ভারতের রাজনীতিতে এসব কী ঘটছে

নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহ নেতৃত্বাধীন বিজেপি ঘোষণা করেছিল কংগ্রেসকে ভারতবর্ষ থেকে মুছে দেবে আর মমতা ব্যানার্জি-অভিষেক ব্যানার্জি নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেস ঘোষণা করেছিল কংগ্রেসকে সাইনবোর্ডে পরিণত করবে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে উভয়েই তাদের এ লক্ষ্য থেকে পিছিয়ে যায়নি, বরং দিন দিন আরও আগ্রাসী হচ্ছে এ ব্যাপারে। বিজেপি কংগ্রেস ধ্বংস করবে নাম করে কংগ্রেস-পরিকল্পিত জাতীয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে, দেশের স্বাধীন সত্তাকেই বিক্রি করে দিচ্ছে। এ ভয়ানক সময়ে যখন বিজেপিবিরোধী সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য প্রয়োজন সে সময় মমতা-অভিষেকের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস দল গান্ধী-নেহরু ধারার কংগ্রেসকে তীব্র আক্রমণ করে একে ভাঙতে চাইছে। তাদের অভিযোগ, কংগ্রেস-বিজেপি এখন এক। কিন্তু বাস্তব ছবি কী? মমতা ব্যানার্জি একাধিকবার বিজেপির সঙ্গে ঐক্য করেছেন, বিজেপির মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছেন, আরএসএস-প্রধানকে দেশপ্রেমিক উল্লেখ করেছেন। অন্যদিকে গান্ধী-নেহরু ধারার কংগ্রেস কিন্তু জনসংঘ-বিজেপির সঙ্গে কখনো সমঝোতা করেনি। তৃণমূল কংগ্রেসের মমতা কিন্তু ইতিপূর্বে গোয়া, ত্রিপুরা, আসাম বিধানসভায় প্রার্থী দিয়ে জামানত খোয়ালেও বিজেপি-বিরোধী ভোটে কিছুটা ভাগ বসিয়ে বিজেপিকেই ওইসব রাজ্যে ক্ষমতায় যেতে সুবিধা করে দিয়েছে। এর পরও মমতা ব্যানার্জি চেষ্টা করেছেন বিভিন্ন আঞ্চলিক দল নিয়ে ঐক্য করে কংগ্রেস-বিরোধিতায় নামা এবং তৃতীয় ফ্রন্ট করার। এটি হলেও বিজেপিরই সুবিধা হয়। গত লোকসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস প্রদত্ত ভোটের শতকরা ২০ ভাগ পেয়েছে। এখনো নির্বাচন হলে মোট ২৪২ আসনে বিজেপির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকেই প্রার্থী দিতে হচ্ছে। কারণ অন্য কোনো দলের শক্তিই নেই। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, বিজেপি শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থবিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছে, এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে শ্রমিক সংগঠনগুলোর স্ট্রাইক বা বনধে তৃণমূল কংগ্রেস পাশে দাঁড়ায়নি। তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার কৌশলটি আপাতত চাপা দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা ব্যানার্জি এখন দাবি করেছেন তিনিই আসল কংগ্রেস। ১৫ আগস্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল তাতে নেতাজি সুভাষ বসু, আম্বেদকরদের ছবি সঠিকভাবেই ছিল, কিন্তু ছবি ছিল না জওহরলাল নেহরুর। কেন্দ্রীয় সরকার যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল তাতে সাভারকারের ছবি ছিল, ছিল না নেহরুর।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস গান্ধী-নেহরু ধারার ঐতিহ্য বহন করে, তৃণমূল কংগ্রেস অবশ্যই এ ধারার কথা বলছে না। আগ্রাসী বিশ্ব পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ কিংবা আমাদের দেশি আগ্রাসী ধনবাদের বিরুদ্ধে তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃবর্গকে কি কেউ সোচ্চার হতে দেখেছে? অথচ জওহরলাল থেকে ইন্দিরা, রাজীব গান্ধী সবাই সাম্রাজ্যবাদ -বিরোধী ছিলেন, আন্তর্জাতিক ভূমিকাও পালন করেছেন। জওহরলাল-ইন্দিরার ১২৫ ও ১০০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, ওই দিনটিও তাঁরা পালন করেননি।

পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেস-বিজেপি সমঝোতা হয়েছে এ কথা মমতা ব্যানার্জি-অভিষেক বাবুরা দীর্ঘদিন বলে আসছেন। তৃণমূল সেনাপতি শুভেন্দু অধিকারী গত লোকসভা নির্বাচনেও এ কথা বলে মুর্শিদাবাদ মালদহে সংখ্যালঘু ভোট চাইতে তাঁবু ফেলেছিলেন কিন্তু কার্যত দেখা গেল শুভেন্দু অধিকারীই হলেন বিজেপির এ রাজ্যের সেনাপতি।। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী আন্দোলন ও প্রগতির আন্দোলনে বিশ্বাসী মানুষের একটি অংশ কংগ্রেসের এ আন্দোলনের পুকুরেই অবগাহন করে প্রগতির আরাধনা করে। এটাই বাস্তব। কংগ্রেসের প্রতি অনেক সমালোচনাও আছে, কিন্তু বর্তমান সময়ে ফ্যাসিবাদ ও প্রতিক্রিয়াকে রুখতে যখন দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য চাই, এ ঐক্যে কংগ্রেস একটি প্রধান শক্তি। বামপন্থিদেরও এ ঐক্যে অংশীদার হতে হয়েছে। ওই সময় মমতা-অভিষেকের এ কংগ্রেস-বিরোধী জিহাদ তো প্রগতির শক্তি দুর্বল করবে, ফ্যাসিবাদ শক্তিশালী করবে। আর কংগ্রেস-বিজেপি সমঝোতা? এ কথা শুনলে কুট্টিদের ভাষায় বলতে হয়, কই তাছেন কি-এইডা শুইনা তো ঘুরাও হাসব। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভানেত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের কংগ্রেস-বিরোধী জিহাদ শুনে সন্দেহ হয় তাঁরা বিজেপির বিরুদ্ধে সার্বিক জোট চান না। আর এ জোট না হলে আখেরে লাভ হবে বিজেপির। এটা বুঝতে বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। এমনই এক রাজনৈতিক ঝঞ্ঝার মুহূর্তে ভারতের রাজনীতিতে ঘটে চলেছে একের পর এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। একসময় ছিলেন বামদের ‘পোস্টারবয়’। সেই কানহাইয়া কুমার এবার যোগ দিলেন কংগ্রেসে। মঙ্গলবার শহিদ ভগত সিংয়ের জন্মবার্ষিকীতেই কানহাইয়াকে কংগ্রেসে স্বাগত জানান রাহুল গান্ধী। কানহাইয়ার সঙ্গে কংগ্রেসে যোগ দিলেন গুজরাটের নির্দল বিধায়ক তথা আরেক বামপন্থি যুবনেতা জিগনেশ মেবানিও। রাহুলের উপস্থিতিতেই কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণ করেছেন দুই তরুণ নেতা।

 

তবে কানহাইয়াদের যোগদান নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। মঙ্গলবার সকালেই জানা যায় কানহাইয়া সিপিআই ছাড়ার আগে দলীয় কার্যালয়ের এসিও নাকি খুলে নিয়ে গেছেন। সেটা নিয়ে নেটদুনিয়ায় বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। তবে আসল বিতর্ক শুরু হয় কংগ্রেসের অন্দরে। তরুণ নেতাদের দলে নেওয়া নিয়ে আপত্তি তোলেন কংগ্রেসের সিনিয়র নেতা মণীশ তিওয়ারি। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যে বামপন্থিরা মতাদর্শগতভাবে কংগ্রেসের থেকে এতটা আলাদা তাদের কেন দলে নেওয়া হচ্ছে? বস্তুত মণীশ ছাড়াও দলের অন্দরে অনেকেই কানহাইয়াদের যোগদান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তবে দুই তরুণ নেতাকে দলে নেওয়ার ব্যাপারে অনড় ছিলেন রাহুল গান্ধী।

মঙ্গলবার প্রথমে দিল্লির আইটিও ময়দানে শহিদ-এ-আজম ভগত সিং পার্কে যান কানহাইয়া, জিগনেশরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন রাহুল গান্ধী। একসঙ্গে হাতে হাত রেখে বিপ্লব গড়ার ডাক দেন তাঁরা। তার পরই এআইসিসি সদর দফতরে গিয়ে কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণ করেন তরুণ দুই নেতা। বাম দল ছেড়ে কেন কংগ্রেসে যোগ দিলেন? কানহাইয়া বলছেন, ‘এ দেশের সবচেয়ে গণতান্ত্রিক দলে আমি এজন্যই যোগ দিলাম কারণ আমার মনে হয় কংগ্রেস না বাঁচলে দেশ বাঁচবে না। আমাদের মনে হয় আজ দেশের ভগত সিংয়ের বীরত্বের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন গান্ধী এবং আম্বেদকরের মতবাদের। আপনি ব্যক্তিত্বকে পিষে ফেলতে পারেন। কিন্তু আদর্শ কখনো পিষে ফেলা যায় না।’

পাঞ্জাবের রাজনীতিতে ফের নাটকীয় মোড়। যার জন্য ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরাল কংগ্রেস, সেই নভজ্যোত সিং সিধু এবার প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দিলেন। মঙ্গলবার সকালেই সোনিয়া গান্ধীকে সংক্ষিপ্ত একটি চিঠি লিখে ইস্তফার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন সিধু। যা কংগ্রেসের অন্দরে বিনা মেঘে বজ্রপাতের শামিল।। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পদে আনা হয়েছিল সিধুকে। রীতিমতো দলের অন্দরে এবং সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দলের অন্দরে উত্তরণ হয় সিধুর। এ হেন মহার্ঘ্য পদ তিনি হঠাৎ কেন ছাড়লেন এ নিয়ে রীতিমতো ধন্ধে রাজনৈতিক মহল। সোনিয়া গান্ধীকে লেখা চিঠিতে সিধু জানিয়েছেন, ‘আমি কখনো কোনো কিছুর সঙ্গে আপস করতে পারব না। আপস করলেই মানুষের চারিত্রিক অবনমন হয়। আমি কখনো পাঞ্জাবের ভবিষ্যৎ এবং উন্নয়নের সঙ্গে আপস করতে রাজি নই।’

আসলে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকে সরানোর পর সিধু নিজেই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে ছিলেন। তাঁর সমর্থক বিধায়করা সিধুর নাম প্রস্তাবও করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস হাইকমান্ড সিধুকে মুখ্যমন্ত্রী না করে চরণজিত সিং চান্নিকে বেছে নেয়। সে সময় সিধুকে বলা হয় তাঁর অনুগামীদের বেশি করে মন্ত্রিসভায় জায়গা দেওয়া হবে। কিন্তু পাঞ্জাবের মন্ত্রিসভার সম্প্রসারণের পর দেখা যাচ্ছে সিধুঘনিষ্ঠরা সেভাবে জায়গা পাননি। তাতেই গোসা হয়েছে সাবেক ক্রিকেটারের। সম্ভবত সে কারণেই ইস্তফা দিয়েছেন তিনি।

সদ্যই ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংকে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছে কংগ্রেস। পরিবর্তে মুখ্যমন্ত্রী করা হয়েছে ‘অজ্ঞাতকুলশীল’ চরণজিত সিং চান্নিকে। মুখ্যমন্ত্রীর পদ খোয়ানোর পর থেকেই অমরিন্দরের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা চলছিল। তিনি নিজেও কংগ্রেস ছাড়ার ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছিলেন। দাবি করেছিলেন তাঁর সামনে সব রাস্তাই খোলা রয়েছে। তবে অকর্মণ্য এবং দেশদ্রোহী সিধু যাতে ভোটে জিততে না পারেন তা নিশ্চিত করতে সব রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন তিনি।

পাঞ্জাবের রাজনীতিতে অমরিন্দর বড় নাম। ২০০২ সাল থেকে টানা পাঁচ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয়বার ২০১৭-তে মুখ্যমন্ত্রী। সাড়ে নয় বছর মুখ্যমন্ত্রী থাকার পর ‘অসম্মানিত ও অপমানিত’ ক্যাপ্টেন সরে গেছেন। আসলে পাঞ্জাবে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি সিধুর সঙ্গে অমরিন্দরের বিবাদ দীর্ঘদিনের। সিধু যেদিন কংগ্রেসে যোগ দেন সেদিন থেকেই কার্যত তাঁর বিরোধিতা করে এসেছেন অমরিন্দর। কংগ্রেসের অন্দরে সিধু যেভাবে উল্কার গতিতে প্রভাব বাড়াচ্ছিলেন তা মেনে নিতে পারেননি পাঞ্জাবের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী। মূলত সিধুর সঙ্গে বিবাদের জেরেই তাঁকে মুখ্যমন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয়। সূত্রের খবর, সেই সিধুকে হারাতেই এবার বিজেপিতে যেতে পারেন ক্যাপ্টেন।

লেখক : প্রবীণ সাংবাদিক [ভারত]।

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন