মনিরুজ্জামান শেখ রাহুলের ছোটগল্প ‘আশিকের ঈদ’

সিল্কসিটিনিউজ সাহিত্য ডেস্ক:

সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। চক্রবায়ুতে উত্তেজিত সমুদ্রের স্রোতের মতো মানুষের ছুটাছুটি রাস্তায়। রীতিমতো দৌড়াদৌড়ির জোয়ার উঠে গেছে। প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই যানবহনগুলো। চলছে বাতাসের গতির সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে। চারিদিকে পড়েছে হৈ চৈ। আর বেশী সময় নেই। সন্ধ্যা ছয়টা পঞ্চাশ মিনিটে ইফতার হবে। সারাদিন পুষ্পকলির মতো এই মোড় নিশ্চুপ থাকলেও ইফতারের আগে বেড়ে যায় মানুষের ব্যস্ততা। ব্যস্ততা বাড়বে না কেন?
রোজাদার মানুষদের সময়মত ইফতার করার নিমিত্তে এতো আয়োজন। ব্যস্ততম এই মোড়ের এক কোণায় বায়ুহীন পরিবেশের বৃক্ষের মতো দাঁড়িয়ে আছে আশিক। হাতে আছে একটি বিবর্ণ রঙের ব্যাগ। সেখানে রয়েছে কিছু পুরাতন খাতা। বাড়িতে গুড় ও মুড়ি আছে। সেগুলো দিয়ে ইফতার হয়ে যাবে।
কিন্তু ইমাম সাহেবের কাছে জেনেছে, খেজুর দিয়ে ইফতার আরম্ভ করা উচিত। তাই খাতাগুলো বিক্রি করতে এসেছে। বিক্রি করে পাওয়া দশ টাকা দিয়ে খেজুর কিনে বাড়ির দিকে রওনা হয় আশিক। তের বছর বয়সী বালকটি রোজা আছে। রজনীগন্ধার মতো লম্বা গড়নের শরীর আশিকের। মা বিলকিস বেগম রোজা থাকতে বাঁধ সাধে। বলে, আরো বড় হয়ে রোজা থাকতে। দুর্বলতার কষাঘাতে মাঝেমধ্যে শারীরিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে ছেলেটি নীলবর্ণধারী হয়ে যায়। এজন্য মা বলেছে আরেকটু বড় হলে রোজা রাখতে। কিন্তু আশিক তা মানতে নারাজ। রোজা রাখা ফরয। সেটা অমান্য করা যাবে না। প্রবল ইচ্ছার জোরেই রোজা আছে। কোন রকমে তিনবেলা খাবারের যোগাড় হয় তার পরিবারের। হিসাবের বাইরে কোন খরচ এসে দন্ডায়মান হলে যেন দিশাহীন তরীর মতো তাদের অবস্থা হয়ে যায়। খেজুর শেষ হয়েছে দেখে মায়ের কাছে টাকা চাই নি। নিজের পুরানো খাতাগুলো বিক্রি করে নিয়ে খেজুর নিয়ে এসেছে। মা তো অবাক হয়। আশিক পুরাতন খাতাগুলো বিক্রি করে খেজুর নিয়ে এসেছে। কি দরকার ছিলো।
আশিক জানায়, পারিবারিক মন্দা সে ভালোভাবেই বোঝে। সেজন্য এমনটা করেছে। মা খুশী হয়। ইফতার শেষে নামাজ আদায় করতে যায়। নামাজ শেষে বাড়িতে গিয়ে বসে পড়ার টেবিলে। কিছুক্ষণ পর কানে ভেসে আসে পাশের বাড়ির টিভি থেকে ঈদের বিভিন্ন পোশাকের বিজ্ঞাপন। আজ আঠাশ রমজানের রাত। মানেই ঈদের রেশ পড়ে গেছে। ওইসব চ্যানেলগুলোতে নাটক, সিনেমা চলাকলীন স্বাভাবিক শব্দ বিরাজ করলেও, ঈদের বিজ্ঞাপন শুরু হলেই সেই শব্দ বজ্রের আকৃতি ধারন করে। ক্রমশই শব্দ বাড়তেই থাকে।
আশিকের পড়ার মনোযোগে ভাটা পড়ে। স্বপ্নের রাজ্যের দুয়ার দিয়ে প্রবেশ করে ঈদের দিনে। চকচকে প্যান্ট ও পছন্দের শার্ট পরিধনে তাকে দারুন লাগছে। স্যান্ডেল জোড়াও বেশ মানিয়েছে, চোখে উঠানো হয়েছে রঙ্গিন চশমা, চুল কেটেছে নায়কের মতো। নিজের অলক্ষ্যেই স্বপ্নের সাগরে নিমজ্জিত হতে থাকে। আরো গভীরে ডুবে যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। সেখানে সে কি শুধু নিজের শরীর দেখছে? স্থান ও কালের পরিবর্তন ঘটছে। মায়ের হাতের সুস্বাদু খাবার খাচ্ছে, এলাকার বায়োজৈষ্ঠরা পরবি দিচ্ছে। চকচকে নোট । টাকাতেও সুগন্ধ পাচ্ছে আশিক। হঠাৎ বিলকিস তাকে ডাকল। স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে রেলগাড়ি চলে যায়। স্বপ্নটা ভালো ছিল। রাতে তার বাবা তুহিন বাড়িতে এলে সিদ্ধান্ত নেয় কালকে তার বাবা বাজারে সবজি কিনতে গেলে সেও যাবে। যেয়ে দেখবে ঈদের পোশাক।
পরের দিন বাবার সাথে সাইকেলে চড়ে সবজির বাজারে যায়। সবজির বাজারের পাশে শার্ট-প্যান্টের দোকান। সেখানে অবিকল মানুষের মতো পুতুলে সাজানো আছে বিভিন্ন শার্ট ও প্যান্ট। হঠাৎ সবুজ রঙের একটি শার্ট তার দৃষ্টি কেড়ে নেয়। সামনে যেয়ে দেখে শার্টের দাম এগারশত টাকা। দাম দেখেই হতাশার ছোঁয়ায় উদাস হয়ে যায়। তুহিন দেখে আশিক সবুজ রঙের শার্ট দেখছে। বাজার শেষে আশিককে নিয়ে বাড়ির দিকে যেতে থাকে। যাবার পথে আশিক বাবাকে জিঙ্গাসা করে, আব্বু, কাপড় কিন্যা শার্ট বানাতে কত টাকা ল্যাগবে?
পাঁচশ টাকা হবে।
তাহলে তুমি আমাকে শার্ট বানিয়ে দিও।
শুধু শার্ট ক্যান? শার্ট-প্যান্ট দুইটাই বানিয়ে দিব।
নিজাম চাচা তার ছেলের একটা পুরাতন প্যান্ট দিয়েছে। পুরাতন হলেও সার্ফ এক্সেল দিয়ে ধুলেই হয়্যা যাবে। আর গত ঈদের স্যান্ডেল এখনও নতুন হয়্যা আছে।
ঠিক আছে, ত্যাহেলে শার্ট বানিয়ে দিবনি।
কথাটি বলার পরেই হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তিনি একটি দোকানের কর্মচারী। ঈদের বাকি আর কয়েকদিন। কিন্তু আজ অবধি হাতে এসে পৌছায় নি বোনাস। দুই সপ্তাহ থেকে বোনাস চাইছে। তবুও বোনাসের খাতা বন্ধ পড়ে থাকে। দোকানের মহাজন মশাই মনে করেন বোনাস দিয়ে কর্মচারীরা ঠিকমত কাজ করবে না। এটা কেমন বিবেকবান মানুষের চিন্তা-ভাবনা? তার হিসাব ঠিকমত মিলিয়ে উঠতে পারে নি তুহিন। নিজে বা স্ত্রীর জন্য নতুন পোশাক না হোক। আশিকের জন্য একটা শার্ট এনে দিতে পারলেই সেটাই তুহিনের কাছে ঈদ হবে। নাহ্, অপেক্ষা করতে পারল না তুহিন। মহাজনকে যেয়ে বোনাসের জন্য অনুরোধ করে। মহাজন শুষ্ক পাতার মতো করে জানায়, কালকে দিবে।
প্রকৃতির প্রতিদিনের রুটিনের মতো দিন শেষে পরের দিনের সূর্য উঠে। আশিক বাবাকে বলে দেয়, গতবছরে ত্রিশটা রোজা হয়েছিল। এবার মনে হয় ঊনত্রিশটা রোজা হতে পারে। একটা শার্ট হলেই সে সন্তুষ্ট। আজকে শার্ট নিয়ে আসবে বলে বাবা দোকানে দিকে যায়। যেয়ে দেখে মহাজন তার আগেই চলে গেছে। বোনাস দেয়ার ভয়ে পলায়ন করেছে। এই আবার কেমন কা-? বোনাস দেয়ার মতো পুঁজি নেই। এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক। দোকানে যথেষ্টের চেয়েও অনেক বেশী পণ্য রপ্তানি ও অর্থ আমদানি হয়েছে। তুহিন হতবাক হওয়া ছাড়া কোন উপায় খুঁজে পায় না। যেন মেঘহীন নীল আকাশ। সেই মন আকাশের প্রতিটি নীল কণায় দুঃখের রক্তক্ষরণ হতে থাকে। আশিক প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে। বাবা হয়ে এইটুকু করতে পারবে না সে। অশ্রুর আগমন ঘটলেই চোখ বন্ধ করে ফেলে।
দুপুর তিনটায় মহাজন এসে বলে দিল, আসরের নামাজের পর বোনাস দিবে। তুহিনের শুকনো মুখে ফুটে উঠে অনাবিল হাসি।
তুহিন বলে, হ্যা ভাই। বোনাসটা খুব দরকার। ছ্যালে একটা শার্ট চ্যাহেছে। আজকে শার্ট বানাতে দিব।
কিন্যা ল্যাও, বানাতে দেয়ার দরকার নাই।
দোকানের রেডিমেট শার্টের দাম অনেক, ভাই। বানিয়ে দিব।
বানাতে দিলে কি আজকের মধ্যে দিতে প্যারবে? ক্যালকে যদি ঈদ হয়।
মুরাদ ভাইয়ের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। শার্টের কাপড় কিন্যা দিলেই বানিয়ে দিবে।
ত্যাহেলে দ্যাও।
ইফতারের একটু আগে বোনাসের টাকার রঙে সকল কর্মচারীর হাত উজ্জ্বল হয়েছে। সেই খুশীতে তুহিনের মুখও হয়েছে রঙিন। ইফতারের কিছুক্ষণ অন্তে ঘোষণা হয় আগামীকাল ঈদ-উল-ফিতর। ঈদের সঙ্গিত মাতিয়ে দেয় নগরবাসীকে। চারিদিকে পটকা আর আতশবাজির উৎসবমুখর শব্দ। আজকে আশিকের জন্য শার্ট নিয়ে যেতে হবে। কোন দূর্যোগ তুহিনকে রুখতে পারবে না। আগে শার্ট বানাবে, তারপর বাকি টাকা দিয়ে কিনবে ঈদের দিনের জন্য সেমাই, মাংস, তেল, ডাল। একঘন্টার জন্য দোকান থেকে ছুটি নিয়ে কাপড়ের দোকানে। আশিক গতকাল যে শার্টটা পছন্দ সেটার রঙ ছিল সবুজ। তাই দোকানে চঞ্চলতার সাথে সবুজ রঙের শার্টের পিচ দেখতে শুরু করে। হঠাৎ কি যেন চিন্তা এলো মাথায়। দৌড় দিল সেই শো-রুমে। সেখানে গিয়ে দেখে আশিকের দৃষ্টি কেড়ে নেয়া শার্টটি এখনও আছে।
টাকার মায়াজালে না পরে ছেলের জন্য এগারশত টাকা দিয়ে শার্টটি কিনে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয়। বাড়িতে পৌছিয়ে সাইকেল কোন রকমে এক কোণায় রেখে ঘরের দিকে যাওয়ার সময় জোরে জোরে বলতে থাকে,
আশিক, কই রে আব্বা….।
আমি ঘরে আছি।
এই দ্যাখো, তোমার পছন্দের শার্ট লিয়্যা এসেছি।
একথা বলেই আশিকের হাতে শার্টটা দেয়। শার্টটা হাতে নিয়ে আশিক অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকায়। তুহিন মুচকি হাসি দেয়।
আশিক বলে, এই শার্ট কিনলা ক্যান? এডের তো দাম অনেক।
বেশী দাম হোক, ক্যালকে পড়বা। তোমার জন্যই তো লিয়্যা এ্যাসলাম।
আশিক হা করে তাকিয়ে শার্টের দিকে। বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে।

লেখক: মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল। তিনি রাজশাহী মহানগর আ.লীগ অফিসে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কর্মরত।