ভিন্ন মানদণ্ডে দেখা মানেই শত্রু নয়

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সমালোচনা, না সহযোগিতা কোনটি আগে এটি একটি অনুত্তীর্ণ প্রশ্ন; তারও আগে বলা ভালো এই প্রশ্ন আসাটা ঠিকও নয়। দুর্যোগে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, একে অন্যকে সহযোগিতা করতে হবে, যার যার সামর্থ্য ও সাধ্যের সবটুকু করতে হবে; এসব করতে হবে সবাই মিলে বাঁচার স্বার্থেই। দুর্যোগ একটা চেইনের মতো।

একটি সমস্যা ডেকে আনে আরও কত মাত্রার সমস্যা! এর যে কোনোটি নিয়ে মতভিন্নতা থাকতেই পারে। সেই মতভিন্নতাকে গ্রহণ করার সহিষ্ণুতা থাকা দরকার। না থাকলে সেটাও আরেক মাত্রার দুর্যোগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্মর্তব্য; তিনি বলেছিলেন, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে সে যদি সংখ্যায় একজনও হয় আমরা তার ন্যায্য কথা মেনে নেব।

মুশকিল হল আমরা ব্যক্তিস্বার্থে, সুবিধা আদায়ের জন্য হাজারও ছলে বঙ্গবন্ধুর বন্দনা করি; কিন্তু তার ন্যায্য কথাগুলোকে না গ্রহণ করি, না বাস্তবে প্রয়োগ করি। মনে রাখা দরকার, সবাই মিলে আমরা দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলা করছি। ধরে নিতে হবে এ সমালোচনার সঙ্গে আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত। অন্য অর্থে এটা নিজেদেরও সমালোচনা।

আমরা জনগণও অনেক ভুল করেছি। বিদেশ থেকে ফিরে পরিচয় গোপন করেছি। প্রবাসী কারও সংস্পর্শে এসে ডাক্তারের কাছে গোপন করে ডাক্তার এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের করোনা ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছি। হোম কোয়ারেন্টিনের নিয়ম-কানুন মেনে চলিনি। আইসোলেশনকে দণ্ড হিসেবে গণ্য করেছি। তথ্য গোপন করে জনসমাবেশে গিয়ে কমিউনিটির মধ্যে করোনা ছড়িয়েছি। যখন পরিচয় প্রকাশের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তখন পালিয়ে গিয়েছি, স্বজনদের বিপদে ফেলেছি। এমন তালিকা করা হলে অপরাধের পরিমাণ বাড়তেই থাকবে।

আইন যারা মানে না তাদের তা মানতে বাধ্য করানোর জন্য রাষ্ট্রের যেসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাদের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা দরকার। স্বচ্ছতার তাগিদেই দরকার। জবাবদিহি, স্বচ্ছতা এবং তথ্যের অবাধ প্রবাহ যে কারণে স্বাভাবিক সময়ে প্রয়োজন, একই কারণে যে কোনো দুর্যোগ পরিস্থিতি এবং করোনা মোকাবেলায়ও প্রয়োজন। করোনা ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা কেবল একটি প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত কী উচিত নয় তা নিয়ে করোনা সংকটের প্রথম পর্যায়েই মতভিন্নতা ছিল। সেই ভিন্ন মতকে আমলে আনা হয়নি।

বরং কঠিন সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল ভিন্নমত পোষণকারীদের। অতি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে আইইডিসিআরও তখন বলেছে, সবার ঢালাওভাবে পরীক্ষার দরকার নেই। উপসর্গ অনুসারে পরীক্ষা করা যাবে। এখন দেখা যাচ্ছে তাদের বিধি মোতাবেক উপসর্গ অনুসারে পরীক্ষা করতে গিয়ে বহু করোনা রোগীই অশনাক্ত থেকে গেছে। বারবার এ প্রতিষ্ঠান বলেছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী তারা সব কাজ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে দেখেছি, পরিষ্কার লেখা আছে প্রত্যেক সন্দেহভাজন রোগী শনাক্তে কার্যকর ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে।

এখন যদি বলি, বাংলাদেশে সন্দেহভাজন রোগী আমরা প্রায় সবাই অথচ গত ২৬ মার্চ পর্যন্ত করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে মাত্র ৯২০ জনের! তাহলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা আইইডিসিআর মেনে চলছে এ দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা সঙ্গত কিনা। নীতিনির্ধারক মহল বুঝতে পারছেন তাদের আগের সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল? নিশ্চয়ই। স্বীকার না করলেও এটা সত্য। ভুল ছিল বলেই করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তকরণের পরিসর বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এখন থেকে আইইডিসিআরের তিনটি জায়গায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। এটা আরও বাড়ানো দরকার। হয়তো আরও বাড়বেও।

প্রশ্ন উঠেছিল প্রস্তুতি ও সক্ষমতা নিয়েও। স্বীকার করা হয়নি। এখন চড়ামূল্য দিতে হচ্ছে। মূল্য আমরা সবাই দিচ্ছি। তবু ভালো যদি বুঝি সমালোচনা সংশোধনের পথকে উন্মুক্ত করে। করোনাকালীন যে ক’টি বাক্য খুব বেশি ব্যবহার করা হয় তার একটি ‘সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকরণ কর্মসূচি’। যার আরেকটু সম্প্রসারিত রূপ হচ্ছে লকডাউন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিন্তু বলছে লকডাউন করে সংক্রমণ পুরোপুরি ঠেকানো যাবে না।

এটা আপৎকালীন, আপাত ব্যবস্থা। ঠিক আছে। যেহেতু বিদেশ ফেরতদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন মানতে বাধ্য করা সম্ভব হয়নি সেজন্য লকডাউন এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকরণই এখন ভরসা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকরণ কর্মসূচি কতটুকু কার্যকর হচ্ছে? কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের খুব কাছাকাছি বাসা হওয়ার সুবাদে প্রতিদিন কিছু দৃশ্যের মুখোমুখি হই। সন্দেহভাজন এবং আইসোলেশনে থাকা করোনা রোগীদের তত্ত্বাবধায়করা নিরাপত্তা পোশাক ছাড়া সাবলীলভাবে রাস্তায় চলাফেরা করছেন, কাঁচাবাজারে যাচ্ছেন।

অথচ এরা চব্বিশ ঘণ্টা করোনা রোগীর সংস্পর্শে থাকছেন। দেখি, করোনা রোগীদের খাবার নিয়ে বাড়ি থেকে যেসব স্বজন আসছেন তাদের মুখে মাস্ক নেই, হাতে গ্লাভস নেই। সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থায় তারা কথা বলছেন হাসপাতালের স্টাফদের সঙ্গে। প্রতিদিন কোনো না কোনো প্রয়োজনে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালের সড়কটি ব্যবহার করছি, করতে বাধ্য। হাসপাতালটিও পার করছি হেঁটেই। সামাজিক বিচ্ছিন্নকরণ কর্মসূচি এখানে কতটুকু কার্যকর হচ্ছে?

করোনা আমাদের সামাজিক মূল্যবোধে কতটুকু পরিবর্তন এনেছে? করোনায় আক্রান্ত মুসলিম সম্প্রদায়ের কেউ মারা গেলে তার জন্য খিলগাঁও তালতলা কবরস্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এখানে যেন কবর দেয়া না হয় তার জন্য এলাকাবাসী প্রতিবাদ মিছিল পর্যন্ত করেছে। এলাকাবাসী একবারও ভাবলেন না লাশ দাফন না করে রাস্তায় ফেলে রাখলেও কিন্তু তারা সংক্রমণের হাত থেকে রেহাই পেতেন না।

উল্টো আরও বেশি লোকের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ গেল সামাজিক মনস্তত্ত্বের একটি নিষ্ঠুরতার মাত্রা। ২৪ মার্চ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে একটি মরদেহ তালতলা কবরস্থানে গেছে। মরদেহের সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ ছিল না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী মৃতদেহ সরানো, পরিবহন, সৎকার বা দাফনের আগে পুরো দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্ধারিত কর্মীদের।

অথচ মৃতদেহটি দাফনের সময় স্বাস্থ্য অধিদফতরের কেউ না থাকায় বাধ্য হয়ে এলাকার কাউন্সিলর নিজেই দাফনের ব্যবস্থা করেছেন এবং বিপদে পড়েছেন। একে কেউ বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারেন। হতে পারে বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিচ্ছিন্ন ঘটনাও যদি অতি ভয়ঙ্কর রূপ ধরে সামনে আসে তা ফোবিয়া তৈরির জন্য যথেষ্ট। স্বাস্থ্যকর্মী এবং চিকিৎসকদের সুরক্ষা পোশাক পাওয়ার অধিকার সবার আগে। দেখি, আমলারা সুরক্ষা পোশাক পরে সংবাদমাধ্যমের সামনে কথা বলছেন। সুরক্ষা পোশাকের অপ্রতুলতার এ সময় আমলাদের গায়ে সুরক্ষা পোশাক দেখে অস্বস্তি হয়। এমন আমলা মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।

প্রকৃতি স্বপ্রণোদিত হয়েই সঙ্গতি ও ভারসাম্য রক্ষা করবে। করোনা যাবে, যেতেই হবে। সবাই মিলেই আমরা করোনাকে জয় করব। তবে সেটা যত কম মাশুল দিয়ে জয় করা যায় তত ভালো।

জয়া ফারহানা : গল্পকার ও প্রাবন্ধিক