ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছিলাম কয়েক মিনিটের জন্যে!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

গেলো সপ্তাহে আমেরিকা থেকে ফিরছিলাম। দুপুর বারোটায় হিউস্টন থেকে শিকাগোর পথে উড়াল দিয়েছি ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের একটা ফ্লাইটে। আড়াই ঘণ্টার পথ। ঘণ্টাখানেক ওড়ার পর মনে হলো ঝিমাই একটু। ন্যাপ নেয়ার মতো।

কিছুক্ষণ পর।

ফ্লাইট জুড়ে নিরবতা। ঘুম ঘুম আবেশ। হাই তুলছি। একটু পর পর। বারবার। হাই তোলাটা সাধারণত কষ্টের ব্যাপার নয়। কিন্তু আমার কষ্ট হচ্ছিলো। প্রতিবার হাই তুলতে গিয়ে টের পাচ্ছিলাম একটা ঠাণ্ডা হিমেল শীতল যন্ত্রণা। ব্রিদিং প্রবলেম। কেমন অবশ অবশ লাগছিলো নিঃশ্বাস নিতে এবং ছাড়তে। আমার চতুর্পাশটা গাঢ় অন্ধকারে ছাওয়া। কোথাও কোনো আলো নেই। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শব্দহীন পৃথিবীর কোনো এক নির্জন প্রান্তরে আমি একা।

অনেকক্ষণ পরে মনে হলো আমার মুখে জিহবায় সুমিষ্ট একটা জলের তিরতিরে স্পর্শ। তারপর মনে হলো কয়েক ফোঁটা মিষ্টি রসের যোগান দেয়া হচ্ছে। আমার মাথায় চুলে একটি হাতের প্রবল নড়াচড়া। ওপর থেকে বাতাস বইছে সরু তীব্র প্রবাহের মতো। দেখলাম পাশের আসনে থাকা শার্লি আমার মাথার চুলগুলোকে আঙুলে নেড়েচেড়ে ওখানে বাতাসের প্রবাহটা সচল রাখছে। মাথাটা ঘামে ভেজা। ঘাড়ও।

তরুণী এয়ার হোস্টেস মেয়েটা আমাকে জিজ্ঞেস করছে–তুমি ঠিক আছো? তুমি এখন কেমন অনুভব করছো? তুমি ঠিক আছো তো?
আমি মাথা নাড়লাম–আমি ঠিক আছি।
এখন এই অরেঞ্জ জুসটা দ্রুত পান করো।
আমি খেতে চাইলাম না, মেয়েটা জোর করলো না তুমি খাও।
মেয়েটির একজন পুরুষ সহকর্মী এসে যোগ দিলেন সেখানে। মেয়েটার পাশে দাঁড়িয়ে খানিকটা ঝুঁকে সেই একই প্রশ্ন তাঁরও–তুমি ঠিক আছো? তুমি এখন কেমন অনুভব করছো? সঙ্গে নতুন প্রশ্ন–তুমি তোমার সকালের অষুধগুলো সব খেয়েছিলে?
মাথা নেড়ে বললাম– খেয়েছি।
ব্রেকফাস্ট করেছো?
করেছি।
তোমার কি খিদে পেয়েছে? কিছু খাবে?
বললাম–না। খাবো না।

বিমানের ভেতরে কোনো একজন পেসেঞ্জারের শারিরীক সমস্যা হয়েছে বুঝতে পেরে একেবারে সামনের দিককার আসন থেকে পঞ্চান্ন-ষাট পেরুনো একজন নারী যাত্রী উঠে এলেন। পুরুষ কর্মীটি সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিলেন। ভদ্রমহিলা একজন ডাক্তার। তিনি আমার সকাল এবং রাতের অষুধের তালিকাটা জানতে চাইলেন।
বললাম।
জিজ্ঞেস করলেন–সকালে কোন কোন্ অষুধ  খেয়েছো।
বললাম–ডায়াবেটিস-হাই ব্লাড প্রেসার-কোলস্টোরেলের অষুধের সঙ্গে কয়েকটা সাপ্লিমেন্ট।
–এখন তুমি কেমন বোধ করছো? ড্রাউজি লাগছে?
–কিছুক্ষণ আগে লাগছিলো কিন্তু এখন একদম ঠিক আছি।

আমার পাশের যাত্রীটি বললেন–হি ওয়াজ নট রেস্পন্ডিং। এয়ার হোস্টেস, তার স্ত্রী তাকে প্রশ্ন করছিলেন কিন্তু তিনি কোনো জবাব দিচ্ছিলেন না। তার স্ত্রীর কথায় আমিই পাখাটা তার মাথার দিকে ফোকাস করে দিয়েছি।

আমি খুব বিনয়ের সঙ্গে সবার কাছে স্যরি বললাম। সবাইকে ধন্যবাদ দিলাম।

এয়ার হোস্টেস মেয়েটি বললো–অনেকক্ষণ ধরে তুমি কোনো কথা বলছিলে না। হালকা নাশতা সার্ভ করতে এসে তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–কি খাবে? প্রেটজেল না কুকি? কোক-জুস নাকি পানি? কিন্তু তুমি তাকিয়েই থাকছিলে শুধু। কোনো জবাব দিচ্ছিলে না। তোমার স্ত্রীও তোমাকে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করছিলো কিন্তু তুমি কথা বলছিলে না। অতঃপর আমি চলে গিয়েছিলাম এখান থেকে।

কিছুক্ষণ পর তোমার স্ত্রী তার আসনের ওপরে থাকা কলিং বেলে কল দিতেই ছুটে এসেছিলাম আমি। তোমার স্ত্রী খুব দ্রুত আমাকে জানালো তুমি ডায়বেটিসের পেসেন্ট। শুনেই আমি এক দৌড়ে তোমার জন্যে খানিকটা জুস এনে দিলাম। আমার মনে হয়েছিলো  তোমার হয়তো বা সুগার ফল করেছে। তোমার স্ত্রী তোমাকে জোর করে সামান্য কয়েক ফোঁটা জুস পান করাতে পারলো। তারপরেই তুমি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে।

নারী যাত্রী সেই ডাক্তার ভদ্রমহিলা এয়ার হোস্টেস মেয়েটিকে বললেন–তুমি ঠিক কাজটিই করেছো। সুগার ফল করেছিলো এই ভদ্রলোকের। মিষ্টি কিছু খাওয়ানোটা খুব জরুরি ছিলো।

অরেঞ্জ জুস এবং পানি পান করার কিছুক্ষণ পর আমি ওয়াসরুমের দিকে এগোলাম। ওখানেই তিনজন এয়ার হোস্টেস ছিলেন। একজন বললেন, তুমি কিছু একটা খাও। আমাদের এখানে অনেক স্ন্যাকস আছে। কিনতে হবে না। এমনিতেই নাও তুমি। যেটা খুশি কিছু একটা খাও।
আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, নাহ আমি খেয়েছিলাম। খিদে নেই আমার এখনো।

সেই এয়ার হোস্টেস মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম–আচ্ছা আমি কতোক্ষণ ধরে ব্ল্যাক আউট অবস্থায় ছিলাম বলতে পারো?

মেয়েটি বললো–সব মিলিয়ে তিন থেকে চার মিনিট তো হবেই। আর তোমার মুখের রঙটা কেমন হয়েছিলো জানো?
–কেমন?
–এই যে এমন, বলে নিজের পরনের শাদা জামাটা দেখালো।
অর্থাৎ রক্তশুন্য হয়ে গিয়েছিলো চেহারাটা।

এয়ার হোস্টেসদের টিম লিডার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন–তোমার জন্য শিকাগোতে ডাক্তারের ব্যবস্থা করি? নেমেই সব রেডি পাবে।

আমি বললাম–না। সেটা করতে যেও না। আমার দরকার নেই। আমি ঠিক আছি একদম।

তিনি বললেন–তুমি এই সেবাটা নিতে পারো কিন্তু। তোমার ডেস্টিনেশন কোথায়?

বললাম–অটোয়া। সমস্যা নেই। কানেক্টিং ফ্লাইট ধরে চলে যাবো। তারপর আমার চিকিৎসকই আমার দেখভাল করবেন। টেনশনের কিছু নেই।

সুস্থির হবার পর শার্লিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম–আমার কী হয়েছিলো বলতো? আমি তো একেবারেই ব্ল্যাক আউট হয়ে গিয়েছিলাম! আমার আচরণ কেমন ছিলো তখন? আমি কি উলটাপালটা কিছু করেছিলাম?

শার্লি জানিয়েছিলো–ঘামছিলি খুব। মাথার চুল ভিজে উঠেছিলো। তাকিয়ে ছিলি ওপর দিকে এক দৃষ্টিতে ভাবলেশহীনভাবে। চোখ দু’টো বড় বড় করে। ধাক্কার পর ধাক্কা দিচ্ছিলাম। ফিরেও দেখছিলি না। জবাবও দিচ্ছিলি না। কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলি তুই।

ভাগ্যিস সেদিন শার্লি ছিলো সঙ্গে। এবং সময় মতো ডায়বেটিসের কথাটা বলেছিলো শার্লি!

 

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন