নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে জমি থেকে তোলা সবুজ কাঁচা টমেটো ঝকঝকে পরিস্কার করতে ব্যবহার করা হচ্ছে শ্যাম্পু। এরপর লাল টকটকে করে পাকা রং ধারণ করতে ব্যবহার করা হচ্ছে ইথিফন। সেই টমেটোতে পচনরোধে ছিটানো হচ্ছে ছত্রাকনাশক ডায়াথেন। এভাইে রাজশাহীর গোদাগাড়ীদে চলছে শীতকালীন টমেটো বাজারজাতের প্রক্রিয়া।
- প্রতি বছরের মত এ বছরও গত প্রায় এক মাস ধরে এ প্রক্রিয়ায় জমি থেকে সবুজ রং-এর কাঁচা টমেটো পাকানোর কাজ করছেন গোদাগাড়ীর কয়েক হাজার কৃষক। কিন্তু এখন পর্যন্ত এঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মাঠে দেখা যাচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসনকে।
অথচ মানবদেহের জন্য ভয়ঙ্কর ক্ষতিকারক হলো এসব কিটনাশক। খাদ্যে পণ্য টমেটোর দাম বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হচ্চে। আর সেগুলোই বাজারজাত করে মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন অসাধু কৃষকরা।
কেউ জেনে এসব বিষ মেশাচ্ছেন টমেটোতে আবার কেউ না জেনেই করছেন শুধু অতিরিক্ত দামের আশায়।তবে একটু সচেতনতার উদ্যোগ নিলেই এসব কৃষক হয়তো মানবদেহের জন্য সর্বনাশা এসব কীটনাশক টমেটোতে মেশাবেন না বলে দাবি করেছেন স্থানীয়রা।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম জানান, এবার জেলার গোদাগাড়ীতে টমেটো চাষ হয়েছে দুই হাজার ৪২০ হেক্টর জমিতে। প্রতি হ্টের জমি থেকে আনুমানিত ৩০ মেট্রিক টন করে টমেটো পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেই হিসেবে এবার টমেটোর উৎপাদন হবে প্রায় ৭২ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন।
- সরেজমনি ঘুরে দেখা কৃষক ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাকানোর জন্য এবং লাল রং করার জন্য টমেটোতে ‘শ্যাম্পু’ ‘ইথিফন’ ও ‘ডায়াথিন এম’ জাতীয় রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্চে। যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। কিন্তু তারপরেও এবারো দেদারছে একই উপায়ে টমেটো পাকানো হচ্ছে।
সরেজমিন ঘুরে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজার থেকে হরমন কিনে এনে কৃষক এবং ব্যবসায়ীরা তাঁদের ইচ্ছেমতো জমি থেকে তুলে আনা কাঁচা টমেটোতে সেই হরমন প্রয়োগ করছেন। স্প্রে মেশিনের সাহায্যে সেগুলো স্প্রে করা হচ্ছে টমেটোতে। এরপর একদিন রোদে শুকিয়ে খড়, পলিথিন দিয়ে সেগুলো ঢেঁকে (চাপা) রাখা হচ্ছে।
- এভাবে দুই-তিন দিন ঢেঁকে রাখার পরে আবার সেগুলো রোদে শুকানো হচ্ছে। তারপর আবার একদিন ঢেঁকে রাখা হচ্ছে। পরের দিনই হয়ে যাচ্ছে লাল টকটকে পাকা টমেটো। এরপর তখন সেই টমেটো প্যাকেটজাত করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
এভাবে প্রতিদিন গোদাগাড়ী থেকে শতশত মেট্রিক টন টমেটো যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থনে। আবার কিছু পরিমাণ রাজশাহীর বাজারেও বিক্রি হচ্ছে।
- ব্যবসায়ী ও কৃষকরা জানান, কিছু পরিমাণ কাঁচা টমেটো প্যাকেটজাত করেও পাঠানো হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে এর পরিমাণ খুবই কম। কাঁচা টমেটোর দাম মণ প্রতি তিন থেকে চার শ টাকা হারে কম হওয়ায় ব্যবসায়ী ও কৃষকরা বেশি মূনাফা লাভের আশায় বিষাক্ত হরমন মিশিয়ে পাকানোর পরে সেগুলোই বেশি বিক্রি করছেন। পাকা টমেটো পাইকারী বিক্রি হচ্ছে ১১-১২ শ টাকা মণ দরে এবং কাঁচা টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৭-৮ শ টাকা মণ দরে।
দোগাড়াীর রাজাবাড়ী এলাকার কৃষক মুনসুর রহমান বলেন, এ বছর তিনি প্রায় তিন বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছেন। এ সময় জমিতে টমেটো পাকানো দুস্কর। শীতের কারণে টমেটো পাকতে দেরি হয়। আবার গাছে পাকলেও সেগুলো পাখিতে খেয়ে ফেলে। কাজেই কাঁচা টমেটো জমি থেকে তুলে এনে সেগুলোতে হরমন জাতীয় কিটনাশক মিশিয়ে পাকাতে বাধ্য হতে হয়।’
- তিনি আরো বলেন, ‘এসব না মেশালে টমেটো ১৫ দিনেও পাকবে না। বাড়িতে থেকে থেকেই পচে যাবে। এই কারণে হরমন স্প্রে করতে হয়। এতে করে টমেটো পাকার সঙ্গে সঙ্গে এর রং লাল টকটকে হয়। তখন দামও ভালো পাওয়া যায়। এছাড়া কাঁচা টমেটোর দাম বেশি পাওয়া যায় না।’
অপর এক কৃষক আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘বাজার থেকে বিভিন্ন কম্পানীর ওষুধ কিনে এনে নিজেরাই ছেটাই টমেটোতে। আবার ব্যবসায়ীরাও কাঁচা টমেটো কিনে নিয়ে তাতে ওষুধ ছিটিয়ে লাল করে দেশেরে বিভিন্ন স্থানে পাঠাচ্ছে। যতটুকু দিলে টমেটোর রং উজ্জ্বল এবং লাল হবে ততটুকুই দেওয়া হয়। কি পরিমাণ মেশালে মানুষের ক্ষতি হবে, কি হবে না তা কৃষকরা সাধারণত জানেনও না।’
- আরকে কৃষক আকবর হোসেন বলেন, টমেটোতে মেশানো ওষুধ মানুষের দেহের কোনো ক্ষতি করে না বলে শুনেছি, তাই আমরা এগুলো দেই টমেটো পাকাতে। না পাকালে দাম পাওয়া যায় না। টমেটো চাষ করে লোকসান গুনতে হয়, তাই বাধ্য হয়েই টমেটোতে ওষুধ দিয়ে পাকায়।
তবে গোদাগাড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘টমেটোতে শ্যাম্পু, ইথিফন ও ডায়াথিনের মতো রাসায়নিক উপাদান যোগ করার ফলে এসব টমেটো খেলে মানুষের পেটের পীড়া, কিডনী বিকল এমনকি ক্যান্সারের মতো দুরারোগ্য রোগের ঝুঁকি থাকে। তাই এসবের বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে সচেতনতামূলক কাজ আমরা দ্রুত শুরু করবো।’
স/আর