ভোর থেকে অপেক্ষা :টিসিবির পণ্য যেন ‘সোনার হরিণ’

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

ভোরের আলো তখনো ফোটেনি, আবছা অন্ধকার। তখন থেকেই পূর্ব রামপুরার ১৩৮-১৯/২ নম্বর দোকানের সামনে চার নারীর অপেক্ষা, কখন খুলবে দোকান। শুরুতে এই চারজন থাকলেও আধাঘণ্টার মধ্যেই সেখানে ২০ জনের মতো নারী-পুরুষ হাজির হন। দোকানটি এই এলাকার টিসিবির ডিলারের বিক্রয়কেন্দ্র। আজ থেকে সেখানে পণ্য বিক্রি শুরু হওয়ার কথা। সেজন্যই ভোর থেকে কম দামে পণ্যের আশায় এসব মানুষের অপেক্ষা।

সেখানে কথা হয় প্রথমে আসা আঞ্জুয়ারার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বাড়ির চ্যাল শ্যাষ (চাল শেষ)। আজ মাল দিবো শুনছি। আগে-ভাগে পাইলে খাওন শ্যাষ করে কামে যাওন যাইতো। তাই নামাজ পড়েই আইছি।’

আরেক নারী হালিমা খাতুন বলেন, ‘পরে আইলে মাল পাওন যায় না। আবার ছুটা কামে যাওন লাগবো ৯টার মধ্যে। ওইদিন (গত মাসে বিক্রি কার্যক্রমের সময়) সকাল ৭টায় আইসা সামনে যত্ত বড় লাইন, মাল পাইতে তিন ঘণ্টা লাগছে। বৃষ্টিতে ভিজনও লাগছে। কামে যাইতে পারিনি।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই টিসিবি পণ্য কিনতে ভিড় বাড়তে থাকে। তখন সেখানে দাঁড়ানো ষাটোর্ধ্ব বেশ কয়েকজন বৃদ্ধা। তারা মৌখিকভাবে নিজেদের মধ্যে সিরিয়াল করে নিলেন। আধাঘণ্টার মধ্যে আরও কয়েকজন পুরুষ সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে যান। উপস্থিতি বাড়তে শুরু হলে একজন হাতে হাতে লিখে সিরিয়াল দেওয়া শুরু করেন। তখন বাজে সকাল সাড়ে ৬টা। এসময়েই সেখানে সাতজন নারী আর ১৩ জন পুরুষ উপস্থিত হয়ে যান। ওই কেন্দ্রে পণ্য বিক্রি শুরু হয় সকাল ৮টায়।

সিরিয়াল দিচ্ছিলেন সবুজ ইসলাম নামের এক যুবক। তিনি বলেন, ‘পণ্য নিতে আসা সবারই ফ্যামিলি কার্ড রয়েছে। তারপরও দোকান খুললে হুড়োহুড়ি শুরু হয়। তাই কেউ একজন প্রতিবারই সিরিয়াল করে দেন। সিরিয়াল নিয়ে এদিক-ওদিক অপেক্ষা করেন সবাই। দোকান খোলার আগে আগে এসে আবার লাইনে দাঁড়ান। সেসময় কার্ডধারীর সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে যায়।’

সেখানে পণ্য কিনতে আসা আলাল হোসেন বলেন, ‘টিসিবি মাসে দুই লিটার তেল দেয়। এর বাইরে প্রতি মাসে আরও দুই লিটার তেল বাজার থেকে কিনতে হয়। গত মাসের চার লিটার তেল শেষ হয়েছে। পাশের বাড়ি থেকে এক কাপ তেল ধারও করতে হয়েছে। আজ পণ্য পেলে খুব সুবিধা হতো। না হলে বাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘ডিলার পণ্য করে ১০০ লোকের, নিতে আসের ৩০০ জন। তাই পাওয়া যায় না। এখানে পণ্য দেওয়া আজ থাকে শুরু করে আগামী কয়েকদিন দেবে। তারপরও প্রথম দিনে সবাই পণ্য নিতে আসেন, কারণ ঘরে পণ্য শেষ হয়ে যায়।’

টিসিবির কার্ডধারীরা জানান, লাইন থেকে পাঁচ কেজি চাল, এক কেজি চিনি, দুই কেজি মসুর ডাল ও দুই লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারেন তারা। খোলাবাজারে এগুলোর দাম প্রায় দ্বিগুণ। তবে একটি পরিবারের জন্য এ বরাদ্দ পর্যাপ্ত নয়। ফলে মাস শেষের আগেই তাদের পণ্য শেষ হয়ে যায়। অপেক্ষা করতে হয় আগামী বরাদ্দের জন্য। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, শ্রমজীবী মানুষকে তাই কাজ ফেলে ভোর থেকে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়।

এছাড়া ওয়ার্ডের নির্ধারিত স্থানে পণ্য নিতে না পারলে অন্যখানে পণ্য নিতে ভোগান্তি হয়। সেখানে পণ্য নিতে আসা মনু আক্তার বলেন, ‘এখানে মাল না পাইলে পশ্চিম রামপুরা ওয়াপদা রোড যেতে হবে। সেখানে কেউ পরিচিত নন। লাইনে গন্ডগোল হয় সেজন্য। পণ্য আনতেও বাড়তি খরচ হয়।’

টিসিবির কার্ডধারীদের এসব কথোপকথনের মধ্যে অনেকেই ফোন দিচ্ছিলেন ওই এলাকার ডিলারের কাছে। আমিনুল ইসলাম নামের ওই ডিলার কারও ফোনই ধরছিলেন না। জাগো নিউজের এই প্রতিবেদকও তাকে ফোন দিয়ে পাননি।

খালেক হোসেন নামের একজন উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ‘আযথা আমরা ভিড় বাধাইছি। যে মাল দিবে সে তো ঘুমাইতাছে। তার কি আমাগো নিয়ে চিন্তা আছে? মাল দিবো কি দিবো না, আল্লাহই জানে।’ এসময় পাশ থেকে একজন বারবার বলছিলেন, ‘কাল আমার সাথে কথা হইছে। আজ মাল দিবো। এমনি এমনি মানুষ আইসা খাড়াইছে?’

এর আগে ওই বিক্রয়কেন্দ্র থেকে পণ্য না পেয়ে ফিরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে অনেকের। এমন একাধিক ব্যক্তির অভিযোগ, ‘কার্ড বিতরণের দায়িত্বে থাকা ওয়ার্ড কাউন্সিলর তাদের কর্মী-সমর্থক ও পছন্দের লোকজনকে অতিরিক্ত কার্ড দিয়েছেন। কোনো কোনো পরিবারের একাধিক সদস্যকেও কার্ড দেওয়া হয়েছে। আবার অনেকেরই ডিলারের সঙ্গে সখ্যতা থাকায় লাইনে না দাঁড়িয়ে সরাসরি এসে পণ্য নিয়ে যান। তাদের জন্য জটলা তৈরি হয়।’

এছাড়া ডিলারের অদক্ষতা ও গাফিলতিতে পণ্য পেতে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অভিযোগ করে তারা বলেন, ‘দুজন লোক দিয়ে তাদের মধ্যে পণ্য বিক্রি করা হয়। লাইনের সবাই সুশৃঙ্খল থাকলেও বাইরের লোককে দেওয়া হয় নিয়ম বহির্ভূতভাবে। ফলে অনেক আগে এসে লাইনে দাঁড়ানো লোকজনও বিশৃঙ্খলার কারণে পেছনে পড়ে যান। শেষমেষ অনেকে পণ্য পান না।’

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ধারাবাহিক ঊর্ধ্বগতির ফলে সাশ্রয়ী দামে চালসহ অন্যন্য পণ্য কেনার চাপ এখন এমন নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষদের অধিকাংশের। কিন্তু চাহিদার তুলনায় সরকারের বরাদ্দ অনেক কম। আবার অনেক দরিদ্র মানুষ টিসিবির কার্ড পাননি। অর্থাৎ তারা সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য কিনতে পারছেন না।

বিক্রি কার্যক্রম শুরুর আগে এমন অনেক মানুষকেই দেখা গেছে যারা টিসিবির কার্ড ছাড়া পণ্য নিতে ডিলারের সঙ্গে কথা বলতে চান। সেসব দরিদ্র মানুষকে লাইনে থাকা কার্ডধারীরা বুঝিয়ে ফেরত পাঠাচ্ছেন। তারা বলছেন, ‘কার্ড ছাড়া এখানে পণ্য দেওয়া হয় না। কমিশনারের কার্যালয়ে যোগাযোগ করুন।’ তারপরও দু/একজনকে বিক্রয় কার্যক্রমের আশপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

আক্কাস আলী নামের একজন বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করেও কার্ড পাইনি। পরিবার নিয়ে এখানে থাকলেও আমি রংপুরের মানুষ। ওইখানকার ভোটার। এখানকার কমিশনার কেন আমাকে কার্ড দেবে? দেননি।’

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) তথ্য অনুসারে, অতিদরিদ্র মানুষের আয়ের ৩২ শতাংশ ব্যয় হয় চালের পেছনে। বাজারে চাল-আটাসহ সব নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র মানুষের পক্ষে মাছ-মাংস বাদ দিয়েও একজন সংসার চালানো মুশকিল হয়ে গেছে। বাজারে এক কেজি মোটা চালের দাম হয়েছে ৬০ টাকা, যা টিসিবির বিক্রয় কেন্দ্রে ৩০ টাকা। ফলে ৫ কেজি চালে সাশ্রয় হচ্ছে ১৫০ টাকা। এছাড়া দুই লিটার সয়াবিন তেল বাজারে তুলনায় ৭৫ টাকা, এক কেজি চিনি ৭০ টাকা, দুই কেজি মসুর ডাল ১২০ টাকা কমে পাওয়া যাচ্ছে।

আবুল খায়ের ভূঁইয়া নামের একজন বলেন, ‘টিসিবির মাল পেলে যে ৫০০ টাকার মতো কম লাগে, সেটা অন্য অনেক বড় পাওয়া। যেন সোনার হরিণ।’

তিনি বলেন, ‘মাল পেতে কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু পেলে অনেক শান্তি লাগে। কয়েকদিন চাল, তেলের কষ্ট থাকে না। নিশ্চিন্তে ঘুম হয়।’

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চলতি বছরের জরিপের তথ্য বলছে, মানুষ খাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। মার্চ মাসে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, বাজারে দিনের পর দিন জিনিসপত্রের দাম বাড়তে থাকায় খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলেছে নিম্নআয়ের মানুষ। তারা কম খাচ্ছে। এর মধ্যে ৯৬ দশমিক ৪ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ পরিবার মাছ কম খাচ্ছে।

দেশের আট বিভাগের নিম্নআয়ের এক হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর জরিপ করেছিল সানেম। পরে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাছ-মাংস ছাড়াও অন্যান্য খাবার খাওয়ার ক্ষেত্রেও লাগাম টেনেছে দরিদ্র মানুষ। এর মধ্যে ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ দশমিক ৪৩ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে। প্রায় ৪৬ শতাংশ পরিবার ডাল, ৫৭ শতাংশ পরিবার আটা ও ৩৭ শতাংশ পরিবার ভাত কম খাচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সংস্থটির নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘ওই সময়ের থেকে (চলতি বছরের শুরুর দিক) এখন আরও খরচ বেড়েছে। সেসময়-ই আমরা দেখেছি দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যে, বেশিরভাগ নিম্নআয়ের পরিবার ঋণ করে চলছে, এখন পরিস্থিতি আরও কঠিন। বাড়তি আয় নেই বলে এখন অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। যাদের সে সুযোগ নেই এমন মানুষ আরও বিপদে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের এমন সাশ্রয়ীমূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রমসহ আরও যেসব সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম রয়েছে সেগুলোর ব্যাপ্তি আরও বাড়ানো উচিত। দরিদ্র মানুষের দিকে আরও বেশি নজর দেওয়া দরকার।’