বড়াইগ্রামে তিনটি ভেজাল গুড় কারখানায় অভিযান: ৪ জনের জরিমানা(ভিডিও)

মাহবুব হোসেন,নাটোর:

শীতের মৌসুম আসলেই গ্রামের পাশাপাশি শহরেও পড়ে যায় পিঠা খাওয়া ধুম। আর হরেক রকম পিঠা সহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয় খেজুর গুড়। চাহিদা আর দাম ভাল পাওয়ায় এরই মধে তৎপর হয়ে উঠে ভেজাল গুড় তৈরী কারখানার মালিকরা। স্বাস্থ্যর জন্য ক্ষতিকর টেক্সটাইলের কাপড় রং করার কাজে ব্যবহৃত কেমিকেল, হাইড্রোজ, চিটাগুড় এবং চিনি দিয়ে তৈরী করা হচ্ছে খেজুর গুড়। আর এসব ভেজাল গুড় তৈরী হয়ে চলে যাচ্ছে স্থানীয় সহ বিভিন্ন বাজারে। রবিবার বড়াইগ্রাম উপজেলার দুটি ভেজাল গুড় তৈরী কারখানায় গিয়ে এসব দৃশ্য ও তথ্য উঠে আসে।

এসময় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলামের তত্ত্বাবধায়নে ভ্রাম্যমান আদালতের নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট নাজমুল আলম দুটি কারখানার চারজনকে জরিমানা এবং কারাদন্ড প্রদান করেন। ভ্রাম্যমান আদালতে র‌্যাব-৫ নাটোর ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর শিবলী মোস্তফা সহ গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

রবিবার ভোর ৬টায় র‌্যাবের একটি টিম বড়াইগ্রাম উপজেলার কালিকাপুরে ভেজাল গুড়ের কারখানার সন্ধান পেয়ে তা সাড়ে ৬ ঘন্টা সময় পর্যন্ত ঘিরে রাখে। পরে বেলা ১২টার দিকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নাজমুল আলম উপস্থিত হয়ে ভ্রাম্যমান আদালত পরিচালনা করে কারখানার মালিক শফিকুল ইসলাম শফিক (৪৫) কে ১ লক্ষ টাকা জরিমানা ও এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অনাদায়ে আরও ২ মাসের কারাদণ্ড, জমির মালিক রিকি কস্তা (৩৪) কে ২০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ প্রদান করেন।

এর আগে সকাল ১০টার দিকে ভ্রাম্যমান আদালত উপজেলার ভবানীপুরে কারখানার মালিক আজাহার আলীর ছেলে কোরবান আলী (৩৮) কে ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরীর দায়ে ৫০ হাজার টাকা ও তার ভাই সাজদার আলী (২৮) কে ১৫ হাজার টাকা জরিমানা করেন। আদালত ওই দুই স্থান থেকে ২৪ মণ ভেজাল গুড়, ৪ ড্রাম পঁচা তরল গুড়, ৩২ মণ আখের চিনি, ২ লিটার রং মিশ্রিত কেমিক্যাল, ২৮ কেজি পাথর চুন সহ গুড় তৈরীর সরঞ্জমাদি জব্দ করে।

নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক গ্রামবাসী জানান, কালিকপুরের কারখানাটি স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর মুহিত কুমার সরকারের বাড়ি সংলগ্ন। ওই কাউন্সিলর এ ব্যবসায় অংশীদার রয়েছে। ব্যবসায়ী শফিক কাউন্সিলরের ছত্রছায়ায় এ ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলো। তবে এ বিষয়ে কাউন্সিলর মুহিত জানান, শফিক স্রেফ তার বন্ধু লোক, তাই ব্যবসার কাজে একটু-আধটু খোঁজ-খবর নিতে হতো।

ভেজাল গুড় তৈরী কারখানার মালিক শফিকু ইসলাম শফিক বলেন, চিটা গুড় জ্বাল করে এর সাথে হাইড্রোজ, চিনি, পাথর চুন মিছিয়ে গুড় তৈরী করা হত। আর গুড়ের কালার যে যেমন বলতো , কেমিকেল দিয়ে সেরকম করে দেয়া হতো। আমি অন্যায় কাজ করেছি। আর কোন দিন এই ধরনের ব্যবসা করবো না।

শফিকুল আরো বলেন, ৪৮ টাকা কেজি আখের চিনি কিনে তা খেজুরের গুড় বানিয়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা দরে পাইকারী বিক্রি করা হয়। এ খেজুরের গুড় অধিকাংশই ঢাকা ও চট্রগ্রামের ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যায়।
স্থানীয়রা জানান, গত ৪ মাস ধরে নাটোরের লালপুরের মৃত খবির উদ্দিনের ছেলে শফিকুল ইসলাম শফিক বড়াইগ্রামের খৃষ্টানপল্লী রিকি কস্তার বাড়ি ভাড়া নিয়ে চিনির সাথে কেমিক্যাল মিশিয়ে ভেজাল গুড় তৈরী করে আসছিলো। আর এ কাজে ১৬ জন কর্মচারী নিয়োজিত ছিলো। প্রতিদিন তারা ১০ থেকে ১২মন গুড় বাজারে বিক্রি করে আসছিলো।

নাটোরের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুল ইসলাম সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, সাধারণত টেক্সটাইল কারখানায় কাপড়ে রং করার জন্য যে কেমিকেল ব্যবহার করা সে কেমিকেল দিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা গুড় তৈরী করে। এই কেমিকেল মানবদেহের জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর। এটি মানুষ সরাসরি খেলে মানবদেহের অঙ্গপ্রতঙ্গ পচে নস্ট হয়ে যাবে। এছাড়া হাইড্রোজ মানবদেহের জন্য খুব ক্ষতিকর। যেটা মানুষের পেটে গেলে ফুসফুসে পানি ধরা, পচে যাওয়া, ঘা হওয়া সহ নানা ধরনের মারাত্বক রোগ সৃষ্টি করে। তবে এবিষয়ে সচেতনার কোন বিকল্প নেই।

র‌্যাব-৫ নাটোর ক্যাম্পের কমান্ডার মেজর শিবলী মোস্তফা জানান, কালিকাপুরে রিকি কস্তার বাড়ি ভাড়া নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম শফিক দীর্ঘদিন ধরে আখের চিনি জাল দিয়ে তার মধ্যে বিষাক্ত কেমিক্যাল সহ রং মিশিয়ে খেজুরের পাটালী গুড় তৈরী করে তা বাজারজাত করে আসছিলেন। গোপন সংবাদে খবর পেয়ে র‌্যাব এই অভিযান পরিচালনা করে।

নাটোরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট রাজ্জাকুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এবং হুমকির স্বরুপ সব কেমিকেল এবং পচা চিটাগুড় দিয়ে খেজুর বানিয়ে বাজার করে আসছিলো কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। র‌্যাব গোপন সংবাদে খবর পেয়ে সে কারখানাগুলোতে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট দ্বারা অভিযান পরিচালনা করে চারজন কারখানা মালিককে জরিমানা এবং কারাদন্ড দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, শীত মৌসুম এলেই ভেজাল গুড় তৈরী কারখানার মালিকরা তৎপর হয়ে উঠে। অসাধু ব্যবসায়ীরা খেজুর গুড়ের নামে মানুষের স্বাস্থ্যহানি করছে। জেলায় যতগুলো কারখানা রয়েছে, সেসব কারখানার ওপর নজরদারি রেখেছি। এই ধরনের অভিযান অব্যাহৃত থাকবে।

স/শ