ভ্যাপসা গরমে বাগাতিপাড়ায় কদর বেড়েছে তালপাখার

মো. মঞ্জুরুল আলম মাসুম, বাগাতিপাড়া:
গ্রীষ্মের তাপদাহে পুড়ছে উত্তরাঞ্চল। সেই সাথে গরমে অতিষ্ট মানুষ। এর ফাঁকে বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার লুকোচুরি। ভ্যাপসা গরমে অতিষ্ট এসব মানুষের কাছে কদর বেড়েছে তালপাখার। ফলে ব্যস্ততা বেড়েছে পাখা পল্লীতে। হাতে তৈরি তালপাখা জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামের নারীদের। বছরের ছয় মাসে হাত পাখা তৈরি তাদের দিয়েছে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ। এতে নারীদের করেছে স্বাবলম্বী। তবে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ সুবিধা না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি বিকশিত হচ্ছে না।

নাটোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাঁপানিয়া গ্রামটিতে তালগাছ না থাকলেও এখন তালপাখার গ্রাম নামেই এর পরিচয়।
সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার পাখা শিল্পের সঙ্গে জড়িত। ভ্যপসা গরমে তালপাখার চাহিদা বেশি থাকে বলেই নারীদের পরিবারের পুরুষরাও তালপাখা তৈরিতে সহায়তা করছেন।

তালপাখা তৈরির কারিগররা জানান, এর প্রধান কাঁচামাল ডাগুরসহ তালপাতা। উত্তরের জেলা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তালপাতা কিনে আনতে হয় পৌষ মাসের শুরুতে। প্রতিটি পাতা কিনতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা। এই পাতা গোল করে কাটা হয় সতর্কতার সঙ্গে। কাটার পর রোদে শুকানো হয় কয়েকদিন। শুকানো শেষে গুচ্ছ হয়ে থাকা ডাগুরের সংকুচিত পাতা প্রসারিত করা হয় বাঁশের তৈরি কাঠির মাধ্যমে। পাতার এক একটি শিরা প্রসারিত করে কয়েক শিরা মিলে দুই প্রান্তে আটকানো থাকে কাঠি। এভাবে রাখার পর তালপাতা স্বাভাবিক প্রসারিত আকার ধারণ করলে গোলাকার পাখাটি রং করা বাঁশের খিল দিয়ে দু’পাশ আটকে সেলাই করে দেয়া হয়।
তারা আরও জানান, একটি তালপাখা কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে খরচ হয় আরো ২ থেকে ৩ টাকা। গড়ে ১০ থেকে ১১ টাকা দামের তালপাখার কারিগররা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ১২ থেকে ১৫ টাকায়। প্রধানত রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তালপাখার চাহিদা মেটায় হাঁপানিয়ার পাখা। সংসারের নিত্য কাজকর্মের পাশাপাশি পৌষের শুরু থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করছে নারীরা। তবে এর মজুরি একেবারেই কম। ১০০টি পাখা তৈরি করলে মজুরি পাওয়া যায় ৩৫ টাকা। ৩ থেকে ৫ জন নারী একসঙ্গে বসলে ঘণ্টায় ৩০০টি পাখা অনায়াসে তৈরি করা যায়।

হাঁপানিয়া গ্রামের ষার্টোর্ধ্ব বয়সী বৃদ্ধা সাবেজান বেগম জানান, তিনি এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে অদ্যবধি তালপাখা তৈরি করছেন। তালপাখা তৈরি করেই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার পুত্রবধূও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করেন। স্থানীয় মাহাতাব হোসেন বলেন, এখানকার মানুষদের বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত এখন এই তালপাখার গ্রাম হাঁপানিয়া। তবে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এ ছাড়া ঋণের টাকার সুদ বেশি হওয়া লাভের পরিমাণ কম হয় তাদের।

পাখা শিল্পী মকলেছুর রহমান জানান, গত অর্থ বছরে এ পল্লীর ‘পাখা শিল্প উন্নয়ন সমিতি’ তালগাছ রোপনের জন্য ৯০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিল। অনুদানের টাকায় আড়ানী-পুঠিয়া সড়কের উমরগাড়ি থেকে ফুলতলা পর্যন্ত রাস্তার দু ধার এবং মুসা খাঁ নদীর দুপাড়ে এক হাজার ৪০০ তালগাছের চারা লাগানো হয়েছে।

এ ব্যাপারে স্থানীয় জামনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, তালপাখার এই শিল্পকে ধরে রাখতে হবে। তাদের জীবন মানের উন্নয়ন দরকার। তাদের জন্য কম সুদে সরকারিভাবে ঋণ সুবিধা দিলে এ শিল্পটি বিকশিত হতে পারে। এতে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে।

স/শা