মতিহার ক্যাম্পাস (রাবি) হতে পারে প্রকৃতির লীলাভূমি

গোলাম সারওয়ার     (গাছ কর্তনের অনুভূতি)

এই পৃথিবী কী শুধু মানুষের বসবাসের জন্য? করোনাকালে প্রশ্নটি বার বার বিশ্ববাসির কাছে ফিরে আসছে।সারাবিশ্বের মানুষ আজ গৃহবন্দী।এই সময় প্রকৃতি ক্রমশ:নিজেকে প্রকাশ করছে।নিজের ছন্দে ফিরছে।মানুষের চলছে সংকটকাল আর প্রকৃতির এখন মুক্তিকাল।মুক্তির স্বাদ নিতে বেরিয়ে পড়ছে পশুপাখীর দল।কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের এত কাছাকাছি সারিসারি ডলফিন দলের উন্মাতাল নৃত্য কয়েক দশক ধরে কেউ দেখেনি। লাল কাঁকড়া থেকে শুরু করে হাজার হাজার কচ্ছপের এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে সৈকত।দলবেধে ফিরে আসছে পরিযায়ী পাখী।

রাস্তা-ঘাটে,বিল্ডিংয়ের গায়ে গায়ে পাখীদের জটলা, প্রাণোচ্ছ্বল কিচিরমিচির,বিশ্বের বিভিন্ন নগরীর রাজপথে অবলীলাক্রমে চলাচল করছে বন্যপ্রাণি।ফাঁকা বিমানবন্দরের রানওয়ে  দখলে  নিয়েছে রাজহাঁসের পরিবার।নিজেদের সমান অধিকারের জানান দিচ্ছে পশু-পাখী।নতুন করে সব অক্সিজেন পেয়েছে।উদ্ভিদজগত হয়ে উঠেছে সজীব।পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সবুজ। নানা কৌশলে তাদের অস্তিত্ব ফুটিয়ে তুলছে।

কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখা গেছে উল্টোচিত্র।মানুষের ঘরে থাকার সুযোগে প্রাণী এবং উদ্ভিদ যখন প্রাণ ফিরে পেয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে প্রথম দৃষ্টিতেই চোখজুড়ানো,প্রাণজুড়ানো ৪০টি বিরল প্রজাতির ফিসটেল পাম গাছ ‘মৃতপ্রায়’ বলে সাবাড় করেছে কর্তৃপক্ষ এবং ঐসব গাছে বসবাসকারি পাখীদের আবাস নষ্ট করা হয়েছে।ইচ্ছা করলে কর্তৃপক্ষ ৭৫৩ একরের এই বিশাল ক্যাম্পাসের অনেকখানি জায়গা নিয়ে এক ঐতিহাসিক বিশেষীকৃত উদ্যান তৈরি করতে পারে।যেখানে উদ্ভিদ এবং পশুপাখী  উভয়ে মোটামুটি নিরাপদভাবে বসবাস করতে পারবে।সেখানে থাকবেনা নিষ্ঠুর মানুষের শ্যেন দৃষ্টি। ঘরে বন্দী থাকা অবস্থায় আমার মননে-মগজে বার বার এই স্বপ্ন উঁকি দিচ্ছে।

লকডাউনের মধ্যে কয়েকদিন আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার শিক্ষক বিশিষ্ট প্রাণিবিজ্ঞানী উপ-উপাচার্য প্রফেসর আনন্দ কুমার সাহা ফাঁকা ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে দেখেছেন এবং তাঁর মনের অভিব্যক্তি লেখনীর মাধ্যমে সুন্দরভাবে প্রকাশ করেন।অনলাইন পত্রিকায় আমি মনোযোগ সহকারে তাঁর“কেমন আছে মতিহারের সবুজ চত্বর” শিরোনামে লেখাটি পড়েছি।

একদিকে তিনি শূন্য ক্যাম্পাসের জন্য হতাশা ব্যক্ত করেছেন,অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতিতে সেখানকার গাছ-গাছালির অবস্থা,পশু-পাখীদের স্বাচ্ছন্দ্য বিচরণ একজন প্রাণিবিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন।তাতে আমি কমেন্টও করেছি।কিন্তু পরক্ষণেই  ৪০টি গাছ কর্তনের স্বপক্ষে যে বক্তব্য তুলে ধরেছেন,একজন প্রাণিবিজ্ঞানী হিসেবে তাঁর সে যুক্তি আমাদের হতাশ করেছে।তিনি গাছগুলোকে মৃতপ্রায়,বয়সের ভারে ন্যুব্জ,কোন টিম্বার ভ্যালু নেই,দৃষ্টিতে কটু লাগছিলো-এইসব বলে নিজেকে আড়াল করেছেন।

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুকে বাঙালি বিজ্ঞানী হিসেবে মূল্যায়ন করে তাঁর নামে একটি একাডেমিক ভবনের নামকরণ করেছে  বর্তমান কর্তৃপক্ষ।এই মহান বিজ্ঞানী গাছের দুঃখ-কষ্ট,ব্যথা-বেদনা ধরতে পারতেন।তিনি বলেছেন,গাছের জীবন মানুষের জীবনের ছায়ামাত্র।গাছের প্রাণ আছে,তাদের অনুভূতি আছে।তিনি তা আবিষ্কার করেছিলেন।

তাঁর আবিষ্কৃত গাছের লিপিযন্ত্র সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেন,“এই আমাদের মূক সঙ্গী,আমাদের দ্বারের পার্শ্বে নিঃশব্দে যাহাদের জীবনের লীলা চলিতেছে,তাহাদের গভীর মর্মের কথা তাহারা ভাষাহীন অক্ষরে লিপিবদ্ধ করিয়া দিল এবং তাহাদের জীবনের চাঞ্চল্য ও মরণের আক্ষেপ আজ আমাদের  দৃষ্টির সন্মুখে প্রকাশিত করিল”। সেই জগদীশ চন্দ্র বসু ভবনের পাশেই গাছগুলেোকে হত্যা করা হলো। আঘাতের পর আঘাতে গাছগুলো যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিল, সেই সময় স্যার জগদীশের প্রেতাত্মার আর্তনাদে পুরো ক্যাম্পাসের উদ্ভিদ জগতের মধ্যে যে অব্যক্ত কান্নার রোল উঠেছিল তা কি কেউ শুনেছে? পাখীগুলোর আবাস হারানোর কষ্ট কেউ কি অনুভব করেছে?

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ৫০ বছর মেয়াদি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে। তাতে বহু উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। যার কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। ৪০টি গাছ কর্তন তারই অংশবিশেষ।কে জানে,এই উন্নয়ন করতে গিয়ে কত উদ্ভিদের প্রাণ যাবে! কয়েক যুগ ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক থেকে সোজা প্রশাসন ভবন পযর্ন্ত দুই রাস্তার মাঝখানে এই  ৪০টি  র্দুলভ  ফিসটেল পাম গাছ বিশ্ববিদ্যালয়কে অপরূপ রূপে সাজিয়ে রেখেছিল। এর চিরল চিরল পাতা, মোহময় অবয়ব,বেণীর মতো ঝুলন্ত ফলগুলো একেক সময় একেক রঙে বাহারি সাজে সজ্জিত হয়ে মতিহার ক্যাম্পাসের শোভাবর্ধন করতো।পাখীরা সেখানে স্বাচ্ছন্দ্যে ফল খেতো,বাসা বাঁধতো।এখন সেখানে শূন্যতা,হাহাকার বিরাজ করছে। ক্যাম্পাসকে প্রথম দর্শনেই ভাল লাগার অনুভূতিটা হারিয়ে গেছে।

যদিও কর্তৃপক্ষ বলছে, ঐ একই প্রজাতির বোতল পাম গাছ আবার  লাগানো হবে সেখানে। কিন্তু ঐ সৌর্ন্দয ফিরে আসতে বহু বছর লেগে যাবে। খবরে বেরিয়েছে, কেউ কখনো মোহনীয়া ঐ ৪০টি গাছের যত্ন নেয়নি।যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হতো, তবে গাছগুলোকে আরো কয়েক বছর টিকানো সম্ভব হতো বলে উদ্ভিদবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক জানিয়েছেন। বয়োবৃদ্ধের কারণেই যদি কাটা হয়,তবে উচিত ছিল,অনেক আগে থেকেই ঐসব  গাছের পাশে পাশে নতুন করে একই গাছ লাগানো।এতোদিনে সেগুলো বেশ বড় হয়ে যেতো। মানুষের মনেও এত কষ্ট লাগতোনা। আসলে নগর সভ্যতা মানুষের হৃদয়কে সুকঠিন করে দিয়েছে।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রাকৃতিক নৈসর্গের এক অপরূপ সমাহারে বেষ্টিত। গোটা ক্যাম্পাসে নানা ধরনের সবুজ বৃক্ষরাজিতে সুশোভিত।ফুলে-ফলে,বনজ,ফলজ,ওষধি গাছ, লতা-গুল্মে ভরা এই স্বপ্নের মতিহার ক্যাম্পাস।কিন্তু সেগুলো সাজানো গোছানো না।পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত মনমাতানো এই বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা প্রাণ দিয়ে ভালবাসি।গত প্রশাসন জোহা চত্বরকেও করে ফেলেছে বৃক্ষশূন্য। একেবারে গড়ের মাঠের মতো সৌন্দর্যহীন করে ফেলেছে। কেমন যেন শূন্যতা,হাহাকার মনে হয়।কর্তৃপক্ষের উচিত এখানে কিছু ছায়াদানকারি গাছ লাগানো। তাহলে শায়িত মহান শিক্ষক ড: শামসুজ্জোহার আত্মাও শান্তি পাবে।

বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞানচর্চাই নয়,মানসিক বিকাশকেন্দ্রও বটে।মনের উদারতা,মানসিক শান্তি, প্রকৃতির বিশালতাকে আত্মার সাথে একাত্মতা প্রকাশের এক মহাকেন্দ্র এই বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীরা এখানে প্রকৃতির অবারিত ভান্ডারকে উপভোগ করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার কাজকে আরো সম্প্রসারণ করার সুযোগ পাবে।

এখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতিত্ব এবং মাহাত্ম্য।তাই রাজশাহী  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করবো,বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিশন,মিশন এবং কোর ভ্যালুস বজায় রাখার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে ক্লাসরুমকেন্দ্রিক না করে পুরো ক্যাম্পাসকে শেখা আর জানার কেন্দ্র হিসেবে যেন গড়ে তোলেন।শুধু শিক্ষার্থীদের জন্যই নয়, বাইরের লোকজনদের জন্যও নানা বিষয় শেখার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে এই মতিহার ক্যাম্পাস।

৩০৩.৮০ হেক্টরের এই বিশাল ক্যাম্পাসকে এক ঐতিহাসিক উদ্যান হিসেবে গড়ে তোলা যায়। যেখানে থাকবে ছোট-বড় দেশি-বিদেশি প্রাণি,থাকবে নানা প্রজাতির দেশি-বিদেশি দুর্লভ গাছ, ওষুধি গাছ,ছড়িয়ে থাকা জলাধারসমূহে থাকবে বিচিত্র সব শাপলার সংগ্রহ,পদ্ম পুকুর, ভেষজ উদ্ভিদের বাগান, বাঁশবাগান, গোলাপ বাগান।বিভিন্ন পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত থাকবে ক্যাম্পাস।ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখী আসবে।থাকবে কৃত্রিম লেক,কৃত্রিম দ্বীপ,বিদেশি গাছের বিশাল সমাহার,মৌসুমি ফুলের বাগান,লতা-গুল্মজাতীয় গাছ।বিচিত্র প্রজাতির উদ্ভিদের সমারোহ থাকায় গবেষকদের জন্যও এটা তথ্য প্রাপ্তির আকর্র্ষণীয় জায়গা হতে পারে।নান্দনিক ও নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও গবেষণার কাজে মানসিক দৃঢ়তা পাবে।আলাদা বৈশিষ্টে পরিচিতি করার জন্য পুরো মতিহার ক্যাম্পাসকে জীবকূলের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রচেষ্টা নেয়া যায়।

প্রয়োজনে মৃতপ্রায় বোটানিক্যাল গার্ডেনটিকে পরিপূর্ণ গার্ডেনে রূপান্তর করার জন্য আরো বিস্তৃত জায়গা নিয়ে কীভাবে বৃহত্তর রূপ দেয়া যায় তার মহাপরিকল্পনা করা যেতে পারে।

স্মর্তব্য, এই বিশ্ব চরাচর আল্লাহ একমাত্র মানুষের বসবাসের জন্যই সৃষ্টি করেন নাই।সমস্ত জীবজগতের জন্য এই বিশ্ব।মানুষের রুঢ় আচরণের কারণে প্রকৃতি এই করোনাকালে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।নিজেদের সহাবস্থান জানান দিচ্ছে পশুপাখী। অধিকার ফিরে পাবার জন্য তারা মাঠে নেমে পড়েছে। তাই এই করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের একজন সদস্য হিসেবে গভীরভাবে উপলব্ধি করছি, বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু মনুষ্য চলাচলের জন্য উপযোগী করে তুললে হবে না, পাশাপাশি উদ্ভিদ ও প্রাণীদের নিজস্ব গতিতে চলার সুযোগ করে দিতে হবে। তবেই এখানে বিশ্বমানের মানুষ তৈরি করা সম্ভব হবে।

আমরা চাই, আমাদের প্রিয় মতিহার ক্যাম্পাসকে প্রাণী এবং উদ্ভিদ জগৎ তথা জীবজগতের বসবাসযোগ্য প্রকৃতির এক অনবদ্য স্থান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হোক।এই ক্যাম্পাসের ভিতরে গড়ে উঠবে আরেক নতুন জগৎ।গাছ সব প্রাণীকে বেঁচে থাকার জন্য দিচ্ছে অফুরন্ত অক্সিজেন,আর গাছের জন্য মানুষ দিচ্ছেন কার্বন ডাই অক্সাইড।একে অপরের সম্পুরক ও পরিপূরক।

যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান ও কানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানিয়েছেন, আমরা যদি একটি গাছের সঙ্গে অধিক সময় ব্যয় করি,তাহলে মানসিক অসুস্থতা,মাথাব্যথা ও অন্যান্য মনস্তাত্ত্বিক সমস্যার অনেকটা উপশম ঘটে।

গবেষকরা আরো জানিয়েছেন, যে কোন ব্যক্তি ১ ঘন্টা প্রকৃতিতে সময় কাটালে তার স্মৃতিশক্তি প্রায় ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় এবং প্রকৃতিতে যদি কয়েকদিন থাকা যায়,তাহলে সৃজনশীল কাজের সক্ষমতা বৃদ্ধি পায় ৫০ শতাংশ।সুতরাং দেখা যায়,আমাদের শারীরিক ও মানসিক ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা জরুরি।

আরেক জরিপে দেখা যায়,যেসব এলাকায় মানুষ উদ্যান বা পার্ক বেশি ব্যবহার করে,সেসব এলাকায় মানসিক রোগির সংখ্যা কম।

সবকিছু বিবেচনায় তাই আমাদের কাম্য,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তথা মতিহার ক্যাম্পাস হয়ে উঠুক একটি অদ্বিতীয় জীবজগতের উদ্যান।যেখানে প্রাণী এবং উদ্ভিদের বিচরণে কেউ কারো বাধা হবেনা।একে অপরকে চেনার,জানার সুযোগ পাবে।ক্যাম্পাস হয়ে উঠবে শান্তির এবং সাধনার এক লীলাভূমি।

লেখক : উপ-রেজিস্ট্রার (পিআরএল),রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।