বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশের জন্য লড়াই

আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, অগ্নিকুণ্ডলিতে গোটা জাতির দগ্ধ হওয়া ও প্রতিরোধ রচনার করুণ মধুর অভিজ্ঞতার সাক্ষী, তাদের মুক্তিযুদ্ধ-ভাবনা সবসময় প্রবল আলোড়নময়।

সভা-সমিতি কিংবা প্রকাশ্য সমাবেশে উচ্চারিত ভাবনা নয়, একান্ত মুহূর্তে নিজের সঙ্গে নিজের যে বোঝাপড়া সেখানে থাকে বেদনার ভার, থাকে শূন্যতার হাহাকার, কেননা কাছের মানুষদের হারানো কিংবা নিগ্রহের অভিজ্ঞতা তো রয়েছে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি পরিবারের।

এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রতিরোধের শৌর্য, বীরত্ব ও সৌন্দর্য। কেবল অসম নয়, সবরকম সামরিক হিসাবের বাইরে দাঁতে দাঁত চাপা লড়াইয়ে মার্শাল জাতি হিসেবে খ্যাত সংগঠিত পাক সেনাবাহিনীকে যে পরাজয় মেনে নিতে হল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে স্টালিনগ্রাডের যুদ্ধে হার মেনে জার্মান প্যান্থার বাহিনীপ্রধান ভন পলাসের লাখো বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর এমন বিশাল পরাজয় তো যুদ্ধ-ইতিহাসে আর ছিল না।

এ কথা ঠিক, ৩ ডিসেম্বর থেকে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর যোগদান সমরাস্ত্রের হিসাব পাল্টে দিয়েছিল এবং তা যুদ্ধের গতি ত্বরান্বিত করেছিল। তবে মুক্তিবাহিনী ও বাংলার জনগণই নির্ধারণ করে দিয়েছিল যুদ্ধের ভাগ্য। বিমানযুদ্ধ তো তিনদিনেই শেষ, ট্যাংক যুদ্ধ বিশেষ হয়নি, এমনকি জেনারেল নিয়াজির ব্যাটল অব ঢাকাও শেষ পর্যন্ত ঘটেনি।

প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে পাকবাহিনীর পরাজয় ঘটল কোন যুদ্ধে? এ যুদ্ধ ছড়িয়ে ছিল সারা দেশে, যেখানেই পাকবাহিনী সেখানেই হয়েছে লড়াই, সে লড়াই মরণপণ ছিল বটে এবং কোথাও সে-যুদ্ধে পাকবাহিনীর টিকে থাকার কোনো সুযোগ ছিল না, কারণ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ছিল গোটা দেশের মানুষ। সব মানুষের সম্মিলিত জনযুদ্ধের মহিমা অপরূপভাবে প্রকাশ পেয়েছিল ডিসেম্বরের এ দিনগুলোতে।

যুদ্ধের দিকে ফিরে তাকালে তাই দেখি অসংখ্য মুখ, সারা দেশের অগণিত মানুষ এবং সেই মানুষের সারিতে বেশিরভাগই গ্রামের মানুষ, নারী ও পুরুষ, কৃষকের সন্তান। আর তাই যখন উচ্চারিত হয় পোশাকি শব্দাবলী, স্বাধীনতার সুফল, তখন মনে হয় এসব মানুষের কথা।

আজ বাংলাদেশ যে মধ্য আয়ের দেশে রূপান্তরিত হচ্ছে সেটা বড় অর্জনই বটে; কিন্তু এর সুফল কতটুকু গ্রামের মানুষদের কাছে, শহরের নিু ও মধ্য আয়ের পরিবারে পৌঁছতে পেরেছে, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ তো সেই হিসাব নিরন্তর কষে যাবে।

তাই যখন দেখি মেঠোপথ বেয়ে স্কুলের পোশাক পরে সারি বেঁধে হাস্যোজ্জ্বল বালক-বালিকারা যাচ্ছে বিদ্যালয়ে, নিবিড় সবুজ প্রকৃতি ঘিরে আছে তাদের, তখন মনে হয় এই তো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ, যেখানে জীবন বিকাশের সুযোগ পৌঁছায় প্রান্তিক পরিবারের নবীন-নবীনাদের কাছে।

আবার যখন দেখি অন্য চিত্র- শিক্ষার গুণগত মানে ব্যাপক তারতম্য, চিলমারীর বিদ্যালয় ও শহর-নগরের বিদ্যালয়ে ফারাক থাকে দুস্তর- তখন মন বিষণ্ণ না হয়ে পারে না। এমন বৈষম্য তো বাংলাদেশের প্রাপ্য ছিল না।

পাশাপাশি আরেক বাস্তবতা আমাদের উৎফুল্ল করে, বছরের প্রথম দিনে সমস্ত বিদ্যালয়ের সব ছাত্রছাত্রীর হাতে পৌঁছে যায় বই বিনামূল্যে, এ আয়োজনের বিশালতায় বিস্মিত হতে হয়।

এখানে আরেক বাস্তবতা আমাদের উদ্বেলিত করে, পাঠ্যবই বিদ্যার এক প্রধান উপকরণ, এ উপকরণে কোনো ফারাক থাকে না, ধনী-গরিব, শহর-গ্রামের সর্বত্র সব শিক্ষার্থী পাচ্ছে একই মানের একই বই একসঙ্গে। এর পাশাপাশি যখন পাঠদান ও পাঠগ্রহণেও সমমান সবার জন্য অর্জিত হবে, তখন সেটা হবে অশেষ তৃপ্তির বিষয়।

বৈষম্যমুক্ত তেমন এক বাংলাদেশের লড়াই তো আজকের যুদ্ধ। অর্জন আছে অনেক, তবে করণীয় রয়েছে আরও বেশি।

মফিদুল হক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব