মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে অর্ধশত নারীকে বিক্রি, গ্রেপ্তার ৮

মেহেরপুরের গাংনীর বামন্দ্রী গ্রামে সাইফুল ইসলাম টুটুলের ছিল মুদি দোকান। তাঁর লেখাপড়ার গণ্ডি উচ্চ মাধ্যমিক। একসময় বিদেশে লোক পাঠানো দালালদের সঙ্গে গড়ে ওঠে সখ্য। ওই দালালদের মাধ্যমে গ্রামের কয়েকজনকে বিদেশেও পাঠান টুটুল। এরপর টাকার লোভে পড়ে মানব পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। নিজেই হয়ে ওঠেন পাচারের নিয়ন্ত্রক। রাজধানীর বাড্ডায় খুলে বসেন তিনটি অবৈধ কম্পানি (ওভারসিজ এজেন্সি)। এই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে গেল সাত বছরে অর্ধশত নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে শেষে দালালদের কাছে বেচে দেন। এ ছাড়া শতাধিক ব্যক্তিকে বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণাও করেছেন টুটুল।

তাঁর প্রধান সহযোগী তৈয়ব আলী ছিলেন চা দোকানি। টুটুলের সঙ্গে একজোট হয়ে তিনি নিজেকে বিমান পরিবহন কম্পানির ব্যবস্থাপক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণার পথে হাঁটেন। গেল মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত বাড্ডায় ‘টুটুল ওভারসিজ’, ‘লিমন ওভারসিজ’ ও ‘লয়াল ওভারসিজ’ নামের তিনটি অনুমোদনহীন কম্পানিতে অভিযান চালিয়ে আরো ছয় সহযোগীসহ টুটুল ও তৈয়বকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। অন্যরা হলেন শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন, মারুফ হাসান, জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দুল্লাহ আল মামুন। অভিযানের সময় দুই নারীসহ চার ভুক্তভোগীকে উদ্ধার করা হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ১০টি পাসপোর্ট, সাতটি ফাইল, চারটি সিল, ১৭টি মোবাইল ফোন, পাঁচটি রেজিস্টার, ব্যাংকের চেক বই, দুটি কম্পিউটার, তিনটি লিফলেট এবং ১০ হাজার টাকা।

র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, মানবপাচার ও প্রতারণার কারবার করে টুটুল ও তাঁর সহযোগীরা কয়েক কোটি টাকা হাতিয়েছেন।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে অভিযানের ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরেন র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, পাচারকারী চক্রের কিছু সদস্য

দেশের বেকার ও অসচ্ছল তরুণ-তরুণীদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নামে রাজি করিয়ে টুটুল ও তৈয়বের কাছে নিয়ে আসে। এরপর টুটুল ও তৈয়ব বিদেশে চাকরিপ্রার্থীদের পাঠানোর উদ্দেশ্যে ভুয়া মানি রিসিট দিয়ে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা অগ্রিম নিতেন। পরে চক্রের সদস্যরা ভুক্তভোগীদের কাছে নিজেদের উচ্চশিক্ষিত পরিচয় দিয়ে বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিত। চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের অফিসকর্মী পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট বানানোর সব কাগজপত্র সংগ্রহ করত। দালালদের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়ে আনার পর ভুক্তভোগীদের কোনো সন্দেহ হতো না।

র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক আরো বলেন, বৈধ ওভারসিজের মাধ্যমে ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে অর্ধশত নারী-পুরুষকে চক্রটি সৌদি আরব, জর্দান ও লেবাননে পাঠিয়েছে। সেখানে চক্রটির আলাদা একটি সিন্ডিকেট রয়েছে। দেশগুলোতে যাওয়ার পর ভুক্তভোগীদের পাসপোর্ট নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর নারীদের বিক্রি করে দেয় দালালের কাছে, আর পুরুষদের কম বেতনে অমানবিক কাজ করানো হয়।

অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, এই চক্রের বিরুদ্ধে অন্তত ২০ জন ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন। চক্রটির সঙ্গে বৈধ কোনো ওভারসিজ জড়িত কি না, সে বিষয়েও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সম্প্রতি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মালিকরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ তুলে মানববন্ধন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক বলেন, বৈধ কোনো জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানকে হয়রানি করা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। তবে বৈধতার আড়ালে কেউ যাতে মানবপাচার করতে না পারে, সে জন্যই র‌্যাবের অভিযান।

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ