মনিরুজ্জামান শেখ রাহুলের ছোটগল্প ‘না ফোটা ফুল’

সিল্কসিটিনিউজ সাহিত্য ডেস্ক:

‘না ফোটা ফুল’ 

মধ্যাহ্ন ভোজন শেষে মোবাইলটা নিয়ে উঠানে বসল স্বাগত ফারহান। যে কারনে আর কি। আশেপাশে কি হচ্ছে, কোথায় কে কি করছে, দেখার সময় নেই। সরাসরি প্রবেশ করল ফেসবুকে। বাড়ির সামনেই মাঠ। একটু পরেই বন্ধুরা এসে উপস্থিত হবে। খেলা চলবে ব্যাডমিন্টন, না হয় নুনা বদন। সেটা পরের না হয় দেখা যাবে। আপাতত ফেসবুকে প্রবেশ করে সার্চ অপশনে যেয়ে লিখল ‘জেরিন তাসনিম’। ফলাফলে অনেকগুলো এ্যাকাউন্ট। একে একে বেশ কয়েকটি এ্যাকাউন্টে প্রবেশ। কিন্তু যে জেরিন তাসনিমকে সে খুঁজছে তাকে পাওয়া গেল না।

এবার ইংরেজিতে লিখে সার্চ। ফলাফল একই। জেরিন তাসনিমকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ। কিছুদিন থেকেই সময় পেলে এভাবে ফেসবুকে খুঁজতে থাকে। মেয়েটি স্বাগতদের থেকে দশটা-বারোটা বাড়ির পরেই থাকে। খুব ছোট থেকেই কেনো জানি মেয়েটিকে মনে ধরে যায় স্বাগতের। জেরিন তার বাবার সাইকেলে চড়ে স্কুলে যেতো। আর স্বাগত অনেকটা লুকিয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতো। তখন থেকেই মেয়েটি তার অন্তরের মণিকোঠরে জায়গা করে নেয়। একদিন দেখতে না পেলে যেনো সবকিছুই শূণ্য মনে হতো। জেরিন তাসনিম নামে এক ভালোবাসার গাছ তার মন অরণ্যে দিনে দিনে বড় হতে থাকে।
সময় বহমান। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে স্বাগত এখন কলেজে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে অন্তরালে মেয়েটিকে ভালোবেসেই চলেছে। তার মন অরণ্যে জেরিন নামের গাছটি অনেক বড় হয়েছে। এখন সেই গাছে ঝড় উঠে। আর সেই ঝড়ে লণ্ড ভণ্ড হয়ে যায় তার ভাবনাগুলো। স্বাগত সেই ঝড়ের কথা জেরিনকে কখনো বলতে পারেনি।

ক্যালেন্ডারের পাতা ঘুরে প্রতিবছর বসন্ত আসে। ফুল ফুটে, আবার ঝরেও যায়। প্রতিদিনই ভাবে আজ যেভাবেই হোক জেরিনকে সে মনের কথা বলবেই। কিন্তু পারে না। কি যেনো এক ভয়ে সাহস যোগাতে পরে না স্বাগত। সরাসরি ভালোবাসার কথা বলার হিসেবটা থেকে সরে আসে। আশ্রয় নেয় ফেসবুকে। সেখানেও ব্যর্থ। জেরিনের ফেসবুকটি কি নামে চালু আছে তা জানে না। শুধু নাম দিয়েই চেষ্টা চালিয়ে যায় সে।
বিকাল চারটা বাজে। বন্ধুরা মাঠে এসে উপস্থিত। প্রতিদিনের মতো ব্যাডমিন্টন খেলা শুরু হয়। ছয়জন হওয়াতে দুইজনকে বসতে হবে। স্বাগত খেলতে চায়। বসতে চাইল না। এমন সময় মাঠে জেরিন উপস্থিত। সঙ্গে কয়েকজন বান্ধবি। সালোয়ার কামিজের সাথে কাশ্মিরী শাল। সৌন্দর্য্য অনেকখানি বাড়িয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শীতের বিকেলে হালকা হিমেল বাতাসে কালো জলধরের মতো কেশ উড়ছে।
একটু আগেই র‌্যাকেট হাতে নিয়ে খেলার প্রস্তুতি নিতে থাকা স্বাগত পরিকল্পনা পাল্টায়। পায়ে ব্যাথার অজুহাতে সে খেলতে চাইল না। মেয়েটি যে পাশে বসেছিলো তার বিপরীত দিকের মাঠের প্রাচীরে গিয়ে বসে স্বাগত। জেরিনের দিকে তাকায়। তাকিয়েই থাকে। দু-চোখ ভরে মেয়েটিকে দেখতে চায়। চোখ যেনো তার সরতেই চাইছে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই থাকে মেয়েটির দিকে। কোন রকম লজ্জাই নাই মনে হচ্ছে। কে কি ভাবছে তা নিয়ে চিন্তা নেই স্বাগতের। সে শুধুই তাকে দেখেই যায়।
জেরিনকে সে ভালোবাসে। আর ভালোবাসার মানুষকে দেখার সাধ কি কারো মেটে? যতো দেখা যায় ততোই ইচ্ছে বাড়ে। ছেলেটির দু-নয়ন চায় আরো কিছুক্ষণ দেখতে। কিন্তু সেই ধৈর্য্য তো সূর্যের নেই। অস্তে গেলো চলে। সন্ধ্যা নামতে দেখে বান্ধবিদের নিয়ে জেরিনও ফিরে গেলো বাড়িতে।

আলো ও পানির অভাবে গাছের পাতা যেভাবে শুকিয়ে যায়, মেয়েটি চলে যাওয়াতে স্বাগতের চেহেরায় তেমনি একটা ভাব। মাঠ থেকেই দেখা যায় জেরিনের বাড়ি। স্বাগত তাকিয়ে থাকে। জেরিন এক সময় বাড়িতে প্রবেশ করে। দৃষ্টির আড়ালে যেতেই স্বাগতের বুকের মাঝে এক ধরনের হতাশা মোচড় দিয়ে উঠে।
কয়েকদিন পর আচানক ঘটনা ঘটে। যে ঘটনা শুষ্ক মরুভূমিকে এক ফোঁটা বৃষ্টির ছোঁয়ার মতো মনে হয় তার কাছে। স্বাগতের মোবাইলে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। হ্যালো।
ওপার থেকে মেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এলো। হ্যালো, সৈকত?
স্বাগত বেশ অবাক হয়। আমি সৈকত না, আপনি কে বলছেন?
আমি জেরিন।
এ কথা শুনে বুকে উচ্চবেগে ছুটে আসা এক শিহরনের ধাক্কা লাগে। অবর্ণনীয় অনুভূতি। জেরিন কথা বলছে তার সঙ্গে!
ওপার থেকে জেরিনের কণ্ঠস্বর। আপনি কে বলছেন?
কাঁপা কাঁপা গলায়। আমি স্বাগত।
ও স্বাগত। ‘স’ দিয়ে নাম খুজতে গিয়ে ভুল করে আপনাকে ফোন দিয়ে ফেলেছি।
স্বাগতের মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। কি যেনো একটা আবেশ তাকে ঘিরে আছে।
জেরিন আবার বলে, শুনছেন? হ্যালো।
হ্যাঁ, হ্যাঁ শুনছি।
আপনাকে ফোন দেয়াতে ভালোই হলো। সামনে বছর আমার এসএসসি পরীক্ষা। আপনার কাছ থেকে কোন সাহায্য চাইলে করবেন তো?
স্বাগতের বুকের মধ্যে ময়ূর নাচছে। হ্যাঁ, করব, অবশ্যই করব।
ঠিক আছে, তাহলে ফোন দিব।
দিও, তোমার নাম্বার সেভ করে রাখছি।
জেরিন ছোট্ট করে বললো। রাখলাম, বাই।
মোবাইলটা হাত থেকে সোফায় পরে গেল। বিছানায় শুয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। এই কেমন অকল্পনীয় ঘটনা ঘটে গেল। নাকি স্বাগত স্বপ্ন দেখছে? হালকা শীতও অনুভূত হচ্ছে। স্বপ্ন দেখলে তো শীত অনুভব কার যায় না। সুতরাং ঘটনাটি বাস্তব।

পরের দিন জেরিন সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর নিয়ে যায় স্বাগতের কাছ থেকে। এরপর প্রায় দু’জনের ফোনালাপ হয়। কখনো কখনো দেখা। অল্প দিনেই দু’জনের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।
কিন্তু ছেলেটি এই বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ থাকতে চায় না। জেরিনকে সে অনেক দিন থেকেই ভালোবাসে। তাই সম্পর্কের গ-িটা আরো গভীরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকে স্বাগত। জেরিন এখন অনেক ভালো বন্ধু। তবু ভালোবাসার কথাটা বলতে কোথায় যেনো বাঁধা। ভালোবাসার কথা বলতে অনুশীলন কম করে নি। তবে সাফল্যের সেই দ্বারপ্রান্তে যেতে পারে নি।
এক দুপুরে জেরিনে ফোন আসে। জেরিন জানায়, প্রাইভেট পড়তে গিয়েছিলো। কিন্তু স্যার আজকে পড়াবে না। সময়টুকু কি করবে? বাড়িতে যেতেও মন চাইছে না।
স্বাগতকে আড্ডা দেয়ার জন্য ডাকে। এমন কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়ে স্বাগত। আয়রন করা শার্ট, চকচককে রঙের জিন্স প্যান্ট পরে পায়ে জুতা উঠায়। যাবার আগে কিছু একটা কমতি অনুভব করল। সেটি পারফিউম। সুগন্ধি পানিটা ছিটাতে কোন প্রকারের ভুল করল না।
মেয়েটি মোবাইল হাতে অপেক্ষা করছে। স্বাগতকে দেখে মেয়েটি সন্তুষ্টির হাসি দিল। তারা দু’জনে স্যারের বাড়ি থেকে একটু দূরে নদীর পাড়ে গিয়ে বসে। দু’জনের হাতে কোল্ড ড্রিংক্সের বোতল।
সামনে নদী। দুজনে নদীর দিকে মুখ করে বসে আছে। দু’জনের মুখে কোন কথা নেই। এভাবে কিছুক্ষণ।
আপনার প্রেমিকার নাম কি? জেরিন প্রশ্ন করে।
এমন প্রশ্নে স্বাগত কিছুটা অস্বস্তির মধ্যে পড়ে যায়। ছোট্ট করে মাথা নাড়িয়ে বলে, আমি আগে কখনও প্রেম করিনি।
এখন করছেন?
হ্যাঁ, কিন্তু তাকে বলতে পারি নি।
একদিন বলেই দেখেন। সেও হয়ত আপনাকে প্রচন্ড ভালোবাসে। শুধু আপনার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় আছে।
অনেক চেষ্টা করেছি। সেই সুন্দরীর সামনে যেয়ে আর বলতে পারি না। জিহ্বার ওজন যেনো অনেক গুন বেড়ে যায়। কোন শব্দই উচ্চারন করতে পারি না।
হঠাৎ মেয়েটির ফোন বেজে উঠে। মা জরুরিভাবে বাড়িতে আসতে বলল। বিদায় নিয়ে চলে গেল জেরিন। খেয়ে ফেলা জুসের প্যাকেটের মতো শুকিয়ে গেল স্বাগত। বোতলটি ছুঁড়ে দিল নদীর ¯্রােতে। নিজের উপরে বেশ বিরক্ত স্বাগত। আজ সুযোগ ছিল কথাটা বলার। আজও মেয়েটিকে বলা হলো না। কয়েকটি কথা তো মাত্র। তাও বলা হলো না। নদীর তীরে বসে ভাবতে থাকে।
বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যায় বাড়িতে আসে স্বাগত। তারপরে যে সংবাদটি তার কানে আসে তাতে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে সে। সব স্বপ্ন যেনো সেই সংবাদে নিমিশেই শেষ। তার বন্ধু জানায় জেরিনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র ডাক্তার। মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে বলে দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে হবে। দেরী করতে চাইছে না দুই পক্ষই। আজই বিয়ে হবে।
বুকের মাঝে অসহ্য যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে উঠে। কোনভাবেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ায় স্বাগত। বাড়ির বেলকোনিতে দাঁড়িয়ে জেরিন কাঁদছে। স্বাগতের দিকে চোখ পড়ে। এবার আরো জোরে কাঁদতে শুরু করে। জেরিনের মুখটা এক সময় ঝাপসা হয়ে এলো। স্বাগত খেয়াল করে তারও দু’চোখে জল ভরে গেছে।

লেখক: মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর। ছোট গল্পটি লেখক তার বাল্যকালের বন্ধু, প্রিয় পিতামহ মরহুম চাঁন্দু শেখকে উৎসর্গ করে লিখেছেন।