ভ্যাটে আর্থিক ক্ষতি বাড়বে জনসাধারণের

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বিশাল কর আদায়ের প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এই কর আদায়ের প্রতিটি স্তরে দুর্ভোগ বাড়বে সাধারণ মানুষের। বিশেষ করে সবক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নশ্রেণির মানুষের গলার ফাঁস হওয়ার আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদসহ ব্যবসায়ীরা।

সংসদে উপস্থাপিত বাজেট অনুযায়ী নিত্য ব্যবহারের লুঙ্গি, গামছাজাতীয় পণ্য, স্বল্প মূল্যের জুতা, হাওয়াই চপ্পল কিনতে গেলে দামের সঙ্গে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে দেশের সাধারণ মানুষকে। এর বাইরে যে কোনও পোশাক কিনতে গেলেও গুনতে হবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। দেশি ব্র্যান্ডের পোশাক কিনতে হলেও আগামী ১ জুলাই থেকে নির্ধারিত দামের বাইরে এই ভ্যাট দিতে হবে। একইভাবে পরিবারের কেউ চা খেতে চাইলেও নির্ধারিত দামের বাইরে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ভ্যাটের কবলে পড়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে দেশের সাধারণ মানুষ। আর এই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে কয়েকগুণ।

বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে যে বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছে বোতলজাত পানি, টুথপেস্ট, ব্রাশ, আসবাবপত্রের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যেও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে, যদিও এসব পণ্যের ভোক্তা দেশের আপামর জনগণ। এখানেই শেষ নয়, গ্রামের ও শহরের অতি সাধারণ মানুষদের ব্যবহৃত  বিদ্যুৎ বিলেও ভ্যাট বসানো হয়েছে। ফলে বিলেও আগের চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে। বাড়ি থেকে বের হয়ে কোনও কাজ বা চাকরির উদ্দেশ্যে বের হওয়া ব্যক্তিদের খরচ করতে হবে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। কারণ, রাস্তার পাশের একটি সাধারণ মানের রেস্টুরেন্টে খেতে গেলেও নির্ধারিত মূল্যের সঙ্গে গুনতে হবে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ ভ্যাট। এসি বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চে যাতায়াত করতে গেলেও দিতে হবে এই ভ্যাট।

এ প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘১৫ শতাংশ ভ্যাট বাস্তবায়িত হলে জীবনযাত্রার খরচ বেড়ে যাবে। যেসব পণ্যে রেয়াত দেওয়া হয়েছে, সেটা সাধারণ মানুষের কাজে আসবে কিনা সেটাই প্রশ্ন।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘এমনিতেই এখন ধান ও চালের দাম বাড়ছে। এর ওপর বিভিন্ন পণ্যে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হলে অন্য পণ্যের দামও বাড়ার আশঙ্কা থাকবে। এতে করে সার্বিক জীবনযাত্রা আরও ব্যয়বহুল হয়ে পড়বে।

জানা গেছে, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার হচ্ছে এমন ১৯ ধরনের প্লাস্টিকের পণ্যে ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এসব পণ্য সব শ্রেণির মানুষের বাসা-বাড়িতে প্রয়োজন হয়। এছাড়া ঘরে বানানো রুটি-বিস্কুট ও কেক জাতীয় পণ্যেও ভ্যাট হতে পারে ১৫ শতাংশ। এসব পণ্যে বাড়তি ভ্যাট দিতে হলে তার প্রভাব পড়বে ভোক্তার ওপর।

অন্যদিকে, ব্যাংকে আমানতের ওপর আবগারি শুল্কের নামে বাড়তি কর আরোপ হওয়ায় লাখ টাকার ওপর ব্যাংকে জমা হলেই বাড়তি টাকা গুনতে হবে। বিমান ভাড়ায় আবগারি শুল্ক বসানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। ফলে বিদেশ গমনেচ্ছু লাখ লাখ শ্রমিকের ওপর এর চাপ পড়বে।

এদিকে দেশি আসবাবপত্র কিনলেও সরকারকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। সেটা খাট হোক আর আলমারি হোক, চেয়ার হোক বা টেবিল হোক। নির্ধারিত দামের চেয়ে আরও ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিয়েই এসব অতি দরকারি আসবাবপত্র কিনতে হবে যে কাউকে। আবার মোবাইল প্রযুক্তির এই যুগে কুরিয়ার সার্ভিসে হয়ত আগের মতো চিঠি আসে না। তবে সংসারের কিংবা অফিসের ভারি জিনিসপত্র, বিভিন্ন রকম পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় আনা-নেওয়ার ক্ষেত্রে কুরিয়ার সার্ভিস এখনও অন্যতম ভরসার জায়গা। এই কুরিয়ার সার্ভিসকেও এবার ভ্যাটের আওতায় এনেছেন অর্থমন্ত্রী। ফলে অতি দরকারি যে কোনও জিনিসপত্র আনা নেওয়ার ক্ষেত্রেও এখন থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে সাধারণ মানুষকে।

কেউ যদি সোনা বা রূপার গয়না বউকে কিনে দিতে চান তাহলেও তাকে গুনতে হবে অতিরিক্ত ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটের বোঝা। সেটা পাড়া বা মহল্লার দোকান থেকে হোক আর শহরের ব্র্যান্ডের দোকান থেকেই হোক না কেন। গয়না কিনলেই দিতে হবে ১৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত ভ্যাট।

শহরে এসে তৃষ্ণা মেটানোর জন্য কোনও শ্রমিক বোতলজাত পানি কিনলেও তাকে গুনতে হবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট। মধ্যবিত্ত শ্রেণির কেউ যদি ফ্ল্যাট কিনতে চান তাহলে প্রতি বর্গফুটের নির্ধারিত দামের বাইরে আরও গুনতে হবে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটে যে কর ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে তাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এর ফলে ভোগ ব্যয়ও বাড়বে। এর ফলে মূল্যস্ফীতিও বেড়ে যাবে। এতে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে।

এদিকে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় এমন সব পণ্যকে রাখা হয়েছে যা সাধারণ মানুষের কোনও কাজেই আসবে না। যেমন, আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে শূকর, ভেড়া, ছাগল, ঘোড়া, গাধা, খচ্চর, ঘোটকের ভোজ্য নাড়িভুঁড়ি, বিভিন্ন আমদানি করা জীবন্ত পাখি, শূকরের মেদবিহীন মাংস, আড়াই কেজি পর্যন্ত কাঁটা ছাড়ানো মাছ ও মাছের অন্যান্য অংশ, ভোগের যোগ্য মাছের গুঁড়া, আমদানিকৃত পাখির ডিম। এগুলো সাধারণ মানুষের কোনও কাজেই লাগার কথা নয়। অথচ এইসব পণ্যে দেওয়া হয়েছে ভ্যাট অব্যাহতি। লেকোস্ট শিম, সামুদ্রিক আগাছা এবং অন্যান্য সমুদ্র শৈবাল, সূর্যমুখী ফুলকে রাখা হয়েছে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায়।

আবার শুভঙ্করের ফাঁকি হিসেবে কখনও ভ্যাট দিতে হয়নি এমন পণ্যকেও রাখা হয়েছে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায়। যেমন, আমদানি করা বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, শালগম, শসা, ক্ষীরা, টমেটোসহ অন্যান্য শাক-সবজিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অথচ এসব পণ্যে অতীতে কখনোই ভ্যাট ছিল না।

এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি জসীম উদ্দিন বলেন, ‘ভ্যাট অব্যাহতির যে তালিকার কথা বলা হচ্ছে, তার মাধ্যমে মূলত বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। তালিকায় থাকা বেশকিছু পণ্য আগে থেকেই ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় ছিল। নতুন করে এইচ এস কোড (পণ্য পরিচিতি নম্বর) সৃষ্টির মাধ্যমে তালিকা বড় করা হয়েছে।’

তিনি উল্লেখ করেন, তালিকায় থাকা বেশিরভাগ পণ্যই আমাদের দেশে ব্যবহার হয় না। যেমন- শূকরের মাংস, গাধা, খচ্চরকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এতে দেশের সাধারণ মানুষের কি উপকার হবে এ প্রশ্নও রাখেন তিনি।

 

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন