল সমাদৃত উক্তি  ‘Democracy is a government of the people, by the people and for the people. A democratic government shall not perish from the earth’

-এ কিছুটা সংবেদনশীলতার পরিচয় দিলেও ধারণাটির পরিপূর্ণতা পেয়েছে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাষ্ট্রভাবনায়। শুধু ভাবনাগত ঐক্য নয়, বরং বাঙালির জন্য তাঁর রাষ্ট্রদর্শন ছিল অত্যন্ত ভাবাবেগপূর্ণ ও মানবতাপূর্ণ। তিনি ছিলেন ধনতান্ত্রিকতা ও সমাজতান্ত্রিকতার ঊর্ধ্বে। তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে স্বৈরাচারিতা কিংবা নামসর্বস্ব গণতন্ত্র ছিল প্রত্যাখ্যাত। এমন শাসনব্যবস্থায় তিনি আস্থা রাখতেন, যা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কথা বলে, সবাইকে মানবিক গুণাবলির সঙ্গে বাঁচার সুযোগ করে দেয়।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনের পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে মুক্তিসংগ্রামে আত্মনিয়োগে ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল—জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।’ সমাজতান্ত্রিক শোষণহীন দর্শনকেই তিনি সর্বোচ্চ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হিসেবে বিশ্বাস করতেন। তাঁর বক্তব্যেই এ কথা প্রমাণিত হয়। তিনি বলেন, ‘আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিকতা নয়। আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন সমাজব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরাতন সমাজব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।’

বঙ্গবন্ধুর সমাজতন্ত্রের আরো পরিষ্কার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘মানুষের উপর মানুষের শোষণ হইতে মুক্ত ন্যায়ানুগ ও সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হইবে।’ ১৯৭২ সালে স্বাধীনতা দিবসে এক টিভি ভাষণে তিনি এ কথাগুলো উদ্ধৃত করেছিলেন। তাঁর রাষ্ট্রদর্শন যে সমাজতান্ত্রিক স্থবিরতায় আবদ্ধ নয়, সেটিরও প্রমাণ মিলবে তাঁর একান্ত পৃষ্ঠপোষকতায় প্রণীত বাংলাদেশ সংবিধানের প্রস্তাবনায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা, যেখানে সব নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’

আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্তর্ভুক্ত করে এটিকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা অনন্য এবং প্রশংসনীয়। আবার জনগণ যেন ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতার সঙ্গে মিলিয়ে না ফেলে সেই মর্মে তিনি বারবার বিষয়টিকে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি বলেছিলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে।’

আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনের প্রায়োগিক ও বাস্তবভিত্তিক দার্শনিক ম্যাকিয়াভেলির মতো বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনায় জাতীয়তাবাদকে সর্বোচ্চ শিখরে স্থান দিয়েছেন। তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে কোথাও কোনো প্রকার সংকীর্ণতার ছাপ পাওয়া যায়নি। তিনি অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক রাখতে চাননি। তাঁর নির্দেশেই বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির মূলমন্ত্র অনুসৃত হয়— Friendship to all, malice to none. তিনিই বাংলাদেশকে জাতিসংঘ ও ওআইসির সদস্যভুক্ত করেন। তৎকালীন বিশ্বে চলমান যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যকার ঠাণ্ডাযুদ্ধ থেকেও তিনি বাংলাদেশকে মুক্ত রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। এর ঊর্ধ্বে তিনি জোটনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকটি হচ্ছে, তিনি সর্বদা স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করতেন এবং এই অটল বিশ্বাস থেকে কখনো সরে আসেননি। ১৯৭১ সালের ২১ মার্চ সকালের কথা। সিআইএ-এর সাবেক মার্কিন কর্মকর্তা জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সাক্ষাৎ করতে আসলেন। যদিও বিষয়টি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর আগে থেকেই ধারণা ছিল। কারণ তিনি জানতেন, বাঙালিরা স্বাধীনতার প্রশ্নে আর পিছু হটবে না—এই ব্যাপারটি সম্পর্কে মার্কিনরা নিশ্চয়ই এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে। তাই মার্কিনরা যে স্বাধীনতার প্রলোভন দেখিয়ে অনৈতিক দাবি করবে—বিষয়টি অবধারিত এবং হলোও তাই। ফারল্যান্ড আসলেন এবং বঙ্গবন্ধুর কাছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবটি পেশ করলেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সব ধরনের সাহায্য ও সুবিধা দিতে প্রস্তুত, এমনকি তারা বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতার ব্যবস্থাও করে দেবে। তবে এক শর্তে। শর্তটি হলো : চট্টগ্রাম থেকে ১৫০ মাইল দক্ষিণে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমার মধ্যে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সেন্ট মার্টিন দ্বীপটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা দিতে হবে। প্রস্তাবটি বঙ্গবন্ধু শোনামাত্র শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, ফারল্যান্ডকে বলেছিলেন :

‘মিস্টার ফারল্যান্ড, আমি আপনাকে চিনি। ইন্দোনেশিয়া ও আর্জেন্টিনায় আপনি সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন তা-ও জানি। মনে রাখবেন, আমি আমার দেশকে পাকিস্তানি শেয়ালদের হাত থেকে মুক্ত করে আমেরিকান বাঘদের হাতে তুলে দিতে পারি না। আপনাদের এই ধরনের শর্ত আমার কাছে কখনো গ্রহণযোগ্য হবে না। হতেও পারে না।’

বঙ্গবন্ধুর এমন দৃঢ়তা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে যে তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কতটা অনড় ছিলেন। শুধু তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন ছিল সবচেয়ে বেশি প্রায়োগিক ও জনকল্যাণমুখী। তাঁর রাষ্ট্রদর্শন কখনো একটি তাত্ত্বিক বেড়াজালে আবদ্ধ থাকেনি। জনগণের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার, ন্যায়বিচার যাতে নিশ্চিত হয়, তার জন্য তিনি বড় কোনো বিপ্লব ঘটাতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করেননি।

দরিদ্র, নিষ্পেষিত মানুষ যেন তার অধিকার পায় এবং মানবিক গুণাবলির সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে, এই লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন সর্বদা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। আজ আমরা যে টেকসই উন্নয়নের কথা বলছি, অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থার কথা বলছি, সমতাভিত্তিক অংশীদারিমূলক সমাজকাঠামোর কথা বলছি, আমাদের মহান জাতির পিতা আজ থেকে প্রায় অর্ধশতাব্দী আগেই এর বীজ বপন করেছেন। আমাদের এখন যেটুকু করতে হবে তা হলো, এই বীজ থেকে গজিয়ে ওঠা চারাকে পরিচর্যার মাধ্যমে মহীরুহে রূপান্তরিত করা। তাহলেই বাঙালি জাতি তার ফল ও ছায়া প্রজন্মের পর প্রজন্ম উপভোগ করতে পারবে।

 

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

akmmahmudul@ru.ac.bd

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ