ভারতে ‘রমজান’ কীভাবে ‘রামাদান’ হয়ে উঠেছে

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:
রোজার মাসকে ‘রমজান’ বলে, বাঙালিরা তো বটেই – মোটামুটি গোটা ভারতীয় উপমহাদেশেই মুসলিমরা প্রায় আবহমানকাল থেকে সেটাই জেনে এসেছেন।

কবি নজরুল ইসলামের লেখা গান ‘ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে’ তো অমর হয়ে আছে।

কিন্তু এখন রোজার মাসে আপনি যদি ভারতে কোনও সুপারমার্কেটে ঢুকতে যান, হয়তো আপনার চোখে পড়বে আপনাকে স্বাগত জানাবে ‘রামাদান করিম’ লেখা বিরাট ব্যানার বা পোস্টার। ‘রামাদান’ উপলক্ষে স্টোরে কী কী স্পেশাল অফার আছে, সেই লিফলেটও হয়তো হাতে গুঁজে দিয়ে যাবে কেউ!

হোয়াটসঅ্যাপে বা ইমেলেও এর মধ্যেই অনেকের ফোনে চলে এসেছে ‘রামাদান মুবারক’ বার্তা।

কিন্তু ভারতের মুসলিমরা চিরকাল যাকে রমজান বলে জেনে এসেছেন, হালে সেটাই কীভাবে ধীরে ধীরে রামাদানে পরিণত হল?

“আসলে ভারতে ইসলামের মূল স্রোত যখন প্রথম আসে, তখন তা ছিল প্রবলভাবে পারস্য ভাবধারায় প্রভাবিত। আর ফার্সিতে যেহেতু শব্দটা রমজান – যেখানে জ-য়ের উচ্চারণটা Z-র মতো – তাই ভারতীয়রাও সেটাই বলতো। বাংলায় Z উচ্চারণটা নেই বলে বাঙালি মুসলিম তো পরিষ্কার রমজান উচ্চারণ করত,” জানাচ্ছেন রাজনৈতিক ইসলামের গবেষক ও ইতিহাসবিদ কিংশুক চ্যাটার্জি।

“কিন্তু গত এক-দেড়শো বছর ধরেই ভারতীয় ইসলামে আরবিকরণের একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আরব দুনিয়ার সঙ্গে ভারতের যোগাযোগও হালে অনেক বেড়েছে। আরবিতে জ উচ্চারণটা নেই, তার জায়গায় ওরা বলে ধ আর Z-র মাঝামাঝি একটা কিছু – আর সেটা অনুসরণ করে ইদানীং ভারতেও রামাদান বলার চল শুরু হয়েছে”, বলছেন মিঃ চ্যাটার্জি।

অধ্যাপক চ্যাটার্জি  আরও বলছিলেন, “আসলে এখন ইংরেজিতে লেখার সময় ফার্সির বদলে আরবি ট্রান্সলিটারেশনটাই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে, সে কারণে Ramzan-র বদলে Ramadan লেখাটাই এখন বেশি চোখে পড়ছে।”

তবে ভারতীয় উপমহাদেশে যে মুসলিমরা উর্দুতে কথা বলেন, তাদের যে ‘রামাদানে’র বদলে ‘রমজান’ই বলা উচিত, তা নিয়ে কিছুকাল আগেই ক্যাম্পেন শুরু করেছিলেন পাকিস্তানি লেখক-অ্যাক্টিভিস্ট বীনা সারওয়ার।

হার্ভার্ডের সাবেক ছাত্রী মিস সারওয়ারের যুক্তি ছিল, “উর্দুতে মূল শব্দটা রমজান। কিছুতেই রামাদান নয়। ঠিক যেভাবে আমাদের বলা উচিত খোদা হাফেজ, আল্লাহ হাফেজ নয়। এই ধরনের পাঁচমিশেলি শব্দ কিন্তু আরবিতেও নেই!”

সে সময় তার এই প্রস্তাব নিয়ে তর্কবিতর্কও হয়েছিল বিস্তর। তবে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বীনা সারওয়ারের নিজের শহর করাচি-ই বলুন, অথবা ভারতের দিল্লি-হায়দ্রাবাদ – সর্বত্রই রমজানের বদলে ধীরে ধীরে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে রামাদান।

 
কাশ্মীরে শ্রীনগরের জামিয়া মসজিদে নামাজ আদায় করছেন স্থানীয় এক বাসিন্দা (ফাইল চিত্র)রমজান না রামাদান এ নিয়ে ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে দ্বিমত আছে

কিন্তু রমজান না কি রামাদান – মুসলিমদের জন্য কোনটা বলা বেশি শুদ্ধ? কিংবা বেশি ইসলামসম্মত?

“দেখুন কোরানে তো রামাদান-ই বলা আছে, কাজেই ওটাই ঠিক মানতে হয়। ইসলামে শিক্ষিত লোকজন রামাদানই বলেন, যারা অতটা পড়াশুনো জানেন না তারা বলেন রমজান”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন দেওবন্দে দারুল উলুম মাদ্রাসার প্রধান মাওলানা আবদুল খালিক।

তবে সেই সঙ্গেই তিনি যোগ করেন, “পুঁথিগত উচ্চারণের বাইরেও অবশ্য সাধারণ মানুষের একটা নিজস্ব ‘জবান’ বা ভাষা মুখে মুখে তৈরি হয়ে যায়, তাতে যে ভাষার ব্যাকরণগত শুদ্ধতা সব সময় থাকে তা নয়। রমজান শব্দটাও সেভাবেই তৈরি হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস, কাজেই সেটাকেও হয়তো পুরোপুরি ভুল বলা যায় না।”

তবে রমজান যেভাবে ধীরে ধীরে রামাদান হয়ে যাচ্ছে, সেটাকে ‘ক্রমবর্ধমান আরবি প্রভাবের’ চেয়ে বরং একটা ‘শুদ্ধিকরণের প্রবণতা’ হিসেবেই দেখছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামি ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক কাজী সুফিওর রহমান।

ড: রহমান বিবিসিকে বলছিলেন, “আমি মনে করি এটা উচ্চারণগত ব্যাপার। দেখুন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নিয়ত বাড়ছে, তাই অনেকেই মনে করছেন এই সুযোগে আমার বিদেশি শব্দের উচ্চারণটাও ঠিক করে নিলে ক্ষতি কী?”

“আসলে আমাদের এটা বুঝতে হবে আরবি ভাষায় ‘জ’ শব্দটাই নেই – ওই জায়গায় তারা যেটা বলে সেটা অনেকটা ধ-এর কাছাকাছি। মিশরে একজন ফুটবলার আছে রামধান আলি নামে, সে যদি এখন কলকাতার মোহনবাগানে খেলত তাকেই আমরা ডাকতাম রমজান আলি বলে”, হাসতে হাসতে তুলনা করছিলেন তিনি।

 
হোয়াটসঅ্যাপে রমজানের মুবারক বার্তাহোয়াটসঅ্যাপে বা ইমেলেও ঘুরছে এধরনের ‘রামাদান মুবারক’ বার্তা।

অধ্যাপক রহমান আরও বলছেন, “আর আমরা বাঙালিরা যে রমজান বলি সেখানেও জ-য়ের উচ্চারণ হওয়া উচিত Z-র মতো, যে কারণে অনেকে আবার রমযান লেখেন। তবে আমার মতে শুদ্ধ আরবিতে বলতে গেলে ‘রামধান’-ই বলা উচিত, কারণ ওটাই সবচেয়ে কাছাকাছি উচ্চারণ। পাতি বাঙালিরা যেটাকে আজান বলেন, আরবিতে সেটাই কিন্তু ‘আধান’, মনে রাখবেন।”

ইংরেজিতে Ramadan শব্দটা লেখা হলেও ‘রামাদান’ যে কখনওই শুদ্ধ নয়, সেটাও তিনি খেয়াল করিয়ে দিচ্ছেন। “কারণ আরবিতে আ-র কোনও বালাই নেই, যারা রামাদান লিখছে তারা ইংরেজি বানান অনুসরণ করে লিখছে, সেটা আবার আর এক গন্ডগোলের!”

কাজেই রোজার মাসের সঠিক উচ্চারণ কী হওয়া উচিত তা নিয়ে গন্ডগোল বিস্তর!

আপনি উর্দুতে, ফার্সিতে, না কি আরবিতে বলবেন – কোরানের ভাষায় বলবেন না কি আমজনতার জবানে – সেই সব সাতপাঁচ ভেবেচিন্তেই আসলে আপনাকে ঠিক করে নিতে হবে শব্দটা রমজান না কি রামাদান!