মনের চোখ দিয়ে দেখতে না পারাকে কী বলবেন?

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বেশিরভাগ লোকেরা তাদের চোখ বন্ধ করে এবং তাদের মাথার ভেতরে নানা ধরণের ছবি আঁকতে পারে। যেমন ভেড়ার সংখ্যা গণনা করা বা প্রিয়জনের মুখ কল্পনা করা।

কিন্তু পিক্সার ও ওয়াল্ট ডিজনি অ্যানিমেশন স্টুডিওর প্রাক্তন সভাপতি এড ক্যাটমুল অ্যাফান্তেসিয়ায় আক্রান্ত। অ্যাফান্তেসিয়া এমন এক মানসিক সমস্যা যার কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি তার মনের ছবিগুলোকে কল্পনায় একেবারেই দেখতে পারেননা।৭৪ বছর বয়সী এডের মতে, তার “মনের চোখ অন্ধ”

এড ক্যাটমুল তার সাবেক কর্মীদের সেইসঙ্গে বিশ্বসেরা এনিমেটরদের বিস্ময়কর জরিপে এমন নানা তথ্য জানতে পারেন।

তার ওপর ভিত্তি করে এড থ্রিডি গ্রাফিক্সে বিপ্লব আনেন। এবং তিনি বক্ররেখার পৃষ্ঠতলকে অ্যানিমেশন করার একটি পদ্ধতি বের করেন। যেটা এই শিল্পের একটি আদর্শ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এড, প্রথম তার এই সমস্যার ব্যাপারে জানতে পারেন, যখন তিনি তার সহকর্মীর সঙ্গে তিব্বতি ধ্যান করেন।

এই ধ্যানের মূল অংশ জুড়ে ছিল ভিজুয়ালাইজেশন বা কল্পনায় ছবি দেখা। তখনই তিনি বুঝতে পারেন তার মস্তিষ্ক অন্যদের থেকে আলাদা।ধ্যানের সময় এডকে একটি গোলকের ছবি কল্পনায় দেখতে বলা হয়।

এড বলেন, “আমি বাড়ি গিয়ে চোখ বন্ধ করেছিলাম … আমি কিছু দেখতে পাইনি। এবং এর পরের পুরো সপ্তাহ ধরে আমি এই গোলকটি দেখার চেষ্টা করেছি।”

তিনি সহকর্মীদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছিলেন যে কিছু অ্যানিমেশন শিল্পীদের মানসিক ছবি তৈরির ক্ষমতা এতোটাই বেশি থাকে যে, চোখ খোলার পরও সেই চিত্রটি তারা দেখতে পায়।

এড মনে করেন: “এটি বেশ আকর্ষণীয়, সম্ভবত এই গুণটি তাদের শিল্পী করে তোলে।”

গ্লেন কেইন:

আবার বিষয়টি পুরোপুরি উল্টোও হতে পারে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অ্যানিমেশন শিল্পীদের অনেকেই মনে কোন ছবি আঁকতে পারেননা।

তাদের মধ্যে একজন গ্লেন কেইন। যিনি একজন অস্কারজয়ী এবং মৎস্য-কন্যা, দ্য লিটল মারমেইডের মূল চরিত্র এরিয়েলে চরিত্রটি তারই আঁকা। অথচ তিনি কল্পনায় ছবি আঁকতে পারেননা।

এড বলেন, “কেইন পুরোই আলাদা, তিনি ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ এনিমেটরদের একজন, যিনি হাতে একে অ্যানিমেশন করতেন।”

“কেইন জানিয়েছেন যে তিনি কখনোই কল্পনা করতে পারেন না।”

এড বলেন: “যখন তিনি প্রথমে লিটল মারমেইড এঁকেছিলেন তার সেই ড্রয়িঙটি অনেকদিন কাগজের স্তূপে পড়ে ছিল।”

“এবং তারপর তিনি এটি নিয়ে আরও কাজ করা শুরু করেন এবং ড্রয়িংটিকে একটি দৃষ্টিনন্দন শিল্পকর্মে পরিণত করেন।”

“এবং এখন তিনি একটি বিষয় নিয়ে বেশ সচেতন আর সেটা হল দিন শেষে তিনি তার কাজটাকে বোঝেন, সেটাকে কিভাবে করতে হয় তার সঠিক উপায় জানান।”

“তার মানে তিনি তার মনের গভীরে যেতে পারেন। সেটা তার আবেগের জন্যও সম্ভব হতে পারে। এবং এজন্য তিনি আঁকাআঁকিতেই জড়িয়ে পড়েন।”

আফান্তাসিয়ার উৎস:

২০১৫ সালে এক্সেটার মেডিক্যাল স্কুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অ্যাডাম জেমান আফান্টাসিয়া শব্দটির কথা প্রথম বলেন।

তিনি উদাহরণস্বরূপ এক ব্যক্তির কথা বলেন যিনি তার মনের দৃষ্টি তার ষাট বছর বয়সের মাথায় হারিয়ে ফেলেন।

অধ্যাপক জেমান তখন এ ধরণের ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ রাখতেন। এরপর তিনি এই সমস্যাটিকে কর্টেক্স পত্রিকায় অ্যাফান্তাসিয়া নাম দেন।

প্রায় ৫০ জনের মধ্যে একজন অ্যাফান্তাসিয়ায় আক্রান্ত বলে ধারণা করা হয়। যদিও কার মস্তিষ্কের ভেতরে কি হচ্ছে তা এখনও অস্পষ্ট।

মস্তিষ্কের সামনের এবং দুই পাশের কিছু অংশ এই কল্পনায় দেখতে পাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়া করে থাকে। এবং এই পুরো সিস্টেমের কোথাও অস্বাভাবিকতা থাকলে এমন সমস্যা দেখা দিতে পারে।

পিক্সারের ফলাফল

পিক্সারের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এড গত বছর যখন চাকরি ছেড়ে চলে গেলেন তখন তিনি তার কর্মচারীদের জন্য এক টুকরো হোমওয়ার্ক বা বাড়ির কাজ উপহার হিসেবে রেখে যান।

তার অধীনে থাকা ৫৪০ জন কর্মকর্তার কল্পনার দৃষ্টি কতোটা প্রখর ও প্রাণবন্ত সেটা পরীক্ষা করতে তিনি সবাইকে একটি অনুশীলনে অংশ নিতে বলেন। এবং তিনি এর ফলাফল নিম্নক্ত কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন।

১. সমস্ত কর্মী

২. কারিগরি শিল্পী – যাদের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং শিল্পকর্মের শক্তিশালী পটভূমি রয়েছে।

৩. শিল্পী – অ্যানিমেশনকারী, চলচ্চিত্র ডিজাইনার বা স্টোরিবোর্ড শিল্পী।

৪. প্রোডাকশন ম্যানেজার -চলচ্চিত্র স্কুলের বাইরের সেসব ব্যক্তি যারা পুরো প্রোডাকশনের আয়োজন করে থাকেন।

সেখানে দেখা যায় যে, কল্পনাশক্তির দিক থেকে প্রকৌশলীদের থেকে শিল্পীরা কিছুটা এগিয়ে আসেন। তবে সেই ব্যবধান খুব একটা বড় নয়।

তবে প্রোডাকশন ম্যানেজার দুই পক্ষের চাইতে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে ছিলেন।

হোমওয়ার্কে এডের দুই শিল্পী বন্ধুর মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্য দেখা যায়। ওই দুইজনই জনপ্রিয় এনিমেশন ছবি ফ্রোজেনে কাজ করেছিলেন।

ওই দুইজনের মধ্যে একজন তার মাথার মধ্যে একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্র দেখতে পারেন, সেইসঙ্গে তিনি ছবিটির পেছনে বা সামনের দিকেও যেতে পারেন। এজন্য তার একটি ছবি একবারের বেশি দেখার প্রয়োজন হয়না। কারণ তিনি সেটা কল্পনায় দেখতে পারেন।

অন্যদিকে অপর ব্যক্তি কোন কিছুই কল্পনা করতে পারেন না।

অ্যাফান্তাসিয়া থেকে যা শেখার আছে

অ্যাফান্তাসিয়ায় আক্রান্ত কিছু ব্যক্তি একে কষ্টের কারণ বলে মনে করেন।

যখন তারা জানতে পারেন যে অন্যান্য মানুষেরা তাদের মস্তিষ্কে ছবি দেখতে পারেন, যেটা কিনা তারা পারেননা, তারপর থেকে তাদের অনেকেই নি:সঙ্গ ও একাকীত্ব বোধ করেন।

তবে এড দাবি করেছেন যে অ্যাফান্তাসিয়া কারও সাফল্যের পথে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না।

তিনি বলেছিলেন: “আপনি অ্যাফেন্তেসিয়াকে কোন অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন না, আপনি আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও এখনও নিশ্চিন্তে ভাল ভাল কাজ করতে পারবেন।'”

এড বিশ্বাস করে যে, এই গবেষণায় সৃজনশীলতা সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণাগুলো দূর করতে সহায়তা করেছে।

তিনি বলেন: “মানুষ এখন তার ভিজ্যুয়ালাইজেশনের সাথে তার সৃজনশীলতা ও কল্পনাকে গুলিয়ে ফেলছে। এমন অবস্থায় এটা জেনে রাখা জরুরি যে, এই তিনটি বিষয় এক জিনিস নয়।”

” মানুষ হয়তো কিছু বিষয় ভাবতে পারে, কিন্তু যদি আপনি একই বিষয়ে ভাবেন তবে আপনি দেখতে পারবেন যে কেন সেই ভাবনার মধ্যে মিথ্যা ধারণাও আছে।, আপনি যদি মনে করেন যে একজন ব্যক্তি কল্পনা করতে পারে তবে ধরে নেয়া যেতে পারে যে তারা অঙ্কন করতেও সক্ষম হবেন।”

“আপনি আপনার চোখ খুলুন এবং একটি পেন্সিল এবং কাগজ হাতে নিন। কতজন মানুষ আছেন যারা নিজেদের কল্পনার ছবি আঁকতে পারবেন। উত্তর হল, সেই সংখ্যাটি খুবই ক। তাই আপনি যদি মনে করেন যে আপনি আপনার সামনে থাকা বস্তুটির আঁকতে পারছেন না। তাহলে আপনি মনের দৃষ্টিতে দেখা বিষয়টিকে আঁকতে পারবেন এমন আশা রাখাটাও অযৌক্তিক।”

এডের আফান্তাসিয়া থাকলেও ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি বেশ স্পষ্ট। কেননা তার স্ত্রীর কল্পনাশক্তি বেশ দৃঢ়।

এড তার স্ত্রীর সাথে প্রথম দেখার কথা মনে করতে পারেন। আর তার স্ত্রী সেই পার্কের কথা, আশেপাশে কি ছিল তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারেন।

অধ্যাপক জেমান, যিনি অ্যাফান্তাসিয়া নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেছেন, তিনি বলেন: “মানুষ কিভাবে তার মনের দৃষ্টি দিয়ে দেখে সেটা মানুষকে জানানো আরও বেশি সহায়ক হবে। তবে এই দেখা বা না দেখার বিষয়টি কাউকে আলাদাভাবে সংজ্ঞায়িত করেনা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

“যদিও আমাদের সকলের চিন্তার প্রক্রিয়া ভিন্ন, এবং এর সাথে আপনার কাজের মানের কোন যোগসূত্র নেই।