ভ্যাকসিন কূটনীতি : বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে

গত ৪ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাজ্য আয়োজিত ভার্চুয়াল গ্লোবাল ভ্যাকসিন সামিট-২০২০ এ ভাষণকালে করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারী থেকে মানবজাতিকে রক্ষার জন্য নতুন ভ্যাকসিনগুলো দ্রুত উদ্ভাবন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

তিনি আরও যোগ করে বলেছিলেন, আবিষ্কৃত টিকা সংক্রামক রোগগুলোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে। কোভিড-১৯ প্রমাণ করেছে যে কোনো বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের মধ্যে আমরা কতটা শক্তিহীন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরনো উক্তিটিও স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন যে, প্রতিরোধ প্রতিকারের চেয়ে সবসময়ই ভালো। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জিএভিআই জোটের (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস এবং ইমিউনাইজেশন) সহায়তা চেয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘অেঠও জোট আমাদের এ যুদ্ধে সেরা সমর্থন জোগাতে পারে এবং আমরা যদি তাদের এটি করতে দিই তবে তারা তা চালিয়ে যাবেন।’ বিশ্বসভায় আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্য হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে এবং তিনি ভ্যাকসিন কূটনীতিতে বাংলাদেশকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছেন।

বাংলাদেশে করোনা ভ্যাকসিনের ট্রায়ালের জন্য ভারত ও চীনের কূটনৈতিক চেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত প্রথম ট্রায়ালের জন্য চীনকেই অনুমতি দিয়েছে সরকার। তবে চীনকে আগে দেয়া হয়েছে, তার মানে এ নয় ভারতকে দেয়া হবে না- এমনটাই মনে করছেন কূটনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা আশা করছেন, ভারত যখনই প্রস্তাব দেবে, তখনই তাদের ট্রায়ালের সুযোগ দেবে বাংলাদেশ।

আর এর মধ্য দিয়ে দু’দেশের কাছ থেকেই ভ্যাকসিন পাওয়ার পথ উন্মুক্ত হচ্ছে বলে মনে করেন কূটনীতিকরা। চীনের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সিনোভ্যাককে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দিয়েছে সরকার। আইসিডিডিআর,বির সহযোগিতায় এ ট্রায়াল হবে। এর বাইরেও ভ্যাকসিন নিয়ে যেসব দেশ কাজ করছে তাদের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। চীন যেহেতু সবার আগে প্রস্তাব দিয়েছে তাই তাদের সবার আগে ভ্যাকসিন ট্রায়ালের অনুমতি দেয়া হচ্ছে।

বিশ্ববাসী আশা করছে, খুব দ্রুত একটি নিরাপদ ও কার্যকর ভ্যাকসিন সবার জন্য উন্মুক্ত হবে। মহামারী থেকে উদ্ধার পেতে হলে ভ্যাকসিনের কোনো বিকল্পও নেই। এখন পর্যন্ত ১৬০টির বেশি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের পথে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন গবেষকরা। এর মাঝে ৩১টি কোম্পানি মানবদেহে পরীক্ষা শুরু করেছে। ভ্যাকসিন আবিষ্কারে এ অগ্রগতি অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় নজিরবিহীন। এর মাঝে রাশিয়ার স্পুটনিক ভি, সেই দেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদনও পেয়েছে।

যদিও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের বড় একটি অংশ রাশিয়াকে আহ্বান জানিয়েছে, আবিষ্কৃত এ ভ্যাকসিন (স্পুটনিক ভি) সুরক্ষিত কি না তা দেখার জন্য বড় পরিসরে পরীক্ষা করতে। পৃথিবীতে স্প্যানিশ ফ্লু, কলেরা, গুটিবসন্ত, সোয়াইন ফ্লু, ইবোলা এ রকম আর কোনো মহামারীর সময় একটি প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য মানুষকে এতটা সংগ্রাম করেনি। আমরা জেনেছি, যেসব দেশের গবেষণা করে একটি ভ্যাকসিন আবিষ্কারের সক্ষমতা নেই- এটি পাওয়ার জন্য তাদের লড়তে হবে বিশ্বের উন্নত ও ধনী দেশগুলোর সঙ্গে। তাই সঠিকভাবে ভ্যাকসিন আবিষ্কার হওয়া মাত্রই কীভাবে এ ভ্যাকসিন দ্রুততার সঙ্গে পাওয়া যাবে তা নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে।

২.

এক হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর ভ্যাকসিন উৎপাদন ক্ষমতা ৬.৪ বিলিয়ন পর্যন্ত, যদিও এটা কেবল সিঙ্গেল ডোজ ইনফ্লুয়েঞ্জা ডোজের ওপর ভিত্তি করে বলা হচ্ছে। এটা ধারণা করা হয় যে, বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যার মাঝে দুই ডোজের ভ্যাকসিনের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পরিমাণে ইমিউনিটি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন হবে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডোজ- যা বর্তমানে ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার দ্বিগুণ।

এখন ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো যদি ব্যাপকভাবে তাদের উৎপাদন সক্ষমতাকে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন প্রস্তুত করার দিকে চালিত করে, তবে অন্যান্য রোগের (হাম, মাম্পস ও রুবেলা) ভ্যাকসিনের স্বল্পতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। উল্লেখ্য, ভ্যাকসিনের প্রয়োগে এসব রোগ রোধ করা যায়। দেখা যাচ্ছে, কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনকে অগ্রাধিকার দিতে গেলে অন্য রোগে আক্রান্তদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ভ্যাকসিন উৎপাদনের এ সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন দেশের সরকার ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে অধিকারপ্রাপ্তির নিশ্চয়তার জন্য অগ্রিম চুক্তি সম্পাদনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিল। এ ধরনের কমার্শিয়াল-ইন-কনফিডেন্স চুক্তি সচরাচর গোপনে স্বাক্ষরিত হয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এ জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মূল্য দিতে হয় সরকারগুলোকে।

এটি মূলত নির্ভর করে ক্রেতা হিসেবে তারা কত নম্বর অবস্থানে আছে এবং তাদের মূল্য পরিশোধের সক্ষমতার ওপর। এর অর্থ হচ্ছে যেসব দেশ অগ্রিম টাকা দিয়ে ভ্যাকসিন কিনতে সক্ষম হবে তারা আগে এটি পাবে, যার ফলে গরিব দেশগুলোর বাদ পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয় কিংবা তাদের বাধ্যতামূলকভাবে অপেক্ষায় থাকতে হয়। অতীতের দুটি ঘটনার ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটতে দেখা গেছে।

২০০৭ সালে দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়া সে সময় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি হওয়া সত্ত্বেও এইচ৫এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিন কিনতে পারেনি। এর কারণ ছিল অনেক ধনী দেশ অগ্রিম চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাকসিন কিনে নিয়েছিল। ২০০৯ সালে ধনী দেশগুলো এইচ১এন১ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভ্যাকসিনের প্রায় সব ডোজ কিনে নিয়েছিল, ফলে গরিব দেশগুলো বঞ্চিত হয়েছিল।

তাই অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের নেতা (যেখানে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনও আছেন) বলেছেন, কোভিড-১৯ এর সফল ভ্যাকসিন সমানভাবে ভাগাভাগি করা উচিত। জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়াও ১৬৫টি দেশের সঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি এবং কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপারেন্ডেন্স ইনোভেশনের শুরু করা ‘কোভ্যাক্স’ উদ্যোগে যোগ দেয়। এ উদ্যোগের লক্ষ্য ছিল ২০২১ সালের মধ্যে কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিনের ২ বিলিয়ন ডোজ সরবরাহ করা।

বিশ্বের ৬০ শতাংশ জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করা দেশগুলো এ উদ্যোগে স্বাক্ষর করেছে, যদিও সবাই এ উদ্যোগে নেই। অন্যদিকে আমরা বেশ কয়েকটি উদাহরণ দেখছি, যেখানে সরকারগুলো একটি অন্যটির ওপর অগ্রাধিকার পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে, যা কিনা সমতা ও প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। এটি সেসব দেশের সঙ্গে বৈশ্বিক সরবরাহের সংকট তৈরি করবে, যেখানে আগে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য বিশেষ চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে।

৩.

কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় প্রধান চ্যালেঞ্জটি হচ্ছে এর বিতরণ ব্যবস্থাপনা। বেশিরভাগ ভ্যাকসিন বিশেষ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় পরিবহন করা দরকার। যা বিশ্বের অনেক দেশের জন্য সমস্যা তৈরি করে যেসব অঞ্চলে বৈদ্যুতিক গোলযোগ একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ৫০ শতাংশ ভ্যাকসিন প্রতি বছর নষ্ট হয়, এর কারণ হচ্ছে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অভাব।

এদিকে বিমানযাত্রায় আন্তর্জাতিক যাত্রীর সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ার সঙ্গে কার্গো চলাচলও শ্লথ হয়ে এসেছে। ভ্যাকসিন বিতরণকে সামনে রেখে এয়ারলাইন্সগুলোর সঙ্গে এ সমস্যার একটি কার্যকর সমাধান করা দরকার। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বর্তমানে ফ্রিজে (অবশ্যই নির্দেশিত তাপমাত্রায়) ওষুধ মজুদ রাখার যে সক্ষমতা আছে তা কীভাবে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বাড়ানো যায়, সেটা নিয়ে গ্যাভির মতো সংস্থাগুলোকে পরামর্শ ও সাহায্য দিচ্ছেন।

সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ‘ভ্যাকসিন বিতরণ হবে ন্যায্যতা ও সাম্যের ভিত্তিতে’। বরাবরই প্রশ্ন উঠেছে- কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির পর তা কীভাবে বিভিন্ন দেশে বিতরণ করা হবে। বিশ্বের সব দেশ যাতে ন্যায্য এবং সাম্যের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পায়- সে জন্য কিছু নীতিমালা জারি করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

এক্ষেত্রে ডব্লিউএইচওর সঙ্গে কাজ করছে গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন অ্যান্ড ইমিউনাইজেশন (গ্যাভি) এবং কোয়ালিশন ফর ইপিডেমিক প্রিপারডনেস ইনোভেশন (সিইপিআই)। এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতিমালায় বলা হয়েছে, কার্যকর ভ্যাকসিন প্রথমে কারা পাবে- তা আগে থেকেই ঠিক করতে হবে।

কার্যকর ভ্যাকসিন এলে তা যেন কোনোভাবেই ধনী দেশের হাতে সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করতে চায় ডব্লিউএইচও। এটি করা গেলে ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি গরিব দেশের মানুষও ন্যায্য এবং সাম্যের ভিত্তিতে ভ্যাকসিন পাবে। ভ্যাকসিন বিতরণের ক্ষেত্রে দুটি ধাপ অনুসরণের পরামর্শ দিচ্ছে ডব্লিউএইচও। তাদের পরামর্শ মতে, প্রথম ধাপে প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে সব দেশে ভ্যাকসিন দিতে হবে। দ্বিতীয় ধাপে বিশ্বের যেসব দেশে করোনা ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে সেখানে বেশি সংখ্যক ভ্যাকসিন সরবরাহ করতে হবে।

প্রতিটা দেশকেই নির্ধারণ করতে হবে- সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মী, শিশু, গর্ভবতী নারী নাকি বয়স্ক জনগোষ্ঠী কারা প্রথমে ভ্যাকসিন পাবে। এক্ষেত্রে অনেক বিষয় জড়িত। ডব্লিউএইচওর পরিচালক টেড্রোস আধানোম গেব্রেয়েসাস বলেন, প্রতিটি দেশকে তার দেশের সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাধান্য দিতে হবে। প্রথম ধাপে প্রতিটা দেশের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ ভ্যাকসিন দিতে পারলে তা ঝুঁকিপ্রবণ জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হবে।

ন্যায্যতার ভিত্তিতে ভ্যাকসিন বিতরণ কার্যক্রম প্রতিটা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার পাশাপাশি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে সহায়তা করবে। এ ছাড়া শিশু এবং বয়স্কদের কাছে ভ্যাকসিন পৌঁছানো গেলে মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। ইতোমধ্যে রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে ভ্যাকসিন বিতরণের ক্ষেত্রে তারা করোনা প্রতিরোধে মাঠে থাকা সম্মুখসারির স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাধান্য দেবে।

৪.

ভারতের বাজারে আসার দৌড়ে রয়েছে মূলত ৩টি সংস্থার সম্ভাব্য টিকা। দুটি ভারতীয় সংস্থার তৈরি- ভারত বায়োটেকের ‘কোভ্যাক্সিন’ এবং জাইডাস ক্যাডিলার ‘জাইকভ-ডি’। তৃতীয়টি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোভিশিল্ড’, ভারতে যার উৎপাদন, গবেষণা ও প্রয়োগের বিষয়টি দেখছে সিরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া। বিদেশি সংস্থার টিকা বাজারে ছাড়তে হলে অন্তত তৃতীয় ধাপের পরীক্ষাটি দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপরে করার নিয়ম রয়েছে। কোভিশিল্ডের তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা চলছে। সিরাম ইন্সটিটিউট জানিয়েছে, সব ঠিক থাকলে নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই ওই টিকা আসবে। টিকা তৈরিতে সিরামের হাত ধরেছে মার্কিন সংস্থা নোভাভ্যাক্স।

‘স্পুটনিক ভি’ টিকা তৈরিতে ভারতকে পাশে চায় রাশিয়াও। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ের পরীক্ষা রাশিয়া ঠিকমতো করেনি বলে অভিযোগ ওঠায় তাদের টিকা নিয়ে দ্বিধায় দিল্লি। বিরোধীদের আশঙ্কা, তাড়াহুড়া করলে একই রকম অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধেও উঠবে না তো? ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ৭টি দেশে ভ্যাকসিনের অ্যাডভান্সড ট্রায়াল শুরু করেছে। টিকার (ভ্যাকসিন) পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বাংলাদেশে শুরু করা উচিত বলে অভিমত দিয়েছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। সে লক্ষ্যে টিকা উৎপাদনকারী দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য সচিব।

এখন বাংলাদেশে কোনো টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করা হলে কী লাভ হবে, সে বিষয়ে সরকারের ভ্যাকসিনবিষয়ক কমিটির সদস্য ডা. শামসুল হক বলেছেন, ‘কোনো দেশে ভ্যাকসিন পরীক্ষার পর যদি এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পায় তাহলে যে দেশে পরীক্ষা চালানো হয়েছে, সেখানে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সহজ হয়ে যায়।’ আবার যারা এ ভ্যাকসিন উৎপাদক তারা যেসব দেশে পরীক্ষা চালায় উৎপাদকরা সে দেশকে সাধারণত অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।

চীন মোট ৬টি দেশে তাদের তৈরি ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ট্রায়াল শুরু করেছে। দেশগুলো হল- ব্রাজিল, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, চিলি, ফিলিপিন্স ও তুরস্ক। একটা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ হচ্ছে, কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াইয়ের ঘোষণা দিয়েছে বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ও সিরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া। ভারতীয় কোম্পানিটির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে অক্সফোর্ডের তৈরি করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন আনবে বেক্সিমকো।

শুক্রবার (২৮ আগস্ট) কোম্পানি দুটির পক্ষ থেকে এক যৌথ ঘোষণায় এ তথ্য জানানো হয়েছে। মূলত বাংলাদেশের বেসরকারি বাজারের জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহ নিশ্চিত করবে বেক্সিমকো। ভ্যাকসিনটি যখন নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অনুমোদন পাবে, তখন যেসব দেশ সবার আগে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভ্যাকসিন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাবে তাদের মধ্যে বাংলাদেশকেও অন্তর্ভুক্ত করবে এসআইআই (সিরাম ইন্সটিটিউট অব ইন্ডিয়া)। উৎপাদন সক্ষমতা ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির পূর্ববর্তী অঙ্গীকারের ওপর নির্ভর করবে বিপিএলের (বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড) বিনিয়োগের পরিমাণ ও বাংলাদেশের জন্য এসআইআইয়ের অগ্রাধিকারমূলক ভ্যাকসিন সরবরাহের পরিমাণ।

বাংলাদেশ সরকারের প্রয়োজন নিশ্চিতের ব্যবস্থাও বিপিএল করবে জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ও এসআইআইয়ের মধ্যে সম্মত হওয়া মূল্যে অগ্রাধিকারমূলক সরবরাহের জন্য চাহিদামাফিক ভ্যাকসিন সংরক্ষণের প্রস্তাব দেয়া হবে সরকারকে। বাংলাদেশ সরকার গত ২৭ জুন ইউরোপীয় কমিশন এবং গ্লোবাল সিটিজেন আয়োজিত ‘গ্লোবাল সিটিজেন ফর দ্যা প্লেজিং সামিট’ নামক বৈশ্বিক আলোচনায় করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কারের জন্য বৈশ্বিক চেষ্টার অংশ হিসেবে ৫০ হাজার ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ পরিসরে আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ঘোষণা অনুয়ায়ী ওষুধ খাতে বাংলাদেশ আরও ১৩ বছর মেধাস্বত্ব ছাড় পাবে। বাংলাদেশ যখন এলডিসিভুক্ত দেশ ছিল, তখন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিশেষ সুবিধা পেত যার মেয়াদ ছিল ২০১৬ পর্যন্ত। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৃজনশীল কূটনৈতিক দক্ষতায় তা বাড়িয়ে ২০৩৩ পর্যন্ত অর্জন করা গেছে। তা না হলে এখনই আমাদের অনেক বেশি দামে ওষুধ কিনতে হতো। সবাই স্বীকার করবেন, সৃজনশীল কূটনীতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছেন। ভ্যাকসিন কূটনীতিতে সেটা আরেকবার প্রমাণিত হবে- ধারণার চেয়েও আরও বেশি কিছু অর্জন করতে পারি।

সুভাষ সিংহ রায় : সাবেক সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল

 

সূত্রঃ যুগান্তর