ভারতে অনৈক্যের মূর্তি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

গুজরাটের নর্মদা জেলার কেভাদিয়া কলোনি এলাকায় সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের ১৮২ মিটার উঁচু মূর্তিটির মতো মূর্তি তামাম দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই। গত ৩১ অক্টোবর প্যাটেলের জন্মদিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রায় তিন হাজার কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিত এই মূর্তি উন্মোচন করেন।

মূর্তি উন্মোচনের দিন আশপাশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা–অধ্যুষিত ৭২টি গ্রামে চুলা জ্বলেনি। চুলা জ্বলেনি, কারণ সেদিন তাঁরা মূর্তিটি নির্মাণের প্রতিবাদ জানিয়ে শোক পালন করেছেন। চুলা না জ্বালানো তাঁদের শোক পালনের ভাষা। তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছেন, কারণ এই মূর্তি নির্মাণের কারণে পার্শ্ববর্তী প্রায় ৭৫ হাজার গরিব মানুষ জমি-জীবিকা হারানোসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

কিন্তু মৃত্যুর ৬৮ বছর পর সরদার প্যাটেল আজ পাদপ্রদীপের সামনে এলেন কেন? কেনইবা তাঁর এই গগনচুম্বী মূর্তি নির্মাণ?

বল্লভভাই প্যাটেল ভারতের অন্যতম ‘ফাউন্ডিং ফাদার’। তিনি ছিলেন কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থী অংশের নেতা এবং গান্ধীজির ‘ইনার সার্কেলের’ একজন। গুজরাটের বরদলিতে সফল সত্যাগ্রহ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় সত্যাগ্রহী নারীরা তাঁকে ‘সরদার’ উপাধি দেন। তিনি যুগপৎ ভারতের প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ়চিত্ততার জন্য মাওলানা আবুল কালাম আজাদসহ কেউ কেউ মনে করতেন, নেহরুর বদলে প্যাটেলকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বানানো উচিত ছিল।

সাধারণ মানুষের মধ্যে নেহরুর জনপ্রিয়তা ছিল, কিন্তু কংগ্রেসের নেতা–কর্মীদের, আমলা ও শিল্পপতিদের সমর্থন ছিল প্যাটেলের প্রতি। তিনি ছিলেন পশ্চিমি পুঁজিতন্ত্রের সমর্থক। অন্যদিকে, নেহরু ছিলেন ‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের’ অর্থনীতির বা অর্থনৈতিক উন্নয়নে রাষ্ট্রের দৃঢ় ভূমিকার সমর্থক। সরকার পরিচালনার নানা বিষয়ে তাঁর দোর্দণ্ড প্রতাপশালী উপপ্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর অহরহ মতবিরোধ দেখা দিত।

মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম’ গ্রন্থে ভারত বিভাগের জন্য প্যাটেলকে বহুলাংশে দায়ী করেছেন। কংগ্রেসের প্রথম সারির নেতাদের মধ্যে প্যাটেলই প্রথম ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটনের দেওয়া ভারত বিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। গান্ধীকে তিনিই ভারত বিভাগ মেনে নিতে রাজি করান। জিন্নাহর কট্টর সমালোচক হওয়া সত্ত্বেও প্যাটেল তখন জিন্নাহর সুরে সুর মিলিয়ে বলতে শুরু করেন, ভারতে হিন্দু ও মুসলমান দুটি জাতি রয়েছে এবং তাদের আলাদা হয়ে যাওয়াই মঙ্গল! একই যুক্তিতে বাংলা ও পাঞ্জাব ভাগ করারও তিনি প্রধান কুশীলব। ভারত বিভাগের পরপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে দিল্লিতে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা ঠেকাতে তাঁর এই মন্ত্রশিষ্যের ভূমিকায় হতাশ হয়ে গান্ধীজি আমরণ অনশন শুরু করতে বাধ্য হন।

অবিভক্ত ভারত দুই ধরনের অঞ্চলে বিভক্ত ছিল—সরাসরি ব্রিটিশ শাসনাধীন এলাকা এবং দেশীয় রাজাদের শাসনাধীন ৫৮৪টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ‘স্বায়ত্তশাসিত’ রাজ্য। ভারত বিভাগের এবং ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পর সামান্য কটি বাদে এসব দেশীয় রাজ্যের সব কটিই পড়েছিল ভারতে। তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে দেশীয় রাজ্যগুলো তাদের পছন্দ অনুযায়ী ভারত বা পাকিস্তানে যোগ দেবে। সরদার প্যাটেল বুঝিয়ে–সুঝিয়ে, হুমকি–ধমকি দিয়ে কিংবা সৈন্য পাঠিয়ে এসব রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেন। এ কারণে তিনি ‘লৌহমানব’ এবং অনেকের চোখে ভারতের ঐক্যের প্রতীক। তাঁর আকাশচুম্বী মূর্তির নাম ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’।

ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠার পর থেকেই ভারতের রাজনীতিতে কংগ্রেস ও নেহরু পরিবারের দীর্ঘদিনের আধিপত্য খর্ব করার জন্য আদাজল খেয়ে নামে। তারা আপাত হিন্দুঘেঁষা, দক্ষিণপন্থী ও নানা বিষয়ে নেহরুর উদারনৈতিক ও সেক্যুলার মতের বিরোধিতাকারী বল্লভভাই প্যাটেলকে একজন উপেক্ষিত ‘হিরো’ হিসেবে উপস্থাপন করে। এটি ছিল প্যাটেলকে তাঁর মাপের চেয়ে বড় করে দেখিয়ে নেহরুকে ছোট দেখানোর চেষ্টা। বিজেপি সরকার ২০১৪ সালে প্যাটেলের জন্মদিনকে ‘রাষ্ট্রীয় একতা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। প্যাটেলের বদলে নেহরুকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় সমালোচনা করতে গিয়ে বিজেপি গান্ধীজিকে ছেড়ে কথা বলে না।

বল্লভভাই প্যাটেলকে বিজেপির মহিমান্বিত করার আরেকটি কারণ গুজরাট ফ্যাক্টর। গুজরাটকে অবলম্বন করেই মোদি ও বিজেপির উত্থান। গুজরাটে প্রবৃদ্ধিভিত্তিক অবাধ পুঁজিবাদী বিকাশের মডেলকে উৎসাহিত করে মোদি ভারতের করপোরেট নেতৃত্বের প্রিয়ভাজন হয়েছেন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে লোকসভার ২৪ আসনের সব কটিই পেয়েছে বিজেপি। তাই একজন গুজরাটি ‘ন্যাশনাল হিরো’কে সামনে এনে বিজেপি হয়তো তাঁর গুজরাট দুর্গটি সংরক্ষিত রাখতে চায়।

বিজেপির একটি বিরাট কৌশলগত সুবিধা হলো কংগ্রেস বিজেপির এই চাল বুঝলেও কিছু বলতে পারছে না, কারণ সরদার প্যাটেল তো তাদেরই লোক ছিলেন। প্যাটেলের আকাশচুম্বী মূর্তি নির্মাণের কোনো প্রতিবাদ কংগ্রেস করেনি। শুধু মিনমিন করে বলেছে, মূর্তিটা গান্ধীজির মূর্তির চেয়েও বড় হয়ে গেল যে!

বিজেপি কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের রাজনৈতিক শাখা হিসেবে পরিচিত। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিজেপির নেতৃত্বস্থানীয় অনেকেই আরএসএস থেকে আসা। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই আরএসএস কংগ্রেসের আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল এবং ব্রিটিশ শাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিল। (এদিকে মুসলিম মৌলবাদী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে এই হিন্দু মৌলবাদী সংগঠনের মিল আছে। জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তান আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিল!)

এখন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারির একজন নেতার সুবিশাল মূর্তির আড়ালে আরএসএসের বিব্রতকর অতীতকে হয়তো কিছুটা আড়াল করার চেষ্টা করা হলো।

রাবণের ক্ষমতা বোঝানোর জন্য রামায়ণপ্রণেতা তাঁর ঘাড়ে দশ–দশটি মাথা বসিয়েছেন! দুর্গতিনাশিনী দুর্গার ক্ষমতা বোঝাতেই তাঁর দশভুজা রূপ। কিন্তু এ যুগেও সরদার প্যাটেলকে সেক্যুলার নেহরু এবং পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণু গান্ধীর চেয়ে মহত্তর দেখাতে সেই প্রাচীন শিল্পাদর্শের অনুকরণে তাঁকে গায়েগতরে বাড়িয়ে আতিকায় আকৃতি প্রদান কোনো পরিশীলিত শিল্পরুচির পরিচয় বহন করে না।

বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তিটি তাকিয়ে আছে নর্মদা নদীর তিন কিলোমিটার উজানে অবস্থিত বহুল বিতর্কিত সরদার সরোবর বাঁধের দিকে। ১৯৬১ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরু এই বাঁধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিশাল এই বাঁধ উদ্বোধন করেন। সেদিক দিয়ে এই বাঁধও একটি ঐক্যের প্রতীক বটে। ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের স্বার্থের, বাঁধসংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকার পরিবেশ ও প্রতিবেশ-স্বার্থের বিরুদ্ধে ভারতের শাসকশ্রেণির নিরবচ্ছিন্ন ঐক্যের প্রতীক। গায়ের জোরে ঐক্য রক্ষার প্রতীক।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে মহারাষ্ট্রের বাল গঙ্গাধর তিলক মারাঠা যোদ্ধা রাজা ছত্রপতি শিবাজিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভারতবাসীর ঐক্যের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেন। নানা জায়গায় আয়োজন করেন শিবাজি উৎসবের। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় শিবাজি ভারতকে এক ‘ধর্মরাজ্যে ভারতকে বেঁধে দিতে’ চেয়েছিলেন। কিন্তু তিলকের উদ্যোগ ভারতবাসীকে এক করেনি; কেবল কিছু হিন্দুকে হিন্দুত্ব সম্পর্কে সজাগ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কিছু মুসলমানও আরও মুসলমান হয়ে উঠেছে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে অনৈক্যের ভিত্তি রচিত হয়েছে।

বল্লভভাই প্যাটেলকে যেভাবে হিন্দু জাতীয়তাবাদী হিসেবে দেখানো হচ্ছে, তাঁর মূর্তি যে উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলো, এর জন্য হাজার হাজার দরিদ্র মানুষকে যে মূল্য দিতে হলো, তাতে এই গগনচুম্বী মূর্তি ভারতের জনগণের ঐক্যের বদলে অনৈক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে কি না, সেটিই দেখার বিষয়।