ভরা বর্ষায় খরায় পুড়ছে রাজশাহী, বৃষ্টিপাত কমেছে ৬০ ভাগ


রফিকুল ইসলাম:

ষঢ় ঋতুর বাংলাদেশে আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল। এই বর্ষাকালে মাত্র দুই বছর আগেও রাজশাহীতে ব্যাপক বৃষ্টি হয়েছে। যদিও টানা বর্ষণ দেখা যায়নি গত ১৫-১৬ বছর ধরে। তার পরেও ২০২১ সালের বর্ষায় যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়েছে, তা গত বছর আর চলতি বছর মিলেও সেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়নি রাজশাহীতে। এর ফলে এখন শ্রাবণের এই ভরা বর্ষাতেও প্রকৃত হয়ে উঠেছে রুক্ষ। খাল-বিল, নদী-নালা সবকিছুই যেন পানিশূন্যতায় ভূগছে। আর ফসলের মাঠে বিরাজ করছে পানির জন্য হাহাকার। এই সময়েও গভীর নলকূপ থেকে প্রতিদিন পানি সেচ দিতে হচ্ছে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জমিতে। একদিন পানি দিতে না পারলেই ধানের মাঠ ফেটে চৌচির হেয় যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে রাজশাহী অঞ্চলে ৫০-৬০ ভাগ কমে গেছে বৃষ্টির পরিমাণ। এবার সেটি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমন যে, ভরা বর্ষাতেও চৈত্র মাসের খরা বিরাজ করছে। এতে করে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। পানির অভাবে পাট জাগ দিতে পারছেন না কৃষকরা। পর্যাপ্ত পানি না থাকায় ধানের চারা রোপনও করাও যাচ্ছে না। আবারে যসব জমিতে এরই মধ্যে আমন ধানের চারা রোপন করা হয়েছে, সেব জমির ধান পানির অভাবে মরে যাচ্ছে। কৃষকরা বাধ্য হয়ে গভীর নলকূপ দিয়ে পানি সেঁচ দিয়ে কোনো মতে ধানগাছগুলো জীবিত রেখেছেন। এই ধানের উৎপাদনেও এবার ব্যাঘাত ঘটবে বলেও মনে করছেন কৃষকরা।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিস সূত্র মতে, চলতি বছর রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৩৯৬ দশমিক ৭ মিলিমিটার। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩৮ দশমিক ৩ মিলিমিটার। এছাড়াও জুন মাসে হয়েছে ৮৪ দশমিক ৪ মিলিমিটার, মে মাসে ১০৩ দশমিক ৭ মিলিমিটার, এপ্রিলে ৪৮ দশমিক ৮ মিলিমিটার ও মার্চে হয়েছে ২১ দশমিক ৫ মিলিমিটার।
গত বছর রাজশাহীতে জুলাই মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছিল মাত্র ৩৬৬ মিলিমিটার। এর মধ্যে জুলাই মাসে ছিল ৫৯ এবং জুনে ছিল ৭০ দশমিক ২ মিলিমিটার।


এর আগের বছর ২০২১ সালে রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে জুলাই মাস পর্যন্ত ৮৫২ দশমিক ৯ মিলিমিটার। এর মধ্যে জুলাই মাসে ছিল ৩৩৮ দশকি ১ মিলিমিটার, জুনে ২৬২ দশমকি ৩ মিলিমিটার, মে মাসে ২৩৭ দশমকি ২ মিলিমিটার এবং এপ্রিলে ছিল ১৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার। ওই বছর গোটা বর্ষাকালেই ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয় রাজশাহীতে। কিন্তু গত দুই বছর মিলেও সেই পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়নি। গত বছর আর চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত মোট বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৬২ দশমিক ৭ মিলিমিটার। যা ২০২১ সালের তিন মাসেই ৮৩৭ দশমিক ৬ মিলিমিটার।

রাজশাহীর দুর্গাপুরের মাড়িয়া গ্রামের জেনারুল ইসলাম বলেন, ‘পানির অভাবে পাট নষ্ট হচ্ছে জমিতে। পাট কাটার সময় পার হয়ে যাচ্চ্যে। কিন্তু জাগ দেওয়ার পানি না না থাকায় পাট ক্যাটতে পারতিছি না। পাটের ফলনও ভালো হবে না এবার। আবার পাট ক্যাটত না পারায় ওই জমিতে ধানও লাগাতে পারছি না। যারা ধান লাগাইছে, তাদের জমিতেও ধান নষ্ট হয়ে য্যাচ্চে পানির অভাবে। ধান বাঁচাতে জমিতে ডিবটিউবওয়েল দিয়ে পানি দিতে হচ্চ্যে। তাও ঠিকমতো কারেন্ট না থাকায় পানি দেয়া যাচ্চ্যে না। ভরা বর্ষায় এমন পানির সঙ্কট কখনো আগে দেখিনি।’

পবার চৈতন্যপুর এলাকার কৃষক আমজাদ আলী বলেন, মাস খানেক আগে জমিতে আমন ধান লাগাইছি। এখন পানির অভাবে প্রতিদিন সেঁচ দিতে হচ্ছ্যে। একদিন পানি না দিতে পারলেই জমি ফ্যাটি যাচ্ছ্যে। ধান লাগাই খুব বিপদে আছি। আগে দিনের পর দিন শ্রাবণে বৃষ্টি দেখিছি। এখন শ্রাবনেই চৈত মাসের খরা দেখা যাচ্ছ্যে। আবহাওয়ার কি পরিবর্তন হয়েছে ভাবাই যায় না।’

রাজশাহীর ইতিহাস গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘টানা ৪-৫ দিন বৃষ্টিপাত তো আর দেখি না। ১৫-২০ বছর আগেও বর্ষাকালে টানা তিন-চার দিন বৃষ্টিপাত দেখেছি আমরা। সারাদিন শ্রাবনের বৃষ্টি ঝরেছে ঝর ঝর। ঘর থেকে বের হওয়া যায়নি। রাস্তা-ঘাট পানিতে টৈ-টুম্বুর থাকত। এখন তো টানা একদিনও বৃষ্টিপাত চোখে পড়ে না। এর ফলে এখন শ্রাবনেও খরায় পুড়ছে রাজশাহী। এটি আমাদের জন্য মারাত্মক অশনি শঙ্কেত।’

গঙ্গার উজানে ভারত পদ্মার বাঁধ দিয়ে পানি ব্যবহার করছে ফসল চাষে। গঙ্গার (পদ্মা) পানি বেশির ভাগ নিয়ে নিচ্ছে ভারত। এতে করে এই অঞ্চল আরও উষ্ণ হয়ে উঠছে। যার বিরুপ ফল আমাদের পেতে হচ্ছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক চৌধূরি সারোয়ার জাহান সজল বলেন, ‘বাংলাদেশের আবহাওয়ার দিক থেকে এ বছর ‘এনিনো’ বছর হিসেবে ধরা হচ্ছে। এই এনিনো বছরে আবহাওয়া অদ্ভুত আচরণ করবে এটাই স্বাভাবিক। এ কারণে বর্ষার সময় বর্ষা হচ্ছে না। আবার বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেও বাংলাদেশের আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটেছে। তবে সামগ্রিকভাগে রাজশাহী অঞ্চলে বৃষ্টিপাত কমেছে ব্যাপক হারে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও উপাচার্য গোলাম সাব্বির সাত্তার বলেন, ‘বৈশিক উষ্ণায়নের ফলে দেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ খুবই কমেছে। গত দুই বছর ধরে অন্তত ৫০-৬০ ভাগ বৃষ্টিপাত কমেছে রাজশাহীতে। এটি হয়েছে জলবায়ুর বৈষ্মিক পরিবর্তনের ফলে। এটি খবুই খারাপ দিক। উষ্ণ্নায়ন থেকে উষ্ণায়নের দিকে ক্রমেই ধাবিত হচ্ছে বাংলাদেশ।’

এদিকে, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন অধিপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা উম্মে সালমা বলেন, ‘এ বছর আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্র নির্ধারণ করা হয়েছে ৪১ হাজার হেক্টর জমিতে। এরই মধ্যে ৬০ ভাগ জমিতে ধান দানের চারা রোপন হয়েছে। এখনো সময় আছে। বাকি জমিতে ধান চাষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে জমিতে সেঁচ দিতে হচ্ছে। আবার পানির অভাবে কৃষকরা পাট ভেজাতে পারছেন না। তবে বারনইসহ ছোট ছোট নদীতে পাট জাগ দিতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে কৃষকদের।’

তিনি আরও জানান, এ বছর ১৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছে। এর মধ্যে পাট কাটা হয়েছে প্রায় ৬৫ ভাগ জমি থেকে।

স/আর