ভালোবাসা ও অশ্রুতে মাখা এসব স্মৃতি কি কখনো ভোলা যায়?

আগের বছর গেলেন তরিকুল ভাই। তার পরের বছরেই খোকা ভাই। কী আশ্চর্য মিল! তরিকুল ইসলাম ও সাদেক হোসেন খোকা। ওই দু’জনে ঠিক একই তারিখে চিরবিদায় নিলেন এই দুনিয়া থেকে। চৌঠা নভেম্বর।

তাঁরা দু’জনেই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সরকারে ছিলেন কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে। খোকা ভাই মন্ত্রীর মর্যাদায় অখণ্ড ঢাকার মেয়রও ছিলেন। তবে বয়সে তাঁরা সমান ছিলেন না। দু’জনে এক লেভেলের রাজনীতিবিদও ছিলেন না। তরিকুল ভাই ছিলেন অনেক সিনিয়র এবং খোকা ভাইয়েরও নেতা। দু’জনেই মওলনা ভাসানীর অনুসারী ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন ও ন্যাপ করতেন। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন। উভয়ই খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করতেন। আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ ছিলেন দু’জনেই। বিএনপি গঠনের সময় ভাসানী ন্যাপ এই নতুন দলে মার্জ হয়ে যায়। তরিকুল ভাই সেই গঠনকাল থেকেই বিএনপিতে যুক্ত হন। খোকা ভাই তখন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও স্পোর্টিং ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি বিএনপিতে যোগ দেন আরেকটু পরে।
কেন জানিনা এই দু’জনেই আমাকে দারুণ পছন্দ করতেন। মন খুলে কথা বলতেন। মাঝে মাঝেই ডেকে নানান বিষয়ে আলাপ করতেন। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের শুরুর দিক থেকেই আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল এক নিবিড় সম্পর্ক।

১৯৯১ সালে দু’জনেই মন্ত্রী হন। শত ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝে মাঝে তারা ডেকে নানান বিষয়ে কথা বলতেন। বিভিন্ন পার্টিতে এবং বাসার অনুষ্ঠানেও দাওয়াত দিতেন। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মিলিত আন্দোলন ভয়ঙ্কর নৈরাজ্যের দিকে মোড় নিলে এ যোগাযোগ আরো বাড়ে। প্রতি সপ্তাহেই অন্ততঃ ২/৩ দিন সন্ধ্যায় মন্ত্রী তরিকুল ভাই তাঁর মিন্টো রোডের সরকারি বাসায় ডেকে পাঠাতেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রচার প্রচারণার নানান কাজে তারা আমার পরামর্শ চাইতেন।

আমি প্রধানমন্ত্রী অফিসে যোগ দিলে মন্ত্রী হিসেবে তরিকুল ভাই যেদিনই পিএমও-তে আসতেন সিগারেট খাবার ছলে আমার রুমে এসে অন্তত ঘণ্টাখানেক আড্ডা দিয়ে যেতেন। মাঝে মাঝে বাসায় এবং সচিবালয়ের অফিসেও ডেকে পাঠাতেন আমার হাতে কাজ না থাকলে।

খোকা ভাইও মাঝে মাঝে ছুটির দিনে তাঁর বাসায় দুপুরের খাবার দাওয়াত দিতেন। দু’জনেই রাজনৈতিক আলোচনা খুব পছন্দ করতেন। জরুরি অবস্থা জারি হলে খোকা ভাই এক দুপুরে তাঁর বাসায় আমাকে খেতে ডাকলেন। গিয়ে দেখি সেখানে হায়দার আকবর খান রনো ভাইও আছেন। খোকা ভাই আমাদেরকে বললেন, আপনাদের সঙ্গে তো মান্নান ভাইয়ের (আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া)-র সম্পর্ক ভালো। উনার ভাবভঙ্গি বিশেষ সুবিধার মনে হয় না। একটু কথা বলে দেখেন। এখন খারাপ সময়। বাঁচার জন্য কিছু চালাকি টালাকি করতে হলে করুক। কিন্তু উনি যেন বিট্রে না করেন ম্যাডামের সঙ্গে।

আমি মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে আমার সর্বশেষ আলাপ এবং ঝগড়া করে চলে আসার বিবরণ দিয়ে বললাম, “উনি অলরেডি বিট্রে করে ফেলেছেন। উনাকে ফেরাবার আর পথ নাই।” রনো ভাইও তাতে সায় দিয়ে বললেন, “আমিও সে রকমই মনে করি।” খোকা ভাই বললেন, “আচ্ছা আমিই তাহলে চেষ্টা করে দেখি। এতো সহজে হাল ছাড়বো না।” উনি সাবেক দু’জন প্রতিমন্ত্রীর নাম ধরে বললেন, “এই শয়তান দুটোই মান্নান ভাইয়ের পেছনে লেগে থেকে উনার মাথাটা খারাপ করে দিচ্ছে।”

ম্যাডামের সঙ্গে খোকা ভাই নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন বলেই জানতাম। কিন্তু এর কিছুদিন পর ম্যাডামের বাসা থেকে একজন আমাকে ফোন করে বললো, কোনো একটা কাজের ব্যাপারে খোকা ভাইকে বেশ ক’বার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। শুনে আমি ফোন করলাম খোকা ভাইকে। তিনি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছেন না বুঝতে পারলাম। নানা রকম গাঁইগুঁই করে বললেন, আইসেন একসময় বাসায়।

বাসায় গেলে খোকা ভাই তার চরম বিপন্নতার কথা জানালেন। বললেন, “ভীষণ চাপে আছি। সিটি কর্পোরেশনে আর্মি বসিয়েছে। পই পই করে খুঁজছে কোথায় কোন অনিয়ম করেছি। সম্পদের তল্লাশি চলছে। আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা মনিটরিংয়ের আওতায় রেখেছে। নানান রকম শর্ত দিচ্ছে। বিদেশে যেতে চাইলাম তার পারমিশন দিচ্ছে না। নানান কায়দা করে এখন পর্যন্ত জেলের বাইরে আছি। ক’দিন থাকতে পারবো জানি না।”

বললাম, “বাইরে গুজব, আপনি নাকি একজনকে দশ কোটি টাকা দিয়ে রফা করেছেন যাতে গ্রেফতার না করে?” ম্লান হাসলেন খোকা ভাই। জবাব দিলেন, “যতো কয় ততো নয়।”

অনেক দিন এরপর আর খোকা ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ নাই। ম্যাডামের মা মারা যাবার পর তিনি কয়েক ঘণ্টার প্যারোলে বাসায় এলেন। খোকা ভাই ফোনে জানতে চাইলেন কোনো রকম সাহায্য লাগবে কিনা। আমি না বলে দিলাম। লাশের জানাজা হলো গুলশান আজাদ মসজিদে। সেখান থেকে ফিরে কয়েকজন নারী নেত্রী ম্যাডামকে সোৎসাহে জানালেন, খোকা ভাই এসেছিলেন জানাজায়। পার্টির ছেলেরা তারে খুব অপমান ও গালিগালাজ করেছে। ধাক্কাটাক্কাও দিয়েছে।

সবাইকে অবাক করে দিয়ে রাগতঃ স্বরে ম্যাডাম বললেন: এটা ঠিক হয় নাই। ওদেরকে কে বলেছে এসব করতে?

এক-এগারো যামানায় খোকা ভাই আরো এক সন্ধ্যায় লোক পাঠিয়ে আমাকে তার বাসায় নিলেন। বললেন, “ভারী বিপদে পড়েছি। ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় অফিস দখল করবে।” সাইফুর রহমান ও মেজর হাফিজকে দিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা তখন বিএনপির পালটা কমিটি করেছে। অফিস তাদের দখলে দেবে। খোকা ভাই বললেন, “আমাকে এ কুকর্মে সরাসরি থাকতে বলছে। মহানগরীর সালামকেও আনিয়েছে। আমি চেষ্টা করছি এটা বন্ধ করতে। পারবো কিনা জানি না।” আমি বললাম, “আপনি কোনো ক্রমেই এ অপকর্মের দোসর হবেন না। তাতে যা হবার হবে। এটুকু ঝুঁকি নিলে আপনার যা বদনাম হয়েছে তা দূর হবে। আপনি অনেক বেশি শ্রদ্ধার আসন পাবেন।” আমাকে একটা গোপন ফোন নম্বর দিয়ে খোকা ভাই বললেন, “দেখি চেষ্টা করে। পরে জানাবো।” রাত দু’টোর দিকে ফোন এলো ঐ নম্বর থেকে। একটা মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে ফোন কেটে দিলেন খোকা ভাই: “পারলাম না, হেরে গেলাম, সকালেই হবে।”

ম্যাডাম জেল থেকে বেরুবার পর খোকা ভাই আমাকে ফোন করে বললেন, “একটু ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে চাই।” আমি বললাম, “এতো জলদি? কী করেছেন এতোদিন একটু ভেবে দেখেন তো।” এর তিন-চার দিন পর। ম্যাডামের বাসায় গিয়ে দেখি ড্রইং রুমে খোকা ভাই বসা। আমাকে দেখে একটু বিব্রতই হলেন। বললেন, “আপনি তো মানা করলেন। পরে বাসায় ফোন করে পিচ্চিকে বললাম, ম্যাডামকে বলো আমি খোকা দেখা করতে চাই। ম্যাডাম আজ আসতে বলে দিয়েছেন।”

এরমধ্যে ম্যাডাম ড্রইং রুমে এলেন। আমি বললাম, “খোকা ভাই আপনার মধ্যে কি একটু অপরাধবোধ কাজ করেনা? ম্যাডাম আপনাকে ঢাকার নেতৃত্ব দিয়েছেন। আপনি মেয়র। ম্যাডাম গ্রেফতার হলেন। ঢাকা শহরে গাছের একটা পাতাও নড়লো না।”
খোকা ভাই করুণ চোখে তাকিয়ে বললেন: “ম্যাডামের সামনে সত্যি কথাটা কই। ভয় পেয়ে গেছিলাম খুব। খালি নিজের জন্য না। এরা এতো খারাপ, বৌ-বাচ্চা পর্যন্ত ধরে নিয়ে যেতো। এখন ম্যাডাম মাফ করলে আছি। না করলে জীবনেও আর রাজনীতি করবো না।”

ম্যাডাম খোকা ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে আমাকেই বুঝাতে লাগলেন, “দ্যাখেন ওরা তো প্রেসিডেন্ট জিয়ার পর আমার ওপর ভরসা করেই রাজনীতি করে আসছে। আমি নিজেই যেখানে বিপন্ন হয়েছি, সেখানে আর ওদের সাহস থাকে?”

বিএনপি সরকারের শেষের দিকে তরিকুল ভাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমার কাছে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। অচিরেই তাঁর সব ভবিষ্যদ্বাণী ‘প্রোফেটিক’ হয়ে ফলে যায়। তাদের দু’জনকে নিয়েই আরো অনেক কথা আছে। সব কথা তো আর সব সময় বলা যায় না।

গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের অফিসে আমার একদিন বুকে ব্যথা হলো। ঘামছি আর বুক চেপে বসে আছি। বিভিন্ন জনে বিভিন্ন পরামর্শ দিচ্ছেন। রাত সাড়ে ন’টায় এলেন খোকা ভাই। এসে শুনেই হাত ধরে টেনে তুললেন। “এখনো বসে আছেন? চলেন আমার সঙ্গে।” গাড়িতে তুলে নিয়ে গেলেন সোজা ইউনাইটেড হাসপাতালে। ভর্তি, সিটি স্ক্যান ও ইটিটি সহ নানান টেস্ট এবং শেষ অব্দি এঞ্জিওগ্রাম পর্যন্ত করে তারপর ছাড়লো ওরা। পাঁচ-ছয় দিন থাকতে হলো হাসপাতালে। তাও আবার ভিআইপি কেবিনে। এক রাতে খোকা ভাই এলেন ডাক্তার মুমিনুজ্জামানকে সঙ্গে নিয়ে। হাসিমুখে বললেন, “সব ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নাই। ছুটি এখন। চলেন বাসায়।” বিপন্ন মুখে জিজ্ঞেস করলাম, “সব মিলিয়ে বিল কতো হয়েছে?” খোকা ভাই বললেন, “বিল ক্লিয়ার। আপনাকে সেটা নিয়ে ভাবতে হবে না। আমার নিজের হলে চিকিৎসা করতে হতো না?”

একটা সার্জারির জন্য একবার সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। আমি দেশেই করাতে চাইলাম। ম্যাডাম নিজে থেকে জোর করে কিছু টাকা আমাকে দিয়ে বললেন, না সিঙ্গাপুরেই যান। বাধ্য হয়ে তেমন কাউকে না জানিয়েই যাওয়ার আয়োজন করলাম। যাবার দিন পথে ফোন খোকা ভাইয়ের। “কোথায় আপনি?” বললাম, “ভাই এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছি। এখন বুকওয়ার্মের সামনে।” তিনি একটু দাঁড়াতে বললেন। কাছাকাছিই আছেন। পাঁচ মিনিটেই এসে যাবেন। খোকা ভাই এসেই একটা খামে দুই হাজার সিঙ্গাপুরি ডলার ধরিয়ে দিলেন। বললেন: “কিছু তো জানানও না। এটা রাখেন। বিদেশে চিকিৎসার জন্য গোণা পয়সা নিয়ে যাওয়া যায় না। যদি আরো লাগে, হেসিটেড না করে ভাই হিসেবে জানাবেন অবশ্যই।”

সিঙ্গাপুরে যে সার্ভিস এপার্টমেন্টে উঠেছিলাম তার মালিক বাংলাদেশী। তার গণযোগাযোগ খুব ভালো। আমাদের দেশের অনেকেই সেখানে গিয়ে ওঠেন। উনি আমাকে বললেন যে, তরিকুল ভাই ফোন করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। দু’দিন পরেই ভদ্রলোক আমার হাতে দু’হাজার ডলার তুলে দিয়ে জানালেন, তরিকুল ভাই এটা পাঠিয়েছেন। বলেছেন, আমার যেন কোনো অর্থকষ্ট না হয়। যদি সমস্যা হয় আমার বিল আপনি দিয়েন না। ওটা তরিকুল ভাই নিজেই দিয়ে দেবেন।

আমার এতো টাকা লাগেই নি। সব সেরে দেশে ফেরার পরও প্রায় তিন হাজার ডলার বেচে গিয়েছিল। আমি একদিন তরিকুল ভাইকে বললাম, “আপনি কেন টাকা পাঠাতে গেলেন?” উনি রেগে বললেন, তাতে তোমার কি? অ্যাহ্! তারজন্য কি তোমার কাছে আমার কৈফিয়ত দিতে হবে? তোমার অবস্থা আমি কিছু জানিনা মনে করো?”

রাজনীতিবিদের আড়ালে ব্যক্তি মানুষটি কিন্তু হারিয়ে যায়। আমরা রাজনীতির ইতিহাস লিখি। ব্যক্তিমানুষটির ভেতরকার মানবিকতা ও ভালোবাসার দ্যুতিগুলো সে ইতিহাসে ঠাঁই পায় না। আমি আজ তরিকুল ভাই ও খোকা ভাইয়ের রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে তেমন কিছু লিখলাম না। কেবল আমার জীবনের ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতির কথাই লিখলাম। আমি ছাড়া আর তেমন কারো জানা নেই এসব গল্প। ভালোবাসা ও অশ্রুতে মাখা এসব স্মৃতি কি কখনো ভোলা যায়?

লেখক: বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক প্রেস সচিব।

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন