বেড়েছে সরকারের ঋণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণের চাপ বেড়েছে। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ আরো বেড়েছে। যদিও ২০১৮ সালের শুরুর দিকে সরকারি ঋণের চাপ ছিলই না। উল্টো সরকার ঋণ পরিশোধ করেছে।

ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়ায় বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহে ভাটা পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ না বাড়লে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হবে না। চলতি বছরের প্রথম ১৫ দিনে ব্যাংকে সরকারের ঋণ বেড়েছে এক হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে ছয় মাসে ঋণ বেড়েছে পাঁচ হাজার ৩১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকের কাছে সরকারের ঋণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পর্যাপ্ত রাজস্ব আদায় না হওয়ায় ব্যয় নির্বাহ ও উন্নয়নকাজ চালাতে ট্রেজারি বিল ও বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিচ্ছে। নন-ব্যাংকিং উত্স সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমেও সরকারের ঋণ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৯ সালে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে সরকারের ঋণের টার্গেট ৭১ হাজার ২২৭ কোটি টাকা। যার মধ্যে ৪২ হাজার ৩০ কোটি টাকা ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে আর ২৯ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা নন-ব্যাংকিং উত্স বা সঞ্চয়পত্র থেকে।

জানা যায়, চলতি বছরের ১ থেকে ১৫ জানুয়ারি সময়ে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নিয়েছে এক হাজার ১৮৩ কোটি টাকা। অথচ ২০১৮ সালের এই সময়ে সরকারের ঋণ নেওয়া কমেছিল। গত বছরের প্রথম ১৫ দিনে আগের বছরের চেয়ে এক হাজার ৭৮০ কোটি টাকা কম ঋণ নিয়েছিল সরকার।

সূত্র বলছে, ঘাটতি বাজেট ও আশানুরূপ রাজস্ব আদায় না হওয়ায় ব্যাংক থেকে সরকারকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংকে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঋণের চাহিদা বাড়লেও আশানুরূপ আমানত আসছে না। ঋণের চাহিদা বেশি, কিন্তু আমানতের জোগান কম থাকায় ঋণ দিতে হিমশিম খাচ্ছে ব্যাংক। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের ঋণ প্রদানের সক্ষমতাও কমেছে।

ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। কিন্তু সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হয়েছে। মূলত নির্বাচনের কারণে বিনিয়োগে স্থবিরতায় বেসরকারি খাতে লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির জানিয়েছিলেন।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘রাজস্ব আদায়ে সরকারের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সেটি পূরণ না হওয়ায় সরকারের ঋণের চাপ বেশি। রাজস্ব আদায়ে সরকারের টার্গেট ছিল ৪৩ শতাংশ, কিন্তু পূরণ হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ, যা রাজস্বে ব্যাপকভাবে শর্টফল সৃষ্টি করেছে। কিন্তু ব্যয় নির্বাহে সরকারকে সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। এই ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া ব্যাংক ও সরকার উভয়ের জন্যই খারাপ। অন্যান্য বছর সরকার কিছু ঋণ পরিশোধ করলেও এবার হচ্ছে না। যা ক্রাউডিং ফ্যাক্টর তৈরি করছে।’

আহসান এইচ মনসুর আরো বলেন, অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ কমেছে। আমানতের পরিমাণ কমলে ব্যাংকের ঋণ প্রদানের ক্ষমতাও কমে। কিছু ব্যাংক অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ করেছিল, সেটা সমন্বয় করতে গিয়েও ব্যাংকের ঋণের প্রবাহে টান পড়ছে। ব্যাংকে তারল্য একটি আঁটসাঁট অবস্থার মধ্যে রয়েছে। এই অবস্থার মধ্যে সরকারের ঋণ নেওয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেসরকারি খাত প্রভাবিত হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারকে ভাবতে হবে।

চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ১৬.৮ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও প্রান্তিক শেষে ১৩.৩ শতাংশ অর্জিত হয়। আর সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৮.৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও অর্জিত হয় ১৩.৩ শতাংশ। দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি বাড়িয়ে ১০.৯ শতাংশ আর বেসরকারি খাতে ১৬.৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানা যায়, বেসরকারি খাতে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ৫.৬৫ শতাংশ হলেও আগের বছরের চেয়ে তা ছিল কম। আগের বছরের একই সময়ে অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯.১৪ শতাংশ। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর শেষে সরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ৬.৪৬ শতাংশ, কিন্তু আগের বছর একই সময়ে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছিল ৭.৯৪ শতাংশ।

ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ ৯৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই সরকারের ধার ২৪ হাজার ৪৪১ কোটি টাকা। আর অন্যান্য ব্যাংক থেকে ৬৮ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৬৮ হাজার ৭২৩ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ৯৩ হাজার ২৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু এই সময়ে সরকার কিছু ঋণ পরিশোধ করায় ঋণের পরিমাণ কিছুটা কমলেও আগের বছরের তুলনায় ঋণ নেওয়া ঊর্ধ্বমুখী।